মুফতি হান্নান: আফগান থেকে ফিরে বাংলাদেশে জঙ্গির কারিগর

যশোরে উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যতগুলো বড় ধরনের জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগেরই নেতৃত্ব দেওয়া মুফতি আব্দুল হান্নানের যবনিকা ঘটল ফাঁসিকাষ্ঠে।

মনোজ সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2017, 04:09 PM
Updated : 12 April 2017, 04:09 PM

২০০৪ সালে সিলেটে শাহজালালের মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলায় তিনজন নিহতের ঘটনায় দুই সহযোগীসহ ফাঁসিতে ঝুললেন তিনি। রমনায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলায়ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) এই শীর্ষ নেতা।

আফগানফেরত যেসব মুজাহিদ বাংলাদেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ড শুরু করেছিল, তাদের একজন হান্নান। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা, ২০০১ সালে পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা এবং ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায়ও তিনি জড়িত ছিলেন বলে তদন্ত উঠে এসেছে।      

১৯৯৬ সালে যশোরে উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলায় নিহত হন ১০ জন, ওই হামলার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন মুফতি হান্নান

এছাড়া ২০০৫ সালে মৌলভীবাজারে সমাবেশে বোমা হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজনকে হত্যা এবং তার আগের বছর সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলার পিছনেও তার হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রামের স্বাধীনতাবিরোধী নূর উদ্দিন মুন্সির ছেলে হান্নানের জঙ্গি তৎপরতা প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০০০ সালে শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে রাখার ঘটনা ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে। ওই বছর ২২ জুলাই উপজেলা সদরের শেখ লুৎফর রহমান কলেজ মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভা ছিল। দুদিন আগে সভাস্থল থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি এবং ২৪ জুলাই হ্যালিপ্যাডের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের আরও একটি দূর নিয়ন্ত্রিত বোমা উদ্ধার করে পুলিশ।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিরণ গ্রামে মুফতি হান্নানের বাড়ি

এরপর গোপালগঞ্জ জেলা শহরে হান্নানের ‘সাবান তৈরির কারখানায়’ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। পালিয়ে যান মুফতি হান্নান, ধরা পড়েন  ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডার একটি বাসা থেকে। এর মাঝে ঘটে যাওয়া একের পর এক বোমা হামলায় প্রাণহানি হয় শতাধিক মানুষের, আহত হন কয়েকশ, যার বেশিরভাগেরই পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় থাকার কথা স্বীকার করেছেন মুফতি হান্নান নিজেই ।

হান্নান নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য। সিআইডির অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক আব্দুল কাহার আকন্দের ভাষ্যমতে, সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হান্নান দেশে বিভিন্ন জঙ্গি হামলার প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন। বোমা বানানোয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি।

হান্নান প্রথমে দেশি বোমা ব্যবহার করলেও পরে ‘পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড’ সংগ্রহ করেন বলে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলায় নিহত হন পাঁচজন

যেভাবে শুরু

কোটালীপাড়ার হিরণ গ্রামের বাসিন্দারা জানান, হান্নানের বাবা মৃত নূর উদ্দিন ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।

সে কারণে যুদ্ধ চলাকালেই মুক্তিযোদ্ধারা নূর উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ মুন্সী জানান।

নূর উদ্দিনের ছয় ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে আব্দুল হান্নান মুন্সী ছিলেন দ্বিতীয়। তার জন্মতারিখ জানাতে পারেননি ছোট ভাই মুন্সী কামরুজ্জামান মতিন। হান্নানের মাদ্রাসার সনদেও জন্মতারিখ উল্লেখ নেই বলে জানান তিনি।

মতিন জানান, গ্রামের দক্ষিণ হিরণ মাদ্রাসায় পাড়াশোনার মধ্য দিয়ে হান্নানের শিক্ষা জীবনের শুরু। এরপর টুঙ্গীপাড়ার গওহরডাঙ্গা এবং বরিশালের শর্ষিনা মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। পরে তিনি ভারতের বিহারের দেওবন্দ মাদ্রাসা এবং পাকিস্তানের করাচির নিউ টাউন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন।

