‘সবার চোখ-মুখের ভাষা বলছিল জিহাদ আছে’

ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবিতে মানবদেহের অস্তিত্ব না পাওয়া; এক পর্যায়ে জিহাদের পড়ে যাওয়ার ঘটনাই যখন প্রশ্নবিদ্ধ; শেষমেশ ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা। তারপরও শুধু প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখ-মুখের ভাষা দেখেই শেষ চেষ্টায় অবিচল ছিলেন উদ্ধারকারী তরুণরা।

ফয়সাল আতিকআশিক হোসেন ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2014, 12:47 PM
Updated : 29 Dec 2014, 12:47 PM

জিহাদকে ‘আবিষ্কারের’ পুরো ঘটনা খুলে বলতে সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম কার্যালয়ে এসেছিলেন উদ্ধারকারীদের তিনজন।

এদের মধ্যে ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম ফারুক উদ্ধারকাজে অর্থ জোগান দেন, নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি। পাশে ছিলেন শাহ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুন ও সুজন দাস রাহুল।

রাহুল রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আর মুন বেসরকারি পলিটেকনিকের পুরকৌশলের শিক্ষার্থী।

শুক্রবার বিকাল থেকে শুরু করে প্রায় ২৩ ঘণ্টার চেষ্টায় শাহজাহানপুর রেল কলোনিতে পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের পাইপে জিহাদের পড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ তুলে ফায়ার সার্ভিস যখন গুটিয়ে নিচ্ছিলেন অভিযান, ঠিক তার কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজেদের প্রযুক্তি ও বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে পাইপের ভেতরই তারা আবিষ্কার করেন জিহাদকে।

কথা বলে জানা গেল, উদ্ধারকারী এই তরুণরা কেউই উদ্ধার কাজে প্রশিক্ষিত নন, শুধু মানবতার খাতিরে ছুটে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে।

শিশু জিহাদকে উদ্ধারের মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা রাত থেকেই উদ্ধারকারীদের সঙ্গে ছিলাম। তাদের উদ্ধার পদ্ধতি দেখে ওই খাঁচা তৈরির পরিকল্পনা করি। পরে ঘটনাস্থলে রাতেই বানানো খাঁচাগুলোর পদ্ধতি দেখে আমার কল্পনা করা খাঁচার আকৃতিতে আরেকটু পরিবর্তন আনি।”

ফারুকদের এ অভিযানের সময় আনোয়ার নামে একজন এগিয়ে আসেন, যিনি সরবরাহ করেছিলেন ক্যামেরা। ওই ক্যামেরাটি শেষ পর্যন্ত খাঁচার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। পরে পুরো যন্ত্রটির নাম দেন ‘মেকানিক্যাল ক্যাপসুল’।  

ফারুক বলেন, “আমরা খাঁচা থেকে বেশ কিছু দূরত্বে আনোয়ারের ক্যামেরাটি জুড়ে দিয়েছিলাম। খাঁচাটি ভেতরে পাঠানো হয় বেশ ধীরে ধীরে। একশ’ ফিটের বেশি দূর এগোনোর পর খাঁচাটি বাধা পায়। তবে আমাদের লক্ষ্য ছিল আরও গভীরে।”

“পরে খাঁচাটি ১০ ফুটের উপরে তুলে আবার ছেড়ে দিই, এটি তখন স্ববেগে বাধা অতিক্রম করে এগোতে থাকে। এরপর আমরা ধীরে ধীরে রশি ছাড়ছিলাম।”

যেখানে জিহাদের লাশ পাওয়া গেছে সেখানে ফের খাঁচাটি বাধাগ্রস্ত হয় বলে জানান তিনি।

শফিকুল ইসলাম ফারুক জানান, এক পর্যায়ে তাদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে শিশু জিহাদের অবয়ব। আর তা দেখে উৎফুল্ল হয়ে পড়ের উদ্ধারকারীরা।

“প্রায় আড়াইশ ফিট দূরত্বে যাওয়ার পর জিহাদের মুখ দেখে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। আমার চোখে পানি চলে আসে। আমরা ক্যামেরায় দেখি- শিশুর মাথা উপরের দিকে। কপালের উপরে একটি হাত। প্রথমবার আমি চিৎকারই দিয়ে বসেছিলাম। পরে পুলিশ ও দমকল বাহিনীর লোকজন এসে আমাকে শান্ত হতে বলে।”

তিনি বলেন, “আমরা এরপর ধীরে ধীর খাঁচাটি উপরের দিকে তুলতে শুরু করি। বেশ কিছু দূর এগোনোর পর হঠাৎ যখন তুলে আনা বস্তুটির ওজন কিছুটা কমে যাচ্ছে মনে হয়, তখন আমরা খাঁচা টানা থামিয়ে দেই। পরে বুঝে শুনে আবার সতর্কতার সঙ্গে টানা শুরু করি।”

