বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে বাংলার যোগসূত্র তৈরিতে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা বাংলা একাডেমির ভাষ্য মতে, ভালো অনুবাদকের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
একাডেমির অনুবাদ, পাঠ্যপুস্তক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “আমাদের দেশের সাহিত্যগুলো যারা ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন, সেসব অনুবাদ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমন হলে বিশ্ব বাজারে আমাদেরই মান থাকবে না।”
অনুবাদ নিয়ে এগোনোর জন্য বইমেলা শেষে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি প্যানেল করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
অনুবাদের ঘাটতি নিয়ে আক্ষেপ করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানও।
ঢাকা লিট ফেস্টের এক সভায় তিনি বলেন, “বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যথেষ্ট কদর থাকলেও যথাযথ অনুবাদের অভাব রয়েছে।”
রোববার বিকালে এক অনুষ্ঠানে অনুবাদে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন খ্যাতিমান অনুবাদক অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ।
তিনি বলেন, “বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের অনুবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রকাশকদের বাড়তি নজর চাই, অনুবাদকদেরও নিজেদের আরও বেশি দক্ষ হতে হবে।”
এ বছর অনুবাদে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া অধ্যাপক নিয়াজ জামান অনুবাদের খারাপ অবস্থার জন্য দায়ী করছেন অনুবাদকের ইংরেজি ভাষার উপর দক্ষতার অভাবকে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাভাষীদের বড় অসুবিধা হল গ্রামাটিক্যাল মিসটেক। উদাহরণ হিসেবে বলি, ইংরেজিতে ভার্ব আর টেন্সের ব্যবহার যেভাবে রয়েছে, বাংলার জন্য তার অত প্রয়োজন নেই। ভার্ব ও টেন্সের ব্যবহারে কিছু সূক্ষ্ম ব্যাপার আছে। এগুলো বুঝতে হবে।
অনুবাদকে ‘খুব কঠিন’ কাজ মনে করেন ইংরেজির অধ্যাপক নিয়াজ জামান।
“মূল লেখক তার উপন্যাস, গল্পে কী বলতে চাচ্ছে তা অনুবাদককে ভালো করে বুঝতে হবে। আরও গভীরে যেতে হবে। সেটাই ভালো অনুবাদকের গুণ। অনুবাদে বেশ সময় দিতে হয়। আজকালের অনুবাদকদের কি আর অত সময় মেলে?”
ভারতে বাংলাদেশের সাহিত্যের যেসব অনুবাদ হচ্ছে, তাতে প্রায়ই ‘গলদ’ থেকে যাচ্ছে বলে পর্যবেক্ষণ তার।
নিয়াজ জামান সম্প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, যার শিরোনাম দিয়েছেন ‘লাভ অ্যান্ড ডেথ অ্যাট কৃষ্ণনগর’।
নজরুলের কুহেলিকা’ উপন্যাসের অনুবাদ ‘রেভোল্যুশনারি’, ‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসের অনুবাদ ‘আনফেটার্ড’- তার এই বই তিনটি পাওয়া যাচ্ছে নিমফিয়া পাবলিকেশন্সে।
অনুবাদকের দক্ষতা, কোন সাহিত্যটি অনুবাদের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে তা নিয়ে অধিকাংশ প্রকাশকই সচেতন নন বলে মনে করেন অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন।
তিনি বলেন, “অধিকাংশ অনুবাদক প্রকাশককে যা দিচ্ছেন তাই তারা ছেপে দিচ্ছেন। বাণিজ্যিক দিকটি মাথায় রেখে তারা আর গুণগত মান বিচার করছেন না।”
বাংলাদেশে অনুবাদকর্ম ‘অবহেলিত শিল্প’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনুবাদের গুণগত মান বিচারের লোকবল নেই। এই বেহাল দশা নিয়ে গণমাধ্যমেও তেমন আলোচনা নেই। তাইতো খারাপ অনুবাদকের গোষ্ঠী আরও বড় হচ্ছে।”
পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত প্লেটো সিরিজের অনুবাদ করেছেন আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া। এবার বইমেলায় প্রকাশিত এ সিরিজের বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘প্লেটোর রিপাবলিক এর ভূমিকা’, ‘প্লেটো: রাষ্ট্রনায়ক’, ‘প্লেটো: সিম্পোজিয়াম’, ‘প্লেটো: ক্রাতিলাস’, ‘প্লেটো: লেকিস’, ‘প্লেটো: সক্রেটিসের জবানবন্দি’, ‘প্লেটো: প্রোতোগোরাস’।
