পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারের ১৪২টি ভবনকে ‘ঐতিহ্য’ ঘোষণার প্রতিবাদে প্রায় দুই হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী দুর্গাপূজা বর্জনের ঘোষণা দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে হেরিটেজ হলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই।
Published : 05 Sep 2013, 11:52 AM
পুরান ঢাকার ঐহিত্য রক্ষায় কাজ করে আসা এনজিও কর্মীরা বলছেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বার্থ রক্ষা করেই শাঁখারী বাজারকে ‘ঐহিত্য এলাকা’ হিসাবে গড়ে তোলার কথা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের দীর্ঘসূত্রতায় এ নিয়ে ‘ভুল বোঝাবুঝি ও জটিলতার’ সৃষ্টি হয়েছে।
আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবাসন নির্মাতা কিছু প্রতিষ্ঠান ‘উচ্ছেদের গুজব’ ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন গণপূর্ত বিভাগের এক কর্মকর্তা।
শাঁখারী বাজারের ১৪২টি ভবনকে ‘ঐতিহ্য’ ঘোষণা করায় পুরানো জরাজীর্ণ এসব ভবন মেরামত করতে পারছেন না মালিকরা। ভবন ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণেও আছে নিষেধাজ্ঞা। আর এর প্রতিবাদেই শারদীয় উৎসব বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
শাঁখারী বাজার ভূমি রক্ষা কমিটির আহবায়ক ঊর্ধ্ব দাশ বলেন, “এ বছর আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি পূজা করব না। বসত ভিটাই যদি না থাকে, তাহলে পূজা করে কি হবে। বরং পূজার দিন মণ্ডপে মণ্ডপে অনশন করব।”
এ সিদ্ধান্তের পেছনে ঊর্ধ্ব দাসের যুক্তি, কয়েক পুরুষ ধরে শাঁখারী বাজারে বসবাস করছেন তারা। কিন্তু যেখাবে তাদের ঘরবাড়ি ঐতিহ্য এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে নিজেদের ‘চিড়িয়াখানার জন্তু’ বলে মনে হচ্ছে তাদের।
‘সংখ্যালঘু বলে’ সরকার এ এলাকার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
অবশ্য গণপূর্ত বিভাগের প্রধান স্থপতি ও হেরিটেজ কমিটির সভাপতি আহসানুল হক খান বলছেন, হেরিটেজ ঘোষণা করায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষতি বা উচ্ছেদ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই, বরং তারা যাতে লাভবান হন- সেই চেষ্টাই সরকার করছে।
পূজা না করার সিদ্ধান্ত থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা যাতে সরে আসেন, সেই চেষ্টা করবেন বলেও জানিয়েছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। অনেকগুলো ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়, যার স্বাক্ষর এখনো বহন করছে শাঁখারী বাজার।
এ এলাকাটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ২০০৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ২০ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প চালু হয়। এর আওতায় শাঁখারী বাজারের ঝুকিপূর্ণ ভবনগুলোর সংস্কার এবং পয়নিষ্কাশনসহ আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা ছিলো। কিন্তু তা আর হয়নি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এ এলাকার প্রায় সবগুলো ভবন বসবাসের অনুপযুক্ত। একই বাড়ির বিভিন্ন কক্ষে গাদাগাদি করে বসবাস করছে বহু পরিবার। বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর।
সরু গলির পাশে ১১১ নম্বর বাড়ির পাঁচটি কক্ষে বর্তমানে বসবাস করছে ১০টি পরিবার। বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে আবর্জনার বিরাট এক স্তূপ; পাশে একটি ছোট ড্রেন, যার পুরোটাই বুঁজে আছে পলিথিন, শ্যাওলা ও মনুষ্যবর্জ্যে।
এ বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি, অশীতিপর শ্রীরাম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রায় পাঁচ পুরুষ ধরে এই বাড়িতে তাদের বসবাস।
“এখন যদি ভিটামাটি ছাড়তে হয়, তাহলে যাব কোথায়। আমাদের তো আর কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই।”
১০ নম্বর হোল্ডিংয়ের চারতলা বাড়িতেও গাদাগাদি করে বাস করছে অনেকগুলো পরিবার। অন্ধকার সরু করিডোর পেরিয়ে সংকীর্ণ সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় দেয়ালে হাত পড়লেই খসে পড়ে চুনকাম।
এ বাড়ির বাসিন্দা সুবাস নন্দী জানান, প্রায় ১২টি পরিবার এ বাড়ির বিভিন্ন তলায় বসবাস করছে।
“পুরো এলাকাটাকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হলো, কিন্তু আমাদের কি হবে?”
