নকশাতেই থমকে ‘নজরুল ভবন’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধানমণ্ডির যে বাড়িতে থাকতেন, সেখানে গড়ে ওঠা নজরুল ইনস্টিটিউটের সম্প্রসারণ করে ‘নজরুল ভবন’ নির্মাণের ঘোষণা এসেছিল গত বছর; কিন্তু সে প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে আছে নকশাতেই।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2017, 04:37 AM
Updated : 25 May 2017, 04:37 AM

নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ বলছে, ছয় মাস আগে তাদের তৈরি নকশাটি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলেও চলতি বছর তা আলোর মুখ দেখার আশা কম।

গত বছরের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই নকশা উপস্থাপন করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব ও ইসতিয়াক জহির। সে সময় তারা জানিয়েছিলেন, ধানমণ্ডির পুরাতন ২৮ নম্বরে কবি নজরুলের বাসভবনের জায়গায় আটতলা ‘নজরুল ভবন’ হবে। সেখানে থাকবে বিশেষায়িত লাইব্রেরি, ডরমিটরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। আর নজরুল ইনস্টিটিউটটের পাঁচতলা ভবনটি ছয়তলা করা হবে।

নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকল্পটি আমরা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে নিরীক্ষার জন্য জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু তা এখনও পাস হয়ে আসেনি। এ বছর আর এই ভবন হবে না।”

এছাড়া নজরুল ইনস্টিটিউটের পাশে ধানমণ্ডি লেকের একাংশে ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘নজরুল সরোবর’ করার পরিকল্পনাও থমকে আছে। এর কাজ আদৌ শুরু হবে কি না- তা বলতে পারেননি নির্বাহী পরিচালক।

ঢাকার বাইরে হচ্ছে ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’

নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক জানান, নজরুল গবেষণা ও চর্চার প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে সারা দেশে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম ও চুয়াডাঙ্গায় দুটি স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রামে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র গড়ে তুলতে ইতোমধ্যে নগরীর খুলশীতে ৩০ শতাংশ জমি নির্বাচন করা হয়েছে। সেখানে ‘দ্রুত গতিতে’ কাজ চলছে বলে জানান রাজ্জাক।

আর চুয়াডাঙ্গার নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রটি হবে শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গার মিশনপাড়ায়। জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে সেখানে ৬৬ শতাংশ জমি দিয়েছে।

পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গায় হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের আটচালা ঘরটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ১৯২০ এর দশকের শেষভাগে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সপরিবারে প্রায় দুই মাস সেখানে ছিলেন নজরুল।

এ দুটি স্মৃতিকেন্দ্রকে নজরুল গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সেখানে গান ও আবৃত্তি শেখানোর ব্যবস্থার পাশাপাশি গবেষণার জন্য থাকবে লাইব্রেরি, সেমিনার হল ও রেস্টহাউস। অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য থাকবে মিলনায়তন। থাকবে জাদুঘর।

কবির স্মৃতিবিজড়িত ফরিদপুর, যশোর ও মানিকগঞ্জেও পর্যায়ক্রমে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, মানিকগঞ্জের তেওতা গ্রামে জমি অধিগ্রহণের কাজ এখন ‘প্রাথমিক পর্যায়ে’ রয়েছে। 

নজরুল ইনস্টিটিউটের অধীনে ময়মনসিংহের ত্রিশালের বিচুলিয়া বেপারিবাড়ি ও কাজীর শিমলার দারোগাবাড়িতে দুটি এবং কুমিল্লায় একটি স্মৃতিকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলোতে জাদুঘর, লাইব্রেরি, সেমিনার হল, মিলনায়তন, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও রেস্টহাউস রয়েছে।

কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে একটি সরকারি স্থাপনা নির্মাণের দাবি থাকলেও তা নাকচ করে দিয়েছেন নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বলেন, “কোথাও কোনো স্থাপনা করার আগে আমরা সেখানকার শিক্ষার্থী, পাঠদানের পরিবেশ ও সাহিত্যচর্চার দিকটি বিবেচনায় রাখি। দৌলতপুরে এমন কিছু পাইনি আমরা। সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণের চিন্তা আপাতত নেই।”

