ঘটনার ১০ বছর পর বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ের তারিখ হয়েছে।
Published : 13 Jan 2014, 04:22 PM
আগামী ৩০ জানুয়ারি এই রায় দেবেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান।
এই মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির সাবেক শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের সাবেক দুই প্রধানও আসামি।
অস্ত্র আইন ও চোরাচালানের অভিযোগে করা এই দুই মামলায় ভারতের বিদ্রোহী সংগঠন উলফার নেতা পরেশ বড়ুয়াও এই মামলার আসামি। তবে তিনি পলাতক।
বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে আটক হওয়া এই অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৎকালীন সরকারের মদদে উলফার জন্য আনা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। তখন বিভিন্নভাবে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগও রয়েছে।
অধিকতর তদন্তের পর ওই ঘটনায় অস্ত্র মামলায় ৫০ জন এবং চোরাচালান মামলায় ৫২ জনকে আসামি করে বিচারকাজ চলে। একইসঙ্গে চলা দুই মামলায় সাক্ষী করা হয় ২৬৫ জনকে।
আসামিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তবে চাপ দিয়ে ওই জবানবন্দি নেয়া হয় বলেও পাল্টা অভিযোগ করেছেন কয়েকজন আসামি।
দুই বছর ধরে শুনানির পর সোমবার আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায়ের দিন ঘোষণা করেন বিচারক মজিবুর রহমান।
আসামিপক্ষের আর কোনো যুক্তি থাকলে তা আগামী ২৩ জানুয়ারির মধ্যে লিখিতভাবে জমা দিতে বলেছেন তিনি।
রায়ের দিন ধার্য হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) কামাল উদ্দিন আহাম্মদ, যিনি বিচারের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে আদালতেও কয়েকবার ক্ষোভ জানিয়ে আসছিলেন।
কামাল উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামিপক্ষের সময় ক্ষেপণসহ নানা বাধা পেরিয়ে রায় হতে যাচ্ছে। এতে আমি খুব সন্তুষ্ট।”
রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালনকারী এই আইনজীবী আশা করছেন, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তিই হবে।
চোরাচালান মামলায় সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং অস্ত্র মামলায় সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজার বিধান আছে।
মামলা এগিয়ে নিতে প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরে পিপি কামাল বলেন, “চারদলীয় জোট সরকারের সময় সঠিক তদন্ত হয়নি। মূল আসামিদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। পরে অধিকতর তদন্ত করতেও অনেক সমস্যা হয়েছে।”
কর্ণফুলী নদী তীরে রাষ্ট্রায়াত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সংরক্ষিত জেটিঘাটে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে ট্রলার থেকে অস্ত্র খালাসকালে পুলিশ ১০ ট্রাক সমপরিমাণ অস্ত্র আটক করে।
অত্যাধুনিক অস্ত্রের এই বিশাল চালানটি নিয়ে তখন দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। অস্ত্র উদ্ধারের পর সেদিন রাতে কর্ণফুলী থানার ওসি আহাদুর রহমান বাদি হয়ে অস্ত্র ও চোরাচালান আইনে আলাদা দুটি মামলা করেন।
এই দুটি মামলার তদন্ত করেন পাঁচ তদন্ত কর্মকর্তা (আইও)।
২০০৪ সালের ১১ জুন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন অস্ত্র মামলায় ৪৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন।
একই বছরের ৯ নভেম্বর সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান চোরাচালান মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন।
২০০৫ সালের ৬ জুলাই এ মামলায় বাদি আহাদুর রহমানের সাক্ষ্য দেয়ার মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে। তখন পর্যন্ত অস্ত্র মামলায় ৩১ জন এবং চোরাচালান মামলায় সাক্ষ্য দেন ২৮ জন।
এরপর সিআইডির এএসপি ইসমাইল হোসেন এবং পরে সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মনিরুজ্জামান চৌধুরী ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তদন্তভার গ্রহণ করেন।
অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন মামলা দুটিতে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান।
এতে অস্ত্র আইনের মামলায় ৫০ জন এবং চোরাচালান মামলায় ৫২ জনকে আসামি করা হয়। দুই মামলাতেই সাক্ষী করা হয় ২৬৫ জনকে।