সুকণ্ঠ সেন, মিন্টু চক্রবর্তী, অনীল সেন, স্বপন নন্দী, দেবদাস নন্দী, সুকুমার সেন, ভোলা নাথ মজুমদার, লিটন দত্ত, মণি নন্দী ও পরিমল সেনের কণ্ঠেও ঝরলো একই ক্ষোভ।
শাঁখারী বাজার ভূমি রক্ষা কমিটির আহবায়ক ঊর্ধব দাস জানান, ২০০৯ সালে সরকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই এ এলাকাকে হেরিটেজ ঘোষণা করে।
“মানুষ বাড়ছে, এ ভবনগুলো এমনিতেই বসবাসের উপযোগী নয়। আমরা যদি সংস্কার করতে চাই তাহলে সরকার বাধা দিচ্ছে। আমরা কি করব?”
পুরান ঢাকার ঐহিত্য রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ‘আরবান স্টাডি গ্রুপ’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা।
এ সংস্থার তৈমুর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সরকারকে বলেছিলাম যেন লাইভলিহুড বজায় রেখে এ অঞ্চলে সংস্কার চালানো হয়। কিন্তু সরকারের দীর্ঘসূত্রতায় অনেকগুলো বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি ও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।”
পূজা না করার সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যদি সত্যিই তারা পূজা না করে, তবে তা হবে আমাদের সবার জন্য একটি বড় দুর্ঘটনা। এটা এড়াতে সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন বলেন, “যেহতু শাঁখারী বাজার অনেক পুরাতন একটি এলাকা তাই এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সংরক্ষণ করার জন্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে।”
এলাকাবাসীর দুর্গা পূজা না করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা উদযাপন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সার্বজনিন পূজা উদযাপন কমিটি। আমি তাদের সাথে কথা বলব, যেন এ ধরনের কিছু না হয়।”
গণপূর্ত বিভাগের হেরিটেজ কমিটির সভাপতি আহসানুল হক খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা সেখানে বসবাস করে তাদের ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমরা বরং চেষ্টা করছি যেন তারা লাভবান হন।”
তিনি জানান, হেরিটেজ ঘোষণা করায় স্থানীয় বাসিন্দারা নিজে থেকে কোনো ভবনের সংস্কার চালাতে পারবেন না বা পুরনো ভবন ভেঙে নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করতে পারবেন না। তবে কাউকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনাও সরকারের নেই।
“সেখানে যারা আছেন তাদের যদি উচ্ছেদ করে তো হেরিটজ ঘোষণা করার কোনো অর্থ নেই। তারা সেখানেই থাকবেন। সেই সাথে সরকার নিজেই আগের নকশা রক্ষা করে ভবনগুলো সংস্কার করে দেবে।”
আবাসন নির্মাতা কিছু কোম্পানি সুবিধা নেয়ার জন্য বাসিন্দাদের মধ্যে ‘উচ্ছেদের গুজব’ ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন এই সরকারি কর্মকর্তা।
ঐতিহ্য ঘোষণার ফলে শাঁখারী বাজারের বাসিন্দারা কি সুবিধা পাবেন জানতে চাইলে আহসানুল হক বলেন, “এটা নিয়ে আমরা কথা বলছি, তাদের সাথে কথা বলা চলছে। আমরা তাদের দাবিগুলো শুনবো। পরে সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”