ফারুক বলেন, “২৩৫ থেকে ২৪০ ফুট যাওয়ার পর পানি পাওয়া যায়। এর ৫/৭ ফুট নিচে পাওয়া যায় জিহাদকে। জিহাদের সাথে জড়িয়ে যাওয়া দড়ির সাথে মেকানিক্যাল ক্যাপসুলের আংটা জড়িয়ে যাওয়ায় শিশুটিকে তুলে আনা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে।”

আরেক উদ্ধারকারী যুবক মুন বলেন, “মানুষ আমি, বুদ্ধি আমাদেরও আছে, এই বিশ্বাস নিয়েই আমরা এগিয়ে গেছি। পুরো অভিযান শেষ হতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লেগেছে।

“খাঁচাটি তৈরির সময় পলিট্যাকনিক্যালে পড়ার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। প্রথমবার যখন জিহাদ আমাদের হাতে এল, মনে হল সে বেঁচে আছে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্থানীয় জনতা তাকে আমাদের হাত থেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমরাও হাল না ছেড়ে তার সাথে ছুটতে থাকি।”

রাহুল অবশ্য খানিকটা কৃতিত্ব ফায়ার সার্ভিসের দিকেও ঠেলে দিলেন।

“ফায়ার সার্ভিসের লোকজন অনেক হেল্প করেছে। আমরা যখন অপারেশন চালাই তাদের অনেকেই আমাদের পাশে ছিল। তাদের ক্রেনটিকে আমরা কাজে লাগিয়েছি।”

উদ্ধার তৎপরতা শুরুর আগে কেউ কাউকে চিনতেন না বলে জানান এই তরুণরা। ঘটনাস্থলে গিয়েই নিজেদের মধ্যে পরিচয় হয়।

রাহুল জানান, টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার দেখে দুই সহপাঠীকে নিয়ে তিনি রওনা হন উদ্ধার কাছে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে।

“রাতে লোকজনকে অনেকবার বলেছিলাম, কিন্তু কেউ তখন আমাদের পাত্তা দেয়নি। আসলে আমাদের কথা শোনার সময় ও পরিবেশ তখন ছিল না। পরে সকাল প্রায় ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি পেয়ে আমরা খাঁচাটি বানানো শুরু করি। আমরা আমাদের পদ্ধতির সফলতার বিষয়ে শতভাগেরও বেশি নিশ্চিত ছিলাম,” বলেন ফারুক।

খাঁচাটির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা খাঁচাটিতে দুই ধরনের লুপ ব্যবহার করেছি। একটা ছিল ফিক্সড, অন্যটি ফোল্ডিং। আমাদের ধারণা ছিল পাইপের ভেতরে ফিক্সড অংশটি যদি ব্যর্থও হয় তবে আংটা সাদৃশ ফোল্ডিং লুপ দিয়ে ভেতরে যা থাকুক উঠে আসবে।”

তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- অনেকেই যখন জিহাদের পড়ে যাওয়ার বিষয়টি ‘গুজব’ বলে প্রচার করা শুরু করেছিলেন তারপরও কেন তারা শেষ চেষ্টা করলেন?

জবাবে ফারুক বলেন, “ঘটনার আকস্মিকতায় আমরাও দ্বিধান্বিত ছিলাম। আগের অপারেশনগুলোর পর বলা হল ভেতরে মাকড়শার বাসা। অর্থাৎ শিশুটি সেখানে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার একজন সুইপার যখন নিজেই সেখানে ঢুকে পড়তে উদগ্রিব তা দেখে মোটেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম যে, জিহাদ সেখানে নেই।

“ওই সুইপার ও স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখের ভাষা, চোখের ভাষা দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল, জিহাদ পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি মোটেও মিথ্যা নয়।”

কূপের ছোট পাইপটি কেটে ফেলায় পানিতে ডুবে জিহাদের মৃত্যু হওয়ার শঙ্কা করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যদি স্থানীয়দের কথা ঠিক হয়ে থাকে যে তারা জিহাদের কথা শুনতে পেরেছেন, তাহলে আমার ধারণা জিহাদ পাইপে ঝুলে ছিল। হয়তো পাইপটি কেটে ফেলার পরে সে নিচে পানিতে তলিয়ে যায়।”

অভিযানের শুরুতে ক্যামেরা দিয়ে জিহাদের অবস্থান নিশ্চিত করা উচিত ছিল বলেও মনে করেন শফিকুল ইসলাম ফারুক।

</div>  </p>