সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কেন: প্রধান বিচারপতি

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, যেই সংসদ সদস্যদের উপর তার দলই আস্থা রাখতে পারছে না, তাদের উপর বিচারকদের অপসারণের ভার দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2017, 03:16 PM
Updated : 23 May 2017, 04:07 PM

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানির এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কাছে এই প্রশ্ন রাখেন প্রধান বিচারপতি।

আগের মতো মঙ্গলবারও শুনানিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বাহাস চলে; শুনানির শেষ পর্যায়ে ক্ষুব্ধও হয়ে ওঠেন বিচারপতি সিনহা।

এই আপিলের পঞ্চম দিনের শুনানির শুরুতেই মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, অধস্তন বিচার বিভাগ ‘কব্জা করে’ নিচ্ছেন। এখন চাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে নিতে। অধস্তন আদালতের ৮০ ভাগ বিচারকের উপর কার্যত সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ নেই। সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত ‘পঙ্গু হয়ে গেছে’।

“একটা জেলায় ৫ মাস ধরে জেলা জজ নেই। বিচার বিভাগ কি রকম কার্যকর আছে? জেলা জজ না থাকলে বিচার বিভাগ কার্যকর হবে কি না? উচ্চ আদালতের বিষয়টি সংসদে নিয়ে গেলেন। তাহলে আর কী থাকল?”

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছর হাই কোর্ট ওই সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেয়।

সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমেরিকার সংবিধান কতবার টাচ হয়েছে জানেন?”

জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, বিচার বিভাগ তখনই অকার্যকর হয়ে পড়বে যখন দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু এখনও সে পর্যায়ে নেই দেশ।

“আমেরিকার মূল সংবিধান পরিবর্তন করা হয়নি, সংযুক্ত হয়েছে। আমাদেরও দোষ আছে। আমরা মূল সংবিধান সংশোধন করেছি, তা না করে সংযুক্ত করা যেত।”

প্রধান বিচারপতির কথার আপত্তি তুলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “বিচার বিভাগ বলতে পারে না যে মূল সংবিধানের এই ব্যবস্থা ঠিক না। শুধু সংশোধনী সম্পর্কে বলতে পারে। এ মামলায় (ষোড়শ সংশোধনী মামলা-যেটির শুনানি চলছে) হাই কোর্টের রায়ে কিছু মন্তব্য রূঢ় হয়ে গেছে। আশা করি এগুলো বাদ দেবেন।”

প্রত্যুত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, “সব সময় সংবিধান বাঁচিয়ে রেখেই রায় দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি বাক্য, সেমিকোলনের ব্যাপারে বিচারকদের সঙ্গে আলোচনা করেই রায় দিই।

“আমরা সংবিধান মাথায় রেখেই রায় দেব। আপত্তিকর কিছু থাকলে সেটা বিবেচনা করা হবে। একটি গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে, একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা করে রায় দিতে হয়।”

নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সাম্প্রতিক পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে বিচারপতি সিনহা বলেন, “মন্ত্রী সাহেবরা অনেক কথা বলেন, যা আমরা হজম করছি, করতে পারি। আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে যা বলি, তা বিচার বিভাগের জন্যই বলি।

“আইনমন্ত্রী বলে থাকেন যে বিচার বিভাগ স্বাধীন, বিচারকদের বেতন বেড়েছে। বেতন বাড়লেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যায়? আপনাদের (মন্ত্রীদের) বেড়েছে এক বছর আগে, আমাদের একবছর পর।”

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা তো সামরিক আইন জারির মাধ্যমে প্রবর্তন করা হয়েছে। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, ১৯৭২ এর মূল চেতনায় ফিরে যেতেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।

জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়, যা বাতিল হয় ষোড়শ সংশোধনীতে।

বিচারপতিদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে দাবি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, “এ আইন ক’দিন পর তো সংশোধন হতে পারে। তাছাড়া এ মামলা বিচারাধীন থাকাবস্থায় আপনারা তাড়াহুড়ো করে আইনের খসড়া করেছেন। প্রধান বিচারপতি আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে আইন না করার জন্য বললেন। কিন্তু তা মানলেন না। এখানে তাড়াহুড়োর কী ছিল? সুপ্রিম কোর্ট তো সরকারকে শেষ করে দিচ্ছে না।”

অ্যাটর্নি জেনারেল তখন বলেন, সামরিক আইনের কলঙ্ক মুছে ফেলার জন্যই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে।

প্রধান বিচাপরতি বলেন, “সামরিক আইনের কলঙ্ক মুছে ফেলতে একমাত্র বিচার বিভাগ ভূমিকা রেখেছে।”

এ পর্যায়ে শুনানিতে উপস্থিত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা দাঁড়িয়ে বলেন, “একজন প্রধান বিচারপতিও শপথ ভঙ্গ করে সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন, সংবিধান স্থগিত করেছিলেন।”

প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, “ওই সময় তো অনেক কিছুই হয়েছে, যা এখন আপনারাও সংরক্ষণ করছেন।”

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (ফাইল ছবি)

দীর্ঘক্ষণ এই ধরনের বাক্যালাপের পর নিয়মিত শুনানিতে যান অ্যাটর্নি জেনারেল। তারই এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, “সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখেছেন কেন?”

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এর একটি ইতিহাস আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হর্স ট্রেডিং হচ্ছে।”

বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী রূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন কিংবা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার আসন শূন্য হয়ে যাবে।

এই বিধানকে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অন্তরায় হিসেবে দেখছেন অনেকেই।

শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, “তাদের (সংসদ সদস্য) প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? তাহলে বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আপনারা নিজ দলের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না কেন?”

এনিয়ে কিছুক্ষণ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পর এই মামলাটিতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের রিট আবেদন করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

এসময় আপিল বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, “এ যুক্তি ঠিক না। যারা এসেছেন (এ মামলার রিটকারী আইনজীবী) তারা অপরিচিত আইনজীবী না। তারা এ বারেরই (আইনজীবী সমিতি) সদস্য। বিচার বিভাগে মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে তারা এটা করতেই পারেন। এটা কি দোষ হয়ে গেল?”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “তাদের রিট করার এখতিয়ার আছে। আপনি বলছেন, তাদের এখতিয়ার নেই। তাহলে কি আমি নিজে রিট করব?”

এসময় তিনি ভারতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত এক রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সেখানকার বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।

অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম (ফাইল ছবি)

শুনানির শেষ পর্যায়ে মাহবুবে আলম বলেন, হাই কোর্টের রায়ে একজন বিচারপতি অধিকাংশ সংসদ সদস্যের‘ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড’ থাকার কথা বলেছেন। এটা যদি সত্য হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, আর যদি সত্য না হয় তবে রাষ্ট্রপতির উচিৎ ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, “আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি কি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন?”

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই, আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন।”

সংবিধান সংশোধনের পর অপসারণের প্রক্রিয়া ঠিক করে তৈরি একটি আইনের খসড়ায় মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিলেও হাই কোর্টের রায়ের পর তা ঝুলে যায়।

অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রধান বিচারপতি বললেন, “এটা কি বললেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে সরিয়ে দেবেন? কত হাজার বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছেন? বিচার বিভাগকে কী মনে করছেন?”

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এটা আমার অভিমত। আপনারা বিষয়টি রায়ে বলে দিতে পারেন।”

এরপর প্রধান বিচারপতি হঠাৎ আসনে ছেড়ে এজলাস ছাড়তে উদ্যত হলে বেঞ্চের অন্য ছয়জন বিচারপতিও এজলাস ত্যাগ করেন।

তখন ঘড়িতে সময় বেলা সোয়া ১টা; অর্থাৎ বেঞ্চের কার্যসময় ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে।

পরে দেখা যায়, বুধবার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় মামলাটি রয়েছে; অর্থাৎ বুধবারও এর শুনানি চলবে।