বাগেরহাটের তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠন রাজাকার বাহিনীর তিন সদস্য বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ ও খান আকরাম হোসেনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দিয়েছে প্রসিকিউশন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2014, 04:50 PM
Updated : 14 Sept 2014, 05:03 PM
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে রোববার এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন প্রসিকিউটর সায়্যেদুল হক সুমন ও শেখ মুশফিক কবির।   

পরে সায়্যেদুল হক সুমন সাংবাদিকদের বলেন, “এই তিন আসামির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাগেরহাটে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্মান্তরিতকরণসহ মোট আটটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

“এর মধ্যে সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে ছয়টি এবং আব্দুল লতিফ ও খান আকরামের বিরুদ্ধে চারটি করে অভিযোগ আনা হয়েছে।”

তদন্ত সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামিরা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। খুলনার আনসার ক্যাম্পে (ভূতের বাড়ী) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে প্রশিক্ষণের পর অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করে অন্যান্য রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরিতকরণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ চালায়।

আব্দুল লতিফ, সিরাজ মাস্টার ও আকরামের বিরুদ্ধে নয়টি খণ্ডে প্রমাণপত্রসহ ৮৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আনা ৮টি অভিযোগের পক্ষে ৬৪ জন সাক্ষী রয়েছেন।

গত বছরের ২১ মে এ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিন। গত ১০ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

কচুয়া থানা পুলিশ ১১ জুন আব্দুল লতিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে। এরপর গত ১৯ জুন আকরাম হোসেন খানকে রাজশাহী থেকে গ্রেপ্তার করে মোড়েলগঞ্জ থানা পুলিশ তাকেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করে।

সর্বশেষ গত ২১ জুলাই সোমবার রাতে বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রামে চাচা শ্বশুরের পরিত্যক্ত খুপড়ি ঘর থেকে সিরাজ মাস্টারকে গ্রেপ্তার করে বাগেরহাট মডেল থানা পুলিশ। ৭ অগাস্ট ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত।

ট্রাইব্যুনালের আদেশে বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।

গত ২৫ অগাস্ট প্রসিকিউশনে এ তিন রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় তদন্ত সংস্থা।

তদন্ত সংস্থা জানায়, গ্রেপ্তার তিনজনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার শাঁখারীকাঠি বাজারে একসঙ্গে ৪২ জনকে হত্যা এবং শতাধিক লোককে ধর্মান্তরের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৪২ জনকে হত্যার ঘটনাটি ‘শাখারিকাঠি গণহত্যা’ নামে পরিচিত।

ওই গণহত্যায় নিহত রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় সিরাজ মাস্টারসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

বাগেরহাটের আদালত মামলাটি ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দিয়ে তা আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।

আট অভিযোগ

অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ১৩ মে দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাগেরহাট জেলার রঞ্জিতপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুট এবং অগ্নিসংযোগ। এসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪০-৫০ জন নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ২: বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার ডাকরার কালীমন্দিরে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই-তিন হাজার লোক। ১৯৭১ সালের ২১ মে বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর‌্যন্ত তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ৬০০-৭০০ জনকে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ১৮ জুন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সদর থানার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া এলাকায় ১৯ জন নিরীহ নিরস্ত্র লোককে আটক, নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সদর থানার চূলকাঠিতে হামলা চালিয়ে ৫০টি বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসময় সাতজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কচুয়া থানার শাখারিকাঠি হাটে হামলা চালিয়ে ৪২ জনকে আটক, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এসময় অনেক বাড়ির মালামাল লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে কোনো একদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর‌্যন্ত শাখারিকাঠি ও আশপাশের এলাকার প্রায় ২০০ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে কলেমা পড়িয়ে, নাম পরিবর্তন করে এবং গো-মাংস দিয়ে ভাত খেতে বাধ্য করে জোরপূর্বক মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।

অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে বিকাল আনুমানিক ৫টা পর‌্যন্ত কচুয়া থানা সদরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিরস্ত্র পাঁচজনকে আটক, নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ৮: ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টায় জেলার মোড়েলগঞ্জ থানার তেলিগাতীতে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদারকে আটক, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।