অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখলকারীদের অবসরভাতা, আনুতোষিক বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার পথ বন্ধ করার বিধান রেখে সংসদে বিল পাস হয়েছে।
Published : 04 Oct 2016, 08:55 PM
মঙ্গলবার ‘রাষ্ট্রপতির অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা বিল-২০১৬’ সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন সংসদ কাজে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। পরে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বিলটি জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেছিলেন, বিলটি তাদের নেতা এইচ এম এরশাদকে ‘বঞ্চিত’ করার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে।
গত বছরের ৯ নভেম্বর বিলটি সংসদে তোলার পর পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
এর আগে ওই বছরের অগাস্ট মাসে বিলটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ‘প্রেসিডেন্টস পেনশন অর্ডিনেন্স’ বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়নের জন্য বিলটি সংসদে তোলা হয়েছে।
বিলে বলা হয়েছে, অসাংবিধানিক পন্থায় বা অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন বা হয়েছিলেন বলে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ঘোষিত হলে তিনি অবসর ভাতা পাবেন না।
২০১০ সালে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে হাই কোর্টের এক রায়ে বলা হয়, “খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের মতো এইচ এম এরশাদও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী।"
পরের বছর আপিল বিভাগেও ওই রায় বহাল থাকে; আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ১৫ অগাস্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণাকারী মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হওয়ার পর মোশতাকই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করে যান।
ওই বছরই ৩ ও ৬ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সায়েমকে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তার কাছ থেকে জিয়া ক্ষমতা নেন। জিয়া হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়া ওই দায়িত্বও নেন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ।
তিনি নিজে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে রাষ্ট্রপতির আসনে বসান বিচারপতি এ এফ এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীকে।
১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর এরশাদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও নিয়ে নেন।
নয় বছর ক্ষমতায় থাকার পর গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
মন্ত্রিসভায় বিলটি ওঠার দিন তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, জিয়া ও এরশাদের পরিবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসর ভাতা নেন না।
মূল বেতনের ৭৫ শতাংশ হারে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি অবসর ভাতা পাবেন বলে বিলে বলা হয়েছে।
যদি কোনো রাষ্ট্রপতি নৈতিক স্খলন বা অন্য কোনো অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হন তাহলে অবসর ভাতা পাবেন না। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি যদি এমন কোনো দপ্তর, আসনে বা মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন, যার জন্য তিনি সংযুক্ত তহবিল হতে বেতন বা অন্য কোনো সুবিধা পাচ্ছেন, তবে তিনি অবসর ভাতা পাবেন না।
অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিরা একজন ব্যক্তিগত সহকারী ও একজন অ্যাটেনডেন্ট এবং দাপ্তরিক ব্যয় পরিচালনার খরচ পাবেন। এছাড়া তিনি একজন মন্ত্রীর প্রাপ্য চিকিৎসা সুবিধা, সরকারি অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বিনামূল্যে যানবান ব্যবহার, বাড়িতে টেলিফোন, কূটনৈতিক পাসপোর্ট এবং দেশের ভেতরে সরকারি সার্কিট হাউস বা রেস্ট হাউজে বিনা ভাড়ায় থাকতে পারবেন।
কোনো রাষ্ট্রপতি তার জীবদ্দশায় নিজে অথবা মৃত্যুবরণ করথে তার মনোনীত ব্যক্তি বা মনোনীত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার উত্তরাধিকারীরা এর আগে আনুতোষিক না নিলে তারা নিতে পারবে।
মন্ত্রিসভায় বিলটি ওঠার দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার কখনও পেনশন নেয়নি, কারণ ওই আইনটিই হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তবে নতুন আইন পাস হলে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারীরা তা পাবেন।”
কোন ব্যক্তি অন্যূন ছয় মাস রাষ্ট্রপতির পদে থাকলে বা মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে পদে না থাকলে তিনি আমৃত্যু অবসর ভাতা পাবেন।
জাপার আপত্তি
বিলটি জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব তোলার সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, “জেনারেল জিয়া ও আমাদের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যেভাবে ক্ষমতায় এসেছেন; সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের পর আর এভাবে ক্ষমতায় আসার সুযোগ নেই। কিন্তু একজন ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে আইন করা ঠিক হবে না। শুধু এরশাদকে লক্ষ্য করে, এক ব্যক্তির জন্য আইন করা ঠিক নয়।”
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, “আদালতের রায়ে ১৯৮৬ সাল থেকে এরশাদের শাসনামলকে বৈধতা দিয়েছে। এরপরও তার সুবিধাদি কেড়ে নেওয়া ঠিক হবে না। বিষয়টি আইনি এবং আইনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট শেষ করেছে। এটা তার জন্যে প্রযোজ্য হবে না।”
একই দলের নুরুল ইসলাম মিলন বিলটি জনমত যাচাইয়ের জন্য পাঠানোর অনুরোধ করে বলেন, “১৯৮৬ সাল থেকে নিয়মানুযায়ী নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এরশাদ। সেক্ষেত্রে তিনিও আদালতের রায় অনুযায়ী আনুতোষিক ভাতাসহ সব সুবিধা পাবেন।”
জাপার হুইপ নুরুল ইসলাম ওমর, রওশন আরা মান্নান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজী বিলটি জনমত যাছাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন।
জবাব দিতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জাতীয় পার্টির সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, “নিজেরাই কেন নিজেদের দুর্বলতার দিক টেনে আসলেন। বিলে তো কারও নাম লেখা নেই। নিজেরাই প্রকারন্তরে স্বীকার করলেন যে জেনারেল এরশাদ মার্শাল ল’ দিয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। চুপ করে থাকলেই তো হত।”