জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যাশা স্বাধীনতার দিনে

স্বাধীনতার বার্ষিকীতে একাত্তরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এসে জঙ্গিবাদমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা বলেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2017, 09:45 AM
Updated : 26 March 2017, 09:45 AM

রোববার সারাদেশে উদযাপিত হচ্ছে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস; যেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের মূল কেন্দ্রে ছিল সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

ভোর ৬টায় জাতির পক্ষ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর এই শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের পর উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধের ফটক; বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেকে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।

এবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হাজার হাজার মানুষের স্রোত, তখন সিলেটে একটি জঙ্গি আস্তানা ঘিরে অভিযানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে চলা এই অভিযানের মধ্যেই শনিবার রাতে পর পর দুটি বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্যসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন র‌্যাবের একজন কর্মকর্তাসহ দুই জন।

গত স্বাধীনতা দিবসের পর থেকে এবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে দেখতে হয়েছে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সারাবিশ্বকে নাড়া দেওয়া জিম্মি সংকটের ঘটনা। এরপর পুরো সময়জুড়ে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে চলেছে জঙ্গিবিরোধী নানা অভিযান।

তাই জঙ্গিবাদ রুখতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ করার আহ্বান ফিরে ফিরে এসেছে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা আর সাধারণ মানুষের মুখে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার বলেন, “এ বছর আমরা গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি জাতীয় সংসদে পেয়েছি, যেটা গতকাল পালিত হয়েছে। স্বীকৃতি পাওয়াটা আমাদের একটি অর্জন।

“কিন্তু যে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি তাদের দোসর জামাত-বিএনপি অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। তারা এবং জঙ্গিদের রুখতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এখন জরুরি।” 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী অন্তরা দে।

তিনি বলেন, “স্বাধীনতার এত বছর পর এসে জঙ্গিবাদীরা এমনভাবে হামলা-আক্রমণ চালাবে সেটা সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না। তাদেরকে কঠোর হাতে দমন করার শপথ এখান থেকে নেওয়া উচিত।”

এ বছর থেকে গণহত্যা দিবস জাতীয়ভাবে স্বীকৃত হওয়ায় আশাবাদী হওয়ার কথা জানিয়ে এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি তোলেন এই শিক্ষার্থী।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের স্রোত চলার মধ্যে সকাল সাড়ে ৯টায় বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

সকাল গড়িয়ে দুপুরেও চলে চলতে থাকে মানুষের এই শ্রদ্ধা নিবেদন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে স্কুল-কলেজের পোশাকে শ্রদ্ধার ফুল নিয়ে স্মৃতির মিনারে হাজির হতে।

সকালে ভাইস চেয়ারম্যান আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে স্মৃতি একাত্তরের সেক্টর কমাণ্ডারস ফোরামের নেতাকর্মীরা স্মৃতিসৌধে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়ে ৮ নম্বর সেক্টরের কিছু ঘটনা শুনিয়ে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ কীভাবে স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার বর্ণনা দেন ওই সেক্টরের কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী।

রক্ত দিয়ে অর্জিত সেই স্বাধীন দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড তাকে ‘আহত’ করে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, আর দুর্বৃত্তরা চাচ্ছে আমাদের অধিকার করে নিতে। সন্ত্রাসীরা ধর্মীয় অনুশাসনের কথা শুনিয়ে তাদের পক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। এটা আমরা মেনে নিতে পারি না।

“এই সময়ে জনগণকে বুঝাতে হবে, সন্ত্রাসীদের রুখতে হবে এবং দেশের সব অগ্রগতি নির্ভর করবে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মধ্যে।”

স্মৃতিসৌধে জনতার স্রোতে দেখা গেছে সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি) চিকিৎসাধীন একদল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে, যাদের অনেকে হুইল চেয়ারে চেপে কিংবা কারও হাতে ভর করে আসেন স্মৃতিসৌধে।

স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে এসে জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

তিনি বলেন, “মু্ক্তিযুদ্ধের ঐক্যবদ্ধ চেতনাই পারে আমাদের সকল স্বপ্ন সফল করতে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবন দিয়ে আমাদের জন্য স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। এখন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায়ও আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক সেই চেতনাকে ভিত্তি হিসেবে ধরতে হবে।”

শ্রদ্ধা জানানোর সারিতে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন সাভারের আকমল হোসেন; পরন লাল-সবুজ পোশাক আর মুখে জাতীয় পতাকা আঁকা ছিল পাঁচ বছর বয়সী আফিফা জেরিনের।

শিশুমনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গেঁথে’ দেওয়াকে আফিফার সেখানে আসার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন ব্যবসায়ী আকমল।

“আমরা তো শিশুদের ইতিহাস জানাই না। এ কারণে জঙ্গিবাদীরা তাদের পথভ্রষ্ট করতে পারে। ও নিজে আসুক এবং দেখুক- এতে করে সবার মধ্যে শহীদদের আত্মত্যাগের চেতনা ছড়াবে।”

মুক্তিযুদ্ধের পরের ‘সামরিক শাসন ও বিএনপি-জামাতের দুঃশাসনকে’ দেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের কারণ উল্লেখ করে তা প্রতিরোধের আহ্বান এসেছে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের কাছ থেকে।

স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী মেনন বলেন, “দুঃশাসনের ধারাবাহিকতায় দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হতে পেরেছে। এখন সেটা ভয়াবহ আকারে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় এবং দেশের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় রাখা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”

সজাগ (সমাজ ও জাতি গঠন) নামক সংগঠনের কর্মীরা প্রতিবারের মতো এবারও জাতীয় পতাকা মিছিল ও লাল-সবুজ পোশাক পরে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন স্মৃতিসৌধে। এছাড়া জাতীয় শ্রমিক লীগসহ কয়েকটি সংগঠনকেও দেখা গেছে জাতীয় পতাকার মিছিল নিয়ে আসতে।

জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে অনেকের শঙ্কা ও হতাশার মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের উপস্থিতি দেখে আশাবাদ ঝরেছে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার কণ্ঠে।

তিনি বলেন, “সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান, বিমানবন্দর এলাকায় হামলাসহ কোনো কিছুকে মানুষ বাধা মনে করেনি। এখানে আসা লোকগুলো তার প্রমাণ। অনেক হতাশার মাঝেও তারা চায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে। জনগণের সেই শক্তিকে এক করে রাখতে পারলে আমরা গণতন্ত্রের সব সিঁড়ি পেরোতে পারব, পৌঁছাতে পারব উন্নতির সোপানে।”