২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর দুই মামলায় নতুন করে অভিযোগ গঠনের পর ২৯ নভেম্বর থেকে আবার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর আইও মনিরুজ্জামানের জেরা শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে মামলা দুটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। অস্ত্র মামলায় মোট ৫৬ জন এবং চোরাচালান মামলায় মোট ৫৩ সাক্ষী সাক্ষ্য দেন।
এরপর ২৩ অক্টোবর থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুসারে আসামিদের পরীক্ষা করা শুরু করে রাষ্ট্রপক্ষ। গ্রেপ্তার ও জামিনে থাকা মোট ৩৮ আসামিকে পরীক্ষা করা হয়।
২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। সর্বশেষ সোমবার আট আসামির পক্ষে আইনজীবীরা তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেন।
শুনানিতে জামায়াত আমির নিজামীকে আদালতে হাজির করা হয়, যুদ্ধাপরাধের মামলায় অভিযুক্ত তিনি।
‘জড়িত’ মন্ত্রী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা
ঘটনার পর করা মামলায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আসামি না থাকলেও অধিকতর তদন্তের পর যে ১১ জনকে আসামি করা হয় তাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী এবং সাবেক শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
এনএসআইয়ের সাবেক দুই প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার শাহাবুদ্দিন, সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন আসামির তালিকায় রয়েছেন।
আসামি রেজ্জাকুল হায়দারের আইনজীবী কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ সোমবার আদালতে বলেন, “বাংলাদেশ নির্ভর করে ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের ওপর।
“এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে এ মামলায় আলোচনা হয়েছে। তাই এগুলোর পরিবর্তন দরকার। এ বিষয়ে রায়ে আপনার নির্দেশনা চাই।”
সিইউএফএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এনামুল হকও দুই মামলায় আসামি।
এই আসামিদের মধ্যে নুরুল আমিন ও পরেশ বড়ুয়া পলাতক।
সোমবার শুনানিতে সম্পূরক অভিযোগপত্রভুক্ত ১১ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
‘উলফার জন্য আনা অস্ত্র’
অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, চোরাচালানের মাধ্যমে আসা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ চীনে তৈরি।
উদ্ধার করা অস্ত্রের মধ্যে ছিল এমএমটি-৫৬-১ মডেলের ৬৯০টি এসএমজি, এমএম-৫৬-২ মডেলের এসএমজি ৬০০টি, ৪০ এমএম রকেট লাঞ্চার ১৫০টি, ১০০টি টমিগান, ২ হাজার লাঞ্চিং গ্রেনেডসহ বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদ।
‘সরকার জড়িত ছিল, রাষ্ট্র নয়’
সোমবার শুনানির শুরুতে আসামি মহসীন উদ্দিন তালুকদারের আইনজীবী ফজলুল করিম ভুঁইয়া বলেন, তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিল না।
“আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে যেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র সম্পর্কে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বা বহির্বিশ্বের কাছে কোনো বিরূপ ধারণা সৃষ্টি না হয়। দেশকে বাঁচান, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব।”
সাবেক শিল্পমন্ত্রী নিজামীর আইনজীবী কফিল উদ্দিন বলেন, “এ মামলার বাদি যদি সরকার হয়, তাহলে আসামি কে?
“আমি (নিজামী) তো সরকারে ছিলাম। বৈধতা কাকে বলে? রাষ্ট্রের স্বীকৃতি মানেই তো বৈধতা। রাজনৈতিকভাবে ধ্বংস করার জন্যই আমাকে আসামি করা হয়েছে।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার ভারতের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করত। তাই উলফার জন্য অস্ত্র আনার সুযোগ তারা ব্যবহার করেছে।”
রায়ে সাবেক মন্ত্রীরা অভিযুক্ত হলে রাষ্ট্রের সুনাম ক্ষুন্ন হবে কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “দুজন মন্ত্রী আর কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাই রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্র আরো অনেক বড় বিষয়।
“তবে বলা যায়, সরকারের একটি অংশ এ কাজে জড়িত ছিল। ব্যক্তির অপরাধের দায় রাষ্ট্র নেবে কেন? কেউ ব্যক্তিগতভাবে অপরাধ করলে তার শাস্তি তাকে পেতে হবে।”