২০০১ সালে রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা মেরে হত্যা করা হয় ১০ জনকে, এই মামলায়ও মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল মুফতি হান্নানের

মুফতি হান্নানের জবানবন্দির বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দেওবন্দে দাওরা হাদিস পড়াকালে ১৯৮৭ সালে ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করেন তিনি। এরপর ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানে গিয়ে করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নূরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহশাস্ত্রে ভর্তি হন৷ সেখান থেকে সীমান্তবর্তী শহর খোস্তে মুজাহিদ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি। ওই যুদ্ধে আহত হয়ে পাকিস্তানের একটি হাসাপাতালে ১০ মাস চিকিৎসা নেন।

এরপর মাদ্রাসার লেখাপড়া শেষ করে ১৯৯৩ সালের দিকে দেশে ফিরে হান্নান ব্যবসা শুরু করেন বলে এলাকাবাসী ও তার স্বজনরা জানান। গোপালগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরীতে ‘সোনার বাংলা সাবান ফ্যাক্টরি’ গড়ে তোলেন। পাশাপাশি কোটালীপাড়ার ঘাঘরকান্দা গ্রামে একটি ক্যাডেট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

ওই সময় পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়ে তৎপরতা শুরু করেন হান্নান। তার আফগানফেরত মুজাহিদদের গড়ে তোলা হুজি-বি তে যোগ দিয়ে কোটালীপাড়া উপজেলা শাখার প্রচার সম্পাদক হন তিনি। ঘাঘরকান্দা গ্রামের ক্যাডেট মাদ্রাসায় চলতে থাকে তার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে হুজির কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচিত হন তিনি।

যত হামলা

বাংলাদেশে হুজির নাশকতার শুরু ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা চালিয়ে ১০ জনকে জনকে হত্যার মধ্য দিয়ে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তে মুফতি আবদুর রউফ ও তার পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ হামলা হয় বলে হান্নান জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।

২০০৪ সালের একুশে অগাস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় সম্পৃক্ততার কথা জবানবন্দিতে স্বীকার করেন হুজি নেতা হান্নান

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আমলে এ হামলায় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, যাতে আড়ালে থেকে যায় জঙ্গিরা। এরপর ওই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় আটজন নিহত হন।

২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থল থেকে বোমা উদ্ধার,  ২০০১ সালে পল্টনে সিপিবির সমাবেশে এবং রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়।

এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ শতাধিক ব্যক্তি।

এর আগে ওই বছরের ২১ মে সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর এবং ৭ আগস্ট সিলেটের মেয়র কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা হয়।

পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বশেষ গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়ার সমাবেশে।

স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে কোটালীপাড়ার হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুন্সী ইবাদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মুফতি হান্নান গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্ন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩টি জঙ্গি হামলা চালান, যাতে ১০১ জন নিহত এবং ৬০০ মানুষ আহত হন। এসব ঘটনায় মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে মোট ১৭টি মামলা দায়ের করা হয়।

মুফতি হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভীন রুমা বেগম স্বামীর সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তিনি জানান, তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। মেয়েদের নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মেয়েরা গ্রামের মহিলা মাদ্রাসায় পড়ে। বড় ছেলে যশোরের একটি কলেজে এবং ছোট ছেলে ঢাকায় একটি মাদ্রসায় পড়ছে।

হান্নানের মা বাবেয়া বেগম বলেন, “আমার জানামতে, আমার ছেলে ইসলামের পথে ছিল। সে কী কর্মকাণ্ড করেছে তা আমি জানি না। আমার সামনে সে কখনো কোনো অন্যায় কাজ করেনি।

“সে সরকারের কাছে অপরাধী। সরকার তাকে শাস্তি দিয়েছে, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার পরিবারের নিরপরাধ মানুষগুলোকে যেন সরকার হয়রানি না করে।”