কবি, অনুবাদক কুমার চক্রবর্তী বলেন, “আজকালের অনুবাদের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা ভীষণ কঠিন। ভালো অনুবাদক তো চোখে পড়ে না। অধিকাংশ বই পড়লে মনে হয় তা খুব বিক্ষিপ্ত, চতুর অনুবাদ।”
বিদেশি কবিতার অনুবাদ নিয়ে তিনি বলেন, “কবিতার অনুবাদের পাঠক শ্রেণি নির্দিষ্ট, সীমাবদ্ধ। তবে তারা ভীষণ পরিশীলিত, বিশুদ্ধ কাব্যসাহিত্যের চর্চা করেন।”
দেশ-কাল-পাঠকের কথা মাথায় রেখে অনুবাদের ধরন ঠিক করতে হয় বলে মনে করেন আরেক অনুবাদক আফসানা বেগম। অনুবাদের ক্ষেত্রে মূল রচনার ভাব বজায় রেখে শব্দ চয়নও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আফসানা বলেন, “যুৎসই শব্দ খুঁজে না পেলে আশ্রয় নিই ভাবানুবাদের, বরাবরই পরিহার করি গম্ভীর বাক্য। অনুবাদ পাঠকের বোধগম্য করতে সহজ শব্দ খুঁজে বের করা মোটেই সহজ নয়।”
অফিসিয়াল ভাষার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার দরকার হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “ধরুন, আদালতে দাঁড়িয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর ভাষণ আমি অনুবাদ করছি। সেক্ষেত্রে আমাকে তো আইনের ভাষা জানতে হবে। সেই ভাষা জানলেই হবে না। কিউবার আইনি ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের আইনি ভাষার তুলনা করতে হবে, সেটাকে পাঠকের জন্য আরও সহজ করে উপস্থাপন করতে হবে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ। অনুবাদের পাঠক ভীষণ সতর্ক হয়ে উঠেছে।”
দায়সারা অনুবাদ ছাপালে প্রকাকশকরা পাঠক হারাবে বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আফসানা বেগম।
ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত কিশোর সিরিজের অনুবাদ করেছেন তরুণ অনুবাদক ইশতিয়াক হাসান।
একই অভিমত দেন আরেক তরুণ অনুবাদক শেহজাদ আমানও। পারিশ্রমিক ইস্যুটি অনুবাদের ‘বড় প্রতিবন্ধকতা’ বলে মনে করেন তিনি।
সমস্যার বিষয়ে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, “কপিরাইট আইন অনুযায়ী, মূল লেখক বা প্রকাশকদের অনুমতি নিতে হয় অনুবাদক, প্রকাশককে। সেক্ষেত্রে মূল লেখক বা প্রকাশকরা এত অর্থ দাবি করেন যে, তখন আর এগোনো সম্ভব হয় না। ভালো সাহিত্যের অনুবাদ তাই এত কম।”
প্রকাশকরা ‘সতর্ক’
অনুবাদ সাহিত্যের বেহাল দশায় প্রশ্নের তীর যখন প্রকাশকদের দিকে তখন তারা বলছেন, অনুবাদকর্ম নিয়ে তারা ‘বাড়তি সতর্কতা’ অবলম্বন করছেন।
বিদেশের মূল প্রকাশক ও লেখকের অনুমতি ছাড়াই প্রকাশকরা অনুবাদের বই ছাপছেন –এমন অভিযোগ মানতে নারাজ পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের কর্ণধার কামরুল হাসান শায়ক।
ভালো প্রকাশকের অভাবে প্রকাশনা শিল্প চরম সঙ্কটে রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।
সন্দেশের মালিক লুৎফুর রহমান চৌধুরী বলেন, “পাঠকের কাজে আসবে এমন বইয়ের অনুবাদই আমরা করছি। মানের বিচারে আমরা খুব সতর্ক। অনেক লেখক তার অনুবাদের বই নিয়ে এসেছিলেন আমাদের কাছে, কিন্তু মানসম্মত নয় বলে আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি।”
পাঠক সমাবেশের প্রকাশনা বিভাগের প্রধান ওয়াহিদুল হক বলেন, “বাণিজ্যিক গুরুত্ব থাকলেও আমরা বিবেচনায় রাখি পাঠকের আগ্রহ। যা পাঠককে আকৃষ্ট করে না, তা আমরা প্রকাশ করি না। আমাদের পাঠক একেবারেই আলাদা। দাম দিয়ে সেরা বইটি কিনতে চাইবে। আমরা সে দিকটিকে প্রাধান্য দিই। অনুবাদের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে চাই না আমরা।”
নালন্দা প্রকাশনী থেকে এসেছে ৩৫টি অনুবাদের বই। নালন্দার প্রকাশক ও প্রধান নির্বাহী রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল জানান, কিশোরদের ক্ল্যাসিক সিরিজগুলোর দিকে আগ্রহ থাকায় তারা এবার সেসব অনুবাদে ভীষণ সতর্ক থেকেছেন।