পাকিস্তানের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ, দূতকে তলব করে ‘কড়া প্রতিবাদ’

যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে পাকিস্তান উদ্বেগ প্রকাশ করায় দেশটির হাই কমিশনারকে তলব করে ‘কড়া প্রতিবাদ’ জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2015, 09:39 AM
Updated : 23 Nov 2015, 07:14 PM

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তলবে ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশনার সুজা আলম সোমবার রাষ্ট্রীয় ভবন পদ্মায় হাজির হয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। 

মিজানুর রহমান পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি।”

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে রোববার প্রথম প্রহরে সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদