ওপরে-নিচে ফটকে তালা আর জরুরি নিমর্গনে কোনো পথ না থাকায় আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাজরিন ফ্যাশনস পরিণত হয়েছিল মৃত্যুকূপে- স্থানীয়দের এই কথার যথার্থতা পাওয়া গেল আগুন নেভানোর পর ওই কারখানায় সরেজমিন ঘুরে, যেখানে একদিন আগেই পুড়ে অঙ্গার হন শতাধিক শ্রমিক।
Published : 26 Nov 2012, 06:13 PM
সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তুবা গ্রুপের এই কারখানা ভবনে শনিবার সন্ধ্যায় আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে অগ্নি সঙ্কেত বেজে উঠলেও বেরিয়ে আসার পথ রুদ্ধ পান শ্রমিকরা।
কেউ কেউ জানাল ভেঙে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েন। এভাবে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ খোয়ান নয়জন, যাদের লাশ ওই রাতেই উদ্ধার করা হয়। তবে এভাবে কেউ কেউ বেঁচেও যান।
গভীর রাতে আগুন নেভানোর পর রোববার সকালে যখন উদ্ধার অভিযান শুরু হয়, তখনি বের হতে থাকে একের পর এক দগ্ধ লাশ, সরকারি হিসাবে যে সংখ্যাটি ১১০ স্পর্শ করেছে।
দিনভর এত লাশ দেখার প্রতিক্রিয়ায় রাতে কারখানার প্রায় কাছের একটি দোকানে বসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহ আলম (২২) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “ওদের বাঁচার কোনো পথ খোলা রাখে নাই ভাই। আটকায়া পুড়ায়া মারছে।”
লাফিয়ে পড়ে বেঁচে যাওয়া কয়েকজন শ্রমিকও অভিযোগ করেছেন, আগুন লাগার সময় কারখানার কলাপসিবল গেইটে তালা থাকায় হতাহতের সংখ্যা এত বেড়েছে।
শ্রমিক মোহাম্মদ রিপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার সময় ফায়ার এলার্ম বেজে উঠে। তখন আমরা আগুন লেগেছে ভেবে নামতে গেলে কর্তৃপক্ষ বলে কিছু হয়নি। এলার্ম নষ্ট হয়ে গেছে।”
“ঠিক করে দিচ্ছি বলেই কলাপসিবল গেইটে তালা এঁটে দিয়ে কাজ করতে বলে শ্রমিকদের।”
ওই কারখানার পিওন কামরুল এ তালা লাগিয়ে দেয় বলে জানান আরেক শ্রমিক মো. স্বপন। ওপরে ওঠার সিঁড়ির কলাপসিবল গেইটেও তালা ছিল বলে শ্রমিকরা জানান।
আগুন নেভানোর পর মাংস পোড়া গন্ধের মধ্যে রোববার রাতে ওই কারখানার বিভিন্ন তলা ঘুরে দেখা যায়, পুরো ভবনে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা বা এই ধরনের কোনো সিঁড়ি নেই।
পুরুষ শ্রমিকদের ব্যবহার করা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দেখা যায়, সেখানে দশটি সারিতে একশর উপরে সেলাই মেশিন পুড়ে আছে। তৃতীয় তলার শুরুতে কিছু চুল এবং পোড়া মাংসখণ্ড পড়ে থাকতে দেখা যায়। সামনে এগিয়ে শেষ মাথায় নারী শ্রমিকদের ব্যবহৃত দুটি সিঁড়ির মুখে কলাপসিবল গেইটে তখনো তালা দেখা যায়। তালা লাগানো ছিল চতুর্থ তলার নারীদের দুটি সিঁড়িতেও।
পঞ্চম এবং ষষ্ঠ তলার দুপাশের সিঁড়ির মুখ খোলা পাওয়া যায়। সেখানে আগুন লাগার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। এই দুই তলায় আনুমানিক ৫০০ কার্টনে তৈরি শার্ট এবং হ্যাঙ্গার পুরোপুরি অক্ষত দেখা যায়।
ষষ্ঠ তলার বাম পাশের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠতেই দেখা গেল, ছাদের মাঝখানের বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে একটি নির্মাণাধীন কাঠামো। তারপরও পুরো ছাদে যতটুকু জায়গা রয়েছে, তাতে সেখানে কয়েকশ মানুষ এঁটে যেতে পারে অনায়াসে।
এ থেকে স্পষ্ট হয়, শ্রমিকরা নিচে নামতে না পারলেও যদি ছাদে উঠতে পারত, তবে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ তাদের যথেষ্টই ছিল, কারণ সেখান অব্দি আগুন পৌঁছেনি। কিন্তু ওপরে ওঠার সিঁড়িতে তালা তাদের বাঁচার সেই সুযোগ দেয়নি।
