কুমিল্লার কোটবাড়ীতে তিন দিন ধরে ঘিরে রাখা বাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর ভেতরে বেশ কিছু বিস্ফোরক দেখা গেলেও সন্দেহভাজন জঙ্গিদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
Published : 31 Mar 2017, 05:02 PM
সম্ভাব্য জঙ্গিদের ধরতে পুলিশ যে গ্যাস দিয়েছিল, তার ঝাঁঝ না কমায় অভিযান শনিবার ভোর ৬টা পর্যন্ত অভিযান স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম।
দুদিন আগে কোটবাড়ীর দক্ষিণ বাগমারা বড় কবরস্থানের পাশে ওই তিনতলা বাড়ি ঘিরে ফেলার পর শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে সোয়াট ও পুলিশ সদস্যরা শুরু করেন চূড়ান্ত অভিযান, যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’।
এরপর সন্ধ্যায় কুমিল্লা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি শফিকুল ইসলাম অভিযান স্থগিত করার কথা বলেন।
তিনি বলেন, “বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব হয় নাই। বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, রুমের ভেতরে গ্যাসের ঝাঁঝের তীব্রতা আছে। সেটার জন্য আমাদের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট ভেতরে যাওয়ার পরও তাকায় থাকতে পারছে না। পরে ওরা রুম থেকে বের হয়ে এসেছে।”
ভেতরে জঙ্গিদের কাউকে না পেলেও বোমা ও সুইসাইড ভেস্ট থাকার কথা জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সকালে বোমাগুলো ভেতরেই নিষ্ক্রিয় করতে হবে। তারপর হয়ত সাংবাদিকদের ছবি নেওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মিরসরাই থেকে গ্রেপ্তার দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কুমিল্লার ওই বাড়িতে বিস্ফোরক থাকার তথ্য পায় পুলিশ।
“তারা ওখান থেকে যে যে জিনিস দিয়ে পাঠিয়েছে, সেটা হল ট্রলি ব্যাগের ভেতরে পাঁচ কেজি ওজনের করে দুটি বড় আকারের বোমা, চারটি স্থানীয়ভাবে বানানো হ্যান্ড গ্রেনেড এবং দুইটা সুইসাইড ভেস্ট। এগুলোসহ দুই জঙ্গি এখানে এসে আশ্রয় নেয়,” বলেন ডিআইজি।
অভিযানের বিবরণ তিনি বলেন, প্রথমে ঘরের জানালা ভেঙে ভেতরে গ্যাস পাঠানো হয়, যাতে ভেতরে কেউ থাকলে অচেতন হয়ে পড়ে। এরপর দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তিন তলার ছাদে ওঠেন। ছাদ ফুটো করে প্রথমে দোতলায়, তারপর একইভাবে নিচে নামেন তারা।
“যে জঙ্গির জন্য আমরা চেষ্টা করেছিলাম, তাকে ভেতরে পাওয়া যায় নাই। তবে বোমা ও বিস্ফোরক থাকার যে তথ্য পেয়েছিলাম, সেগুলো ছিল।”
ডিআইজি জানান, যে ফ্ল্যাটে ওই জঙ্গিরা থাকতেন, তাতে তিনটি ঘর। এর মধ্যে একটি কক্ষে তিনজন ছাত্র থাকতেন, আরেকটি ঘরে থাকতেন দুই জঙ্গি।
কীভাবে জঙ্গিরা ‘পালিয়েছে’ সে প্রশ্নে তিনি বলেন, জঙ্গি আস্তানার তথ্য পাওয়ার পর ঢাকা থেকে পুলিশের ‘এলআইসি টিম’ এসে বাড়িটি চিহ্নিত করতে করতে বুধবার বিকাল ৪টা বেজে গিয়েছিল। পরে তারা বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলেন।
দেলোয়ার পুলিশকে জানান, ওইদিন সকাল ১০টায় তিনি যখন বাড়ি থেকে বের হন, তখনও ওই বাসায় একজন ‘ঘুমন্ত অবস্থায়’ ছিল। পরে বাড়ি চিহ্নিত হলে বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ওই বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়। এই দীর্ঘ সময়ে সেই ‘জঙ্গি’ বাইরে গিয়ে থাকতে পারে।
এক্ষেত্রে জঙ্গিরা ‘নিজস্ব কৌশলও’ ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে এই পুলিশ কর্মকর্তার ধারণা।
“তাদের একজন যখন বাইরে যায় তখন সে হয়ত কাট-আপ টাইম দিয়ে যায়। সে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে না ফিরলে অন্যজনের বাসায় থাকা নিরাপদ হবে না- এরকম। আমরা মনে করছি, যে ছেলেটা আগে চলে গেছে, সে খুব সম্ভব পুলিশের উপস্থিতি দেখে বাসার ভেতরে আর আসেনি। সে যখন ফিরল না, তখন যে ঘুমে ছিল সে ওই কৌশল অনুযায়ী সরে গেছে।”
গত ১৫ মার্চ সীতাকুণ্ড থেকে গ্রেপ্তার দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাদের কাছ থেকে পাওয়া আধাপোড়া একটি মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই জঙ্গিদের খোঁজ পাওয়ার কথা জানান ডিআইজি শফিক।
“মোবাইল ফোনটা আমরা পুলিশের ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করতে পাঠাই। পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায়, যারা নিহত হয়েছে এবং যারা গ্রেপ্তার হয়েছে- তাদের বাইরে আরও দুই-তিনজন জঙ্গি ছিল তাদের টিমে।
“এরপর আমরা ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি। প্রথম দিকে আমাদের তেমন সহযোগিতা করেনি। পরে কোটবাড়ী এলাকায় তাদের দুই সহযোগীর অবস্থানের তথ্য পাই।”
কোটবাড়ী এলাকায় এই আস্তানা গড়ার সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করে শফিকুল ইসলাম বলেন, “তারা মিরসরাই-সীতাকুণ্ড এলাকায় থাকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় ওখানে বাসা ভাড়া পায়নি। তখন তাদের পরামর্শ দেওয়া হয় তোমরা কুমিল্লা এলাকায় চলে যাও। ওখানে ভার্সিটির যে এলাকা আছে, তার আশেপাশে অনেকগুলো ছাত্রদের মেস আছে। মেসগুলার কোনো একটাতে তোমরা আশ্রয় নাও।”
ডিআইজি জানান, এই জঙ্গি দলের সবাই এক সময় চট্টগ্রামের পটিয়া এলাকায় থাকতেন। সেখান থেকে বোমা নিয়ে যাওয়ার সময় গত ৭ মার্চ জসিম ও মাহমুদুল হাসান নামের দুজন কুমিল্লায় ধরা পড়েন।
“এরপর দলের অন্যরা অবস্থান পরিবর্তন করে। এদের কিছু অংশ মিরসরাই, কিছু সীতাকুণ্ড এলাকায় থাকে। জাতীয় পরিচয়পত্র না দেখাতে পারায় এই দুজন ওখানে বাসা ভাড়া পায় নাই, তারা গত ১ মার্চ কুমিল্লার এই বাড়িতে থাকা শুরু করে।”
কোটবাড়ীর ওই আস্তানায় যে দুই জঙ্গির থাকার তথ্য পেয়ে পুলিশ অভিযানে নামে, তাদের পরিচয়ও সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন ডিআইজি শফিকুল ইসলাম।
তিনি জানান, একজনের সাংগঠনিক নাম আনাস বা আনিস। বাড়ি নোয়াখালী এলাকায়। বয়স ১৯ থেকে ২০ বছর। সে গত চার-পাঁচ মাস ধরে পরিবার থেকে নিখোঁজ।
আরেকজনের সাংগঠনিক নাম রনি। পাঁচ মাস আগে ‘পুরনো জেএমবিতে’ যোগ দিয়েছে। বয়স আনুমানিক ২২-২৩ বছর। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায়।
এই দুই জঙ্গির ছবিও পুলিশ সংগ্রহ করতে পেরেছ জানিয়ে শফিক বলেন, “ছবিগুলো আমরা পরে আপনাদের সরবরাহ করতে পারব, যাতে মানুষ তাদের আইডেনটিফাই করতে পারে এবং কোথাও দেখলে আমাদের জানাতে পারে।”
‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আগের দিন বুধবার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির মধ্যেই এই জঙ্গি আস্তানার খবর আসে। এরপর কুমিল্লা পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা বাড়িটি ঘিরে ফেলেন।
কিন্তু বাড়িটি সিটি করপোরেশন এলাকায় হওয়ায় এবং দুই কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি ভোটকেন্দ্র থাকায় তাৎক্ষণিক অভিযানে না গিয়ে বৃহস্পতিবার ভোট পার করে শুক্রবার পর্যন্ত অপেক্ষার সিদ্ধান্ত হয় সেদিন।
দুদিন ধরে বাড়িটি ঘেরাও করে রাখার পর শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে এডিসি সায়েমের নেতৃত্বে সোয়াট এবং এডিসি আনোয়ারের নেতৃত্বে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা দক্ষিণ বাগমারার ওই এলাকায় পৌঁছান, শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযানের প্রস্তুতি।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার শাহ মো. আবিদ হোসেন জানান, জননিরাপত্তার স্বার্থে শুক্রবার সকাল থেকে দক্ষিণ বাগমারার ওই এলাকায় দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বন্ধ রাখা হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ।
সকাল থেকে পুরো এলাকায় মাইকিং করে স্থানীয় বাসিন্দাদের নিরাপদে অবস্থান করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কোটবাড়ী থেকে বার্ড পর্যন্ত সড়কে বন্ধ করে দেওয়া হয় যান চলাচল।
এরপর শুরু হয় সোয়াটের ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’। বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তিন দফা বেশ কিছু গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
এর মধ্যেই সোয়া ১১টার দিকে সৈকত নামের এক পুলিশ সদস্যকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ওই এলাকা থেকে বের করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। তাকে প্রথমে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে এবং সেখান থেকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ডিআইজি শফিকুর সে সময় জানান, ওই বাড়ির ‘জানালা দিয়ে গ্যাস দেওয়ার সময়’ পুলিশ সদস্য সৈতক অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এরপর বিকাল পর্যন্ত চুপচাপ থাকে পরিস্থিতি। বিকালে ডিআইজি জানান, ওই বাড়িতে তাদের কোনো প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়নি। ভেতরে কাউকে পাওয়াও যায়নি।
সন্ধ্যায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে অভিযানের অগ্রগতির তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন তিনি।
এদিকে যেদিন কুমিল্লার এই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে সেদিন ভোরেই মৌলভীবাজারে দুটি বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল পুলিশ। এর একটিতে বৃহস্পতিবার বিকালে অভিযান শেষ করে সোয়াট সদস্যরা।
মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের ওই বাড়িতে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত সাত থেকে আটজনের ছিন্নভিন্ন লাশ পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজার পৌর শহরের বড়হাটে অন্য জঙ্গি আস্তানায় সোয়াটের অভিযান শুরু হয়। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সেই অভিযানও স্থগিত করা হয়েছে।