গতি পেয়েছে গবেষণা ও প্রকাশনা খাত

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য জীবন, সাহিত্য, সংগীত ও সামগ্রিক অবদান নিয়ে চার শতাধিক বই ও ৪৯টি সিডি প্রকাশ করেছে নজরুল ইন্সটিটিউট।

নজরুলের কাব্যগ্রন্থ, সংগীতগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং নজরুল-বিষয়ক গবেষণাগ্রন্থ, নজরুল-সংগীত স্বরলিপি গ্রন্থ, পত্রিকা, জার্নাল, বক্তৃতামালা, অ্যালবাম, পোস্টারসহ বিভিন্ন প্রকাশনা নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছে এই প্রতিষ্ঠান।

নজরুলের প্রবন্ধ সংগ্রহের ইংরেজি অনুবাদ করছেন নাশিদ কামাল।  প্রবন্ধটি বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় অনুবাদেরও পরিকল্পনা রয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউটের।

আদি গ্রামোফোন রেকর্ডে ধারণ করা নজরুল সংগীতের বাণী ও সুর অনুযায়ী স্বরলিপি প্রমাণীকরণের জন্য সরকার ‘নজরুল সংগীত স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদ’ গঠন করেছে। ইতোমধ্যে নজরুল সংগীত স্বরলিপির ৩৭টি খণ্ডে (প্রতি খণ্ডে ২৫টি করে) ১৬০০ শুদ্ধ নজরুল সংগীতের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে।

নজরুল ইনস্টিটিউট আরও তিন হাজার গান সংগ্রহের চেষ্টা করছে বলে নির্বাহী পরিচালক জানান।

প্রবীণ নজরুলসংগীতশিল্পী খালিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে শুনে নজরুল সংগীতের স্বরলিপি প্রণয়ণের কাজটি মোটেই সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবি নজরুল এত সময় পাননি যে তার গানগুলোর স্বরলিপি লিখে যাবেন। তাই যে যার মত ইচ্ছা ‍সুর দিয়ে নজরুল সংগীত গাইছে। এটাকে রোধ করতেই স্বরলিপি প্রণয়ন করতে হবে আমাদের।”

নজরুলজয়ন্তীর আয়োজন

জীবনে যত বৈচিত্র্য, পরিচয়েও তত বিশেষণ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম; সারা দেশে নানা আয়োজনে কবির ১১৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে বৃহস্পতিবার।

১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা ভাষার কবিতাপ্রেমিদের কাছে তিনি প্রেমের কবি, চির যৌবনের দূত; সেইসঙ্গে তিনি বিদ্রোহী, গৃহত্যাগী বাউণ্ডুলে।

বৈচিত্রময় জীবনের অধিকারী নজরুল ছেলেবেলায় পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘দুখু মিয়া’ নামে। পিতৃহীন কবি একে একে হারিয়েছেন কাছের স্বজনদের। আর্থিক অসচ্ছলতাও তার জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল। 

সব বাধা অতিক্রম করে একসময় তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন। সাম্য ও মানবতার চেতনায় সমৃদ্ধ ছিল তার লেখনী। কবিতায় বিদ্রোহী সুরের জন্য হয়ে ওঠেন ‘বিদ্রোহী কবি’।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কবি নজরুল ইসলামের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে এবারের নজরুলজয়ন্তীর সূচনা হয়।

কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান বিকালে, ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন জাতীয় কবির পৌত্রী খিলখিল কাজী।

জাতীয় কবির ১১৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী সৈনিক নজরুল’। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে স্মারক বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর।

আলোচনার পর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও নজরুল ইন্সটিটিউটের আয়োজনে ৩০ মিনিটের একটি সাংস্কৃতিক পর্ব থাকবে।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে নজরুল ইনস্টিটিউটের নজরুল জন্মজয়ন্তীর আয়োজনে প্রধান অতিথি থাকবেন এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আলোচক হিসেবে থাকবেন আর্টস ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।

এছড়া ময়মনসিংহের ত্রিশাল, কুমিল্লার দৌলতপুর ও চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় নজরুলজয়ন্তীর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।