পোশাক কারখানায় এরকম তালা লাগানোর অভিযোগ বহু পুরনো। ২০০৬ সালে কেটিএস টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টসে আগুনের সময় তালা দেয়ার কথা আদালতে স্বীকারও করেছিলেন এর মালিকরা। কেটিএসে অগ্নিকা-ে নিহত হয়েছিল ৫৪ জন, যার ৪০ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল ফটকের সামনে।
সোমবারও সাভারের হেমায়েতপুরে একটি কারখানায় আগুন লাগলে বের হতে গিয়ে ফটতে তালা দেখতে পান শ্রমিকরা। ওই আগুন অবশ্য ছড়ায়নি।
কারখানাটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা হিসেবে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পাওয়া গেলেও সেগুলো ব্যবহারের কোনো নমুনা দেখা যায়নি, যদিও সেগুলো ছিল অক্ষত। এ থেকে স্পষ্ট, আগুন লাগলে কী করে এই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করতে হবে, তা ছিল প্রায় সবারই অজানা।
এছাড়া তুবা গ্রুপ তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করেছে, ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ফায়ার ফাইটার, উদ্ধারকর্মী ও প্রাথমিক চিকিৎসাকর্মী মিলিয়ে মোট ৩০০ জনের দল রয়েছে তাদের। কিন্তু তা আদৌ ছিল কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এই কারণে যে আগুন লাগার পর তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
বহুতল ভবনে জরুরি নির্গমণ পথ থাকাটা জরুরি হলেও তা ছিল না তাজরিনে, এরপর এই কারখানার কাজের পরিবেশ ভালো ছিল বলে দাবি করেছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
“এটি (তাজরিন ফ্যাশনস) একটি অত্যাধুনিক বড় কমপ্ল্যায়েন্ট কারখানা”- সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এই মন্তব্য করলেও তার আগেই জানা যায়, এই কারখানার কাজের পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ ছিল তাদের পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিশ্বখ্যাত ওয়াল-মার্টের।
নিশ্চিন্তপুর এলাকার বাসিন্দা আতাউর রহমান ক্ষোভের সঙ্গেই বললেন, “ফায়ার অ্যালার্ম বাজার ৫/৭ মিনিটের মধ্যে ফ্লোর খালি হয়ে যাওয়ার কথা। অ্যালার্ম যখন বাজছেই, তাইলে এত মানুষ ক্যামনে মরে? আর আগুন লাগলে বের হওয়ার জন্য যেই খানে আলাদা কোনো সিঁড়িই নাই, সেই কারখানা ক্যামনে অনুমোদন পায়?”
দেশের কারখানার ইতিহাসে ভয়াবহতম এই অগ্নিকাণ্ডের পর অবশ্য সরকারের যে টনক নড়েছে, তা স্পষ্ট শ্রমমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর কথায়। তিনি সোমবার বলেছেন, এখন থেকে আলাদা সিঁড়ি না রাখলে কারখানা বন্ধ করে দেয়া হবে।
তাজরিনের আগে গত এক যুগে পোশাক কারখানায় বেশ কয়েকটি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। বিজিএমইএ’র হিসাবে, ১৯৯০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে ২৭৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিক নেতারা বলছেন, শুধু ২০০০ সালের পর থেকেই সাড়ে ছয়শ’র বেশি শ্রমিক বিভিন্ন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন।
“কিন্তু এর একটি ঘটনাতেও মালিকপক্ষের কোনো সাজা হয়নি। যদি হত, তা হলে এই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটত না,” রোববার সক সভায় বলেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়কারী মাহাবুবুর রহমান ইসমাইল।