চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ঠেকাতে রাজধানীতে মশা নিধনের ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হলেও গত বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে যুক্ত হওয়া ১৬টি ইউনিয়ন পরিষদ এখনও রয়েছে এসবের বাইরে।
Published : 23 Jul 2017, 12:42 AM
ডোবা-নালায় ভরা ওই সব এলাকায় রয়েছে মশার উপদ্রব, পাওয়া যাচ্ছে অনেকের চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার খবর।
ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যানরা বলছেন, বরাদ্দ না থাকায় মশা নিধনে কিছু করতে পারছেন না তারা।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের তেজগাঁও সার্কেল কর্মকর্তা শাহনাজ সুলতানা বলেন, ওই সব এলাকায় মশা নিধনের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের।
অপরদিকে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কাগজে-কলমে এসব ইউনিয়ন সিটি করপোরেশনে যুক্ত হলেও এখনও অনেক প্রশাসনিক কার্যক্রম বাকি থাকায় তারা সেখানে মশা নিধনের কার্যক্রম চালাতে পারছেন না।
২০১৬ সালের ৯ জুন রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অনুমোদন পাওয়া ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) এসেছে বেরাইদ, বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও ডুমনী ইউনিয়ন।
সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করে গেজেট প্রকাশের এক বছরেও উন্নয়নকাজ শুরু না হওয়ায় এসব এলাকায় এখনও অনেক ডোবানালা। গড়ে ওঠেনি বর্জ্য অপসারণের কোনো ব্যবস্থা। ওই এলাকায় এখন ঘরে-বাইরে মশার উৎপাত।
১৫ দিন আগে জ্বরে আক্রান্ত হন দনিয়া ইউনিয়নের শেখদী এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. আলাউদ্দিন তালুকদার। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন তার চিকুনগুনিয়া।
আলাউদ্দিন তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জ্বর সেরে গেলেও শরীরের প্রচণ্ড ব্যথা এখনও ভোগাচ্ছে, বিশেষ করে পায়ের গোড়ালিতে। ঠিকমত দাঁড়াইতে পারি না, নামাজ পড়তে পারি না।”
অনেক দিন ধরে এলাকায় মশার উৎপাত হলেও তা নিধনে কোনো কার্যক্রম নেই বলে জানান তিনি।
মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে দনিয়ার দোলাইপাড় এলাকার সরাই মসজিদ গলির বাসিন্দা মোহাম্মদ উজ্জ্বলের নয় মাস বয়সী ছেলে আয়াতও।
উজ্জ্বল বলেন, “জ্বর হয়ে আর সারে না। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়া গেলে ডাক্তার জানাইছে চিকুনগুনিয়ায় হইছে। একটানা নয় দিন হাসপাতালে আছিলাম। ভাই, বাচ্চাটা কী কষ্ট করছে বুঝাইতে পারব না। সে তো বলতেও পারত না। খিঁচুনির চোটে হাত-পা বাঁকা হইয়া যাইত।”
ঢাকায় আসা এই ১৬টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১টি দুই সিটি করপোরেশনের আগের সীমানা সংলগ্ন।
এর মধ্যে উত্তরার ১৩, ১৪, ১১ নম্বর সেক্টরের পাশে অবস্থান হরিরামপুর ইউনিয়নের। উত্তরা, বিমানবন্দর এলাকার পূর্ব দিকে উত্তরখান আর দক্ষিণখান ইউনিয়ন। জগন্নাথপুর, নর্দ্দা, বারিধারার সঙ্গে লেগে আছে ভাটারা ইউনিয়ন। শাহজাদপুর আর বাড্ডা এলাকার সঙ্গে বাড্ডা ইউনিয়নের দূরত্ব মাঝের প্রগতি সরণি।
বাড্ডা ইউনিয়নের আবদুল্লাহবাগ এলাকার বাসিন্দা মিল্লাত হোসেন বলেন, মশার উৎপাতে বিকাল হওয়ার আগেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেন তারা।
“এলাকায় বার মাসই মশার উৎপাত থাকে। মশা নিধনে কোনো ব্যবস্থা নাই। এ এলাকায় মশার কয়েল, স্প্রের বিক্রি বেশি।”
হরিরামপুর ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকার নিচু ডোবানালা ‘মশার কারখানা’ বলে মন্তব্য করেন সেখানকার চেয়ারম্যান আবুল হাসেম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মশার উৎপাতে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হলেও কিছু করতে পারছি না। লোকজন আমার কাছে এসে বলে, চিকুনগুনিয়া হইতাছে। কিন্তু আমার কিছু করার নাই।”
সিটি করপোরেশনে অন্তর্ভুক্ত হলেও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর কার্যক্রম এখনও বিলুপ্ত হয়নি। তাদের হাতে টিআর, কাবিখা কর্মসূচি থাকলেও মশা নিধনের বরাদ্দ নেই বলে জানান চেয়ারম্যানরা।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বারিধারার গা-ঘেঁষা ভাটারায় মশার উপদ্রব ‘ভয়াবহ’ বলে জানান চেয়ারম্যান আতাউর রহমান।
তিনি বলেন, মশা নিধনের বিষয়ে তারা অসহায়। পরামর্শ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা শাহনাজ সুলতানা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের হাতে এ ব্যাপারে কোনো বরাদ্দ নেই। আমরা চিঠি দিচ্ছি চেয়ারম্যানদের কাছে, তারা যেন এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের সাহায্য চায়। আজকেই (বৃহস্পতিবার) এ চিঠি দেওয়া হবে। ডিসি মহোদয় আমাকে বলেছেন, মশক নিধনে যেন সিটি করপোরেশনের সাহায্য চাওয়া হয়।”
শহর লাগোয়া এসব ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় মশা জন্মানোর পরিবেশ রাজধানীর মতোই বলে মন্তব্য করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ উদ্দীন আহমেদ।
ওই সব এলাকার ডোবা-নালায় জন্মানো কিউলেক্স মশা উড়ে রাজধানীতে চলে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ডা. তৌহিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এসব মশা দেড় মাইল পর্যন্ত উড়তে পারে। সেক্ষেত্রে উত্তরখান, দক্ষিণ খান, বাড্ডা, মাণ্ডা, মাতুয়াইল, দনিয়া এলাকার মশা সহজেই ঢাকা শহরে চলে আসতে পারে। এ মশা থেকে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া হয় না। তবে এটা কামড়ায়, বিরক্তি উৎপাদন করে।”
কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকায় ইউনিয়নগুলোয় চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেলে তা সহজে কমবে না বলে মনে করেন এই চিকিৎসা কীটতত্ত্ববিদ।
“সেসব এলাকার লোকজন নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি যা নেওয়ার তা নিশ্চয়ই নিচ্ছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের অ্যাক্টিভিটি না থাকায় ওই সব এলাকায় রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। ছড়িয়ে পড়লে তা অতটা সহজে নাও কমতে পারে, কারণ সেখানে ঢাকার মতো কার্যক্রম নেই।”
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে রাজধানীর পাশাপাশি এসব ইউনিয়নে মশা নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে আমরা বাড্ডা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, শনিরআখড়া এসব এলাকাকে ‘বেরিয়ার’ বলছি।
“সে কারণে ওই সব এলাকা থেকে যেন রোগটি ঢাকায় না আসে, সেজন্য সেখানেও কন্ট্রোল প্রোগ্রাম নেওয়া উচিত। ওই এলাকাগুলোকে বাফার জোন ধরে নিয়ে সেখানে মশক নিধন কার্যক্রম চালানো উচিত।”
তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এখনও দায়িত্ব পুরোপুরি বুঝে না পাওয়ায় সেখানে কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
আর উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএমএম সালেহ ভূঁইয়া বলেন, “ইউনিয়নগুলো সিটি করপোরেশনের আওতায় কাগজে-কলমে আসলেও এখনও অনেক কাজ বাকি।
“এখনও মন্ত্রণালয়ে অনেক আনুষ্ঠানিকতা বাকি আছে। যে কারণে ইউনিয়নগুলোয় মশা নিধন কার্যক্রম চালানো সম্ভব হচ্ছে না।”
মশা নিধনে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহায়তা চাইলে তা করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিঠি পাঠালে তখন দেখা যাবে কী করা যায়।
“আমি তো আর সিদ্ধান্ত দিতে পারব না। ব্যাপারটা আমার চাওয়া-না চাওয়ার ওপর নির্ভরশীল না। দাপ্তরিক ব্যাপার আছে। অফিসে চিঠি আসলে হয়ত আমাদের ফরমালি বলবে। তখন হয়ত আমরা এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারব।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনও বলছেন, ইউনিয়নগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো এখনও পুরোপুরি সিটি করপোরেশনের আওতায় না আসায় সেখানে কাজ করা যাচ্ছে না।
তবে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন বা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা সহায়তা চাইলে তা করার আশ্বাস দেন তিনি।
“আমাদের যদি এ ব্যাপারে অফিসিয়ালি চিঠি দেয় যে তারা হেল্প চায়, আমরা অবশ্যই হেল্প করব। তারা যদি বলে যে তাদের মেশিন, ওষুধ কিংবা লোকবল দরকার। আমরা সেগুলো পৌঁছে দেব অবশ্যই।”