গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি থেকে উচ্ছেদের সময় সাঁওতালদের ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় গাইবান্ধার পুলিশ সুপারসহ সেদিন চামগাড়ি এলাকায় দায়িত্বরত সব পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
Published : 07 Feb 2017, 02:36 PM
গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমের তদন্তে আগুন দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার প্রমাণ আসার পর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের বেঞ্চ মঙ্গলবার এই আদেশ দেয়।
আদেশে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলামকে প্রত্যাহারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে স্বরাষ্ট্রসচিবকে।
আর আগুন লাগানোর ঘটনার দিন চামগাড়ী এলাকায় দায়িত্বপালনকারী পুলিশ সদস্যদের প্রত্যাহারের নির্দেশ স্বরাষ্ট্র সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, আইজিপি ও রংপুর পুলিশের ডিআইজিকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া আল জাজিরা টিভিতে আগুন লাগানোর যে ভিডিও সম্প্রচারিত হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল, সেই ভিডিও পরীক্ষা করে দেখতে পুলিশ সদর দপ্তর কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানিয়ে আদালত পুলিশের মহা পরিদর্শক ও রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে চার সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে।
গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. শহিদুল্লাহ গত ২৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় তার ৬৫ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
সেখানে বলা হয়, “সাঁওতালদের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনার জন্য স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তি এবং ওই ঘটনার সময়ে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য দায়ী। এই আগুন লাগানোর ঘটনার সাথে দুইজন পুলিশ সদস্য ও একজন ডিবি সদস্য সক্রিয়ভাবে জড়িত।”
আরও কিছু পুলিশ সদস্য ওই সময় কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন; তারা আগুন লাগানোয় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করলেও তা নেভানোর চেষ্টা করেননি বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।
যারা আগুন দিচ্ছিলেন, তাদের মাথায় হেলমেট থাকায় এবং অনেক দূর থেকে ঘটনাটি ভিডিও করায় ওই পুলিশ সদস্যদের চেহারা শনাক্ত করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। তাছাড়া মুখ্য বিচারিক হাকিম সেদিন সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের তালিকা চাইলেও পুলিশ সুপার তা তাকে দিতে পারেননি।
পরে আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “ঘটনার দিন যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের তালিকা দেননি পুলিশ সুপার। মুখ্য বিচারিক হাকিমকে সহযোগিতা না করা প্রকারান্তরে হাই কোর্টের আদেশের লঙ্ঘন। এসব কারণে পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার এবং ওইদিন আগুন লাগানোর স্থান চামগাড়ি এলাকায় দায়িত্বে থাকা সবাইকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।”
এছাড়া সেদিন দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে- তাও আদালত চার সপ্তাহের মধ্যে জানাতে বলেছে বলে জানান এই আইনজীবী।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাজু বলেন, “গাইবান্ধার বাগদাফার্ম এলাকার সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে এসেছে যে পুলিশ আগুন দিয়েছে, কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। আদালত এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।”
সরকারের এই আইন কর্মকর্তা বলেন, “আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা থাকতে হবে। যেহেতু বিষয়টা (সাঁওতালদের উচ্ছেদ ও ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনা) আদালতে এসেছে, আদালতের দায়িত্ব হল দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। তাছাড়া কতিপয় পুলিশ সদস্যে কারণে পুরো পুলিশ প্রশাসন কলঙ্কিত হতে পারে না।”
বিষয়টি আগামী ৯ মার্চ আবার আদালতে উঠবে বলে মোতাহার হোসেন সাজু জানান।
সাঁওতালদের ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার একটি ভিডিও নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তুমুল আলোচনা শুরু হলে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাই কোর্ট বেঞ্চ গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর এই তদন্তের আদেশ দেয়।
উচ্ছেদ অভিযানে ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কারা জড়িত এবং সেখানে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত কি না- তা তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিমকে।
ওই আদেশের পর গত ২৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. শহিদুল্লাহ সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া গ্রামে যান এবং সব কিছু ঘুরে দেখে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল ও বাঙালি পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন।
আগুনে পোড়া ঘরের কিছু আলামতও তারা সংগ্রহ করেন। সে সময় তার সঙ্গে ছিলেন গাইবান্ধার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম ময়নুল হাসান ইউসুফ।
ঘটনাক্রম
১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। ওই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তুলে তার দখল ফিরে পেতে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা।
পরে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মে বিরোধপূর্ণ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে বসবাস শুরু করে তারা। গত ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে।
সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। ওই ঘটনায় নিহত হন তিন সাঁওতাল, আহত হন অনেকে।
সংর্ঘষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই কল্যাণ চক্রবর্তী ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে সাড়ে ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় চার সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।
অন্যদিকে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদের ঘটনায় মুয়ালীপাড়া গ্রামের সমেস মরমুর ছেলে স্বপন মুরমু গত ১৬ নভেম্বর অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন; তার মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঘটনার প্রায় এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওর ভিত্তিতে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সাঁওতাল পল্লীর ভেতরে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়ছেন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য একটি ঘরে লাথি মারছেন এবং পরে এক পুলিশ সদস্য ওই ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেন। পুলিশের সঙ্গে সাধারণ পোশাকে থাকা আরেকজন আগুন অন্য ঘরে ছড়িয়ে দিতেও সহায়তা করেন।
ভিডিওর একটি অংশে আরও কয়েকটি ঘরে আগুন দিতে দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের। তাদের মাথায় ছিল হেলমেট, একজনের পোশাকের পিঠে ডিবি, আরেকজনের পুলিশ লেখা ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে এক রিট আবেদনকারীর সম্পূরক আবেদনে হাই বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত দুই সাঁওতালের অভিযোগ এজাহার হিসেবে নিয়ে পিবিআইয়ের মাধ্যমে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিচারিক হাকিমের সঙ্গে একই দিনে পিবিআই ওই তদন্ত শুরু করে।
এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও বলেছিলেন, সাঁওতালদের যেভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে তা আইনি প্রক্রিয়ায় হয়নি।