চারপাশে পোড়া চামড়া আর ওষুধের উৎকট গন্ধ; দগদগে পোড়া ক্ষত নিয়ে লোহার খাটে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর কণ্ঠে কাতর গোঙানি আর স্বজনদের চোখে নীরব অশ্রু।এরই মধ্যে চিকিৎসক-নার্সদের ব্যস্ত ছোটাছুটি।
Published : 21 Jan 2015, 06:10 PM
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের পঞ্চম তলায় ৫০৩ নম্বর কক্ষের চিত্র এটি। কক্ষের দরজায় সাঁটানো একটি সাদা কাগজে লেখা ‘হরতাল ভিকটিম’।
যে সাতজন এই কক্ষে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, তাদের সবাই অবরোধ-হরতালে নাশকতার শিকার।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকার জানান, যারা তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে এসেছেন বুধবার পর্যন্ত তাদের মধ্যে ভর্তি আছেন ২১ জন। এদের মধ্যে গুরুতর দগ্ধ পাঁচজন আছেন আইসিইউতে।
গত ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মোহাম্মাদপুরে একটি বাসে ছোড়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসেন ২৮ বছর বয়সী ট্রাকচালক আরমান হোসেন।
তার দুই ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণির শান্ত ও তৃতীয় শ্রেণির সায়েম উদ্বিগ্ন মুখে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে। তবে তাদের বাবা চোখ খুলে সন্তানদের দেখার মতো অবস্থায় নেই। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শিল্পী এখন পর্যন্ত আরমানের পাশে এসে দাঁড়াতে পারেননি।
আরমানের শাশুড়ি জানালেন, আরমানের ঘা শুকাতে অনেক সময় লাগবে বলে চিকিৎসকরা তাদের জানিয়েছেন।
নাতীদের দেখিয়ে তিনি বলেন, “এখন এগো ভরণপোষণ কে দিব? সরকার কি খরচা দিব? যারা হরতাল দিছে তারা কি খরচা দিব? চিকিৎসার খরচ কই থেকে আসব? এরা বাসায় গিয়া কি খাইব?’’
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের অবৈতনিক উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবরোধে সহিংসতার শিকার হয়ে যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তাদের কেউই আশংকামুক্ত নন।”
বার্ন ইউনিটের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই চোখে পড়ে মাদুর পেতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন কয়েকজন রোগী। করিডোরে পাতা বেডেও ঠাঁই না মেলায় অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন মেঝেতে শুয়ে। দোতলা হয়ে তিন ও চারতলায় উঠতেও দেখা যায় পোড়া রোগীদের ভিড়।
চিকিৎসকরা বলছেন, এমনিতেই যেখানে হাসপাতালে ঠাঁই নেই, সেখানে রাজনৈতিক সহিংসতা যোগ করছে বাড়তি চাপ।
এরই মধ্যে নাশকতায় দগ্ধদের দেখতে ভিআইপিরা আসছেন, সরকারি-বেসরকারি লোকজন ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় থাকছে, সব সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ইউনিটের কর্মীদের।
বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তিনশ শয্যার এই ইউনিটে তাদের প্রায় চারশ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
“কিন্তু পেট্রোল বোমায় ঝলসে যাওয়া বা ককটেলে দগ্ধ পেশেন্টরা হঠাৎ হঠাৎ আসছেন। শিডিউলড কাজের বাইরে ডাক্তারদের রিকোয়েস্ট করে আনতে হচ্ছে। প্রতি মাসে ডাক্তারদের যে রোস্টার থাকে তার বাইরে আবার তাদের ডেকে আনতে হচ্ছে।চিকিৎসক-নার্স সবাইকে বেশি বেশি কাজ করতে হচ্ছে, লোড নিতে হচ্ছে।”
মঙ্গলবার রাতে গাজীপুর শহরের শিববাড়ি এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ছোড়া হলে ভাঙা জানাল দিয়ে নামতে গিয়ে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র পৃথ্বীরাজ চক্রবর্তীর হাত ঝলসে যায়। পৃথ্বীসহ ওই ঘটনায় দগ্ধ চারজনকে রাতেই নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে।
“তাদের রাজনীতির জন্য আমার আর কোনোদিনই পড়ালেখা করা হবে না বলে আমার মনে হয়। আমার সাথে যে রকম হয়েছে, সেরকম যেন আর কারো সঙ্গে না হয়”, বলেন এই কলেজ ছাত্র।
গাজীপুরের ওই ঘটনায় বাসে থাকা অটোরিকশা চালক আবদুর রশিদ মোল্লার শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানান। তার বেডের পাশেই উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল তার স্ত্রী রাশেদা আক্তার ও ছেলে রাহাতকে।
ওই ঘটনায় দগ্ধ কলেজছাত্র রাজীব কর্মকার (২০) ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নিতাই সরকারও (৫৬) বার্ন ইউনিটে ভর্তি।
পার্থ শংকর পাল বলেন, “বাড়তি চাপের কারণে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। রোগীর ভীড়ের কারণে অনেকে সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এতে তাদের চিকিৎসা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি ঝুঁকিও বাড়ছে।”
[প্রতিবেদনটির জন্য তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোকচিত্রী আসাদুজ্জামান প্রামানিক।]