‘একাত্তরে যুদ্ধ ছিল রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে’

একাত্তরে সংঘটিত যুদ্ধকে অনেকে পাকিস্তানের ‘গৃহযুদ্ধ’ বলতে চাইলেও ঐতিহাসিক ওই ঘটনাটি যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যুদ্ধ ছিল, তা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়েও উঠে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2016, 03:16 PM
Updated : 4 May 2016, 12:55 PM

যুদ্ধের সময় বেসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা লাভের অধিকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ’ বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত বিচারপতি আনোয়ারুল হক নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আদালতের এই পর্যবেক্ষণকে আরেকটি ‘মাইলফলক’ বলেছেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।

কিশোরগঞ্জের ৫ রাজাকারের বিচারের রায়ে মঙ্গলবার আদালত বলেছেন, স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পৃথক জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্মের পর দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদেরকে সহযোগিতার জন্য গঠিত সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে বেসামরিক জনগণকে টার্গেট করে বর্বর নৃশংস কার্যক্রম শুরু করে। এভাবে তারা একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাতে নিজেদেরকে ‍যুক্ত করে।

“বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে অভিযুক্তদের দ্বারা সংগঠিত এই নৃশংস কাজ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার যুদ্ধ বা সংঘাতে জেনেভা কনভেনশন বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বা যুদ্ধের আইনে উল্লেখিত নিজ ভূমিতে ‘প্রোটেকশন অব সিভিলিয়ান’ ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম

তুরিন আফরোজ বলেন, “রায়ের বেশ কয়েক জায়গায় বিচারকরা বলেছেন, এটা ছিল দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ। এর মাধ্যমে যারা এটাকে একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলতেন, তারা সেটি আর বলতে পারবেন না।

“বিশ্বের বুকে আমরাই হচ্ছি প্রথম রাষ্ট্র যারা রাইট অব সেলফ ডিটারমিনেশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছি। আমাদের এই উজ্জ্বল ইতিহাস, সেই ইতিহাস এই রায়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।”

রায়ের উপসংহারে এই প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর পরপরই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এর পরের মাসে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের একটি স্থান মেহেরপুরে প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হয়। ওই সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত।  

নয় মাসের যুদ্ধ এই সরকারের অধীনেই পরিচালিত হয়। কলকাতায় দপ্তর স্থাপন করে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের কার্যক্রম পরিচালিত হত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাকিস্তানিরা বরাবর অভ্যন্তরীণ সংঘাত হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করে। অন্যদিকে ভারতেও একদল লোক রয়েছে, যারা এটাকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসাবে দেখাতে চায়।

তবে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলই আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।

এ ছাড়া তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পান।

জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তাজউদ্দীনের ভাষণ ভারতের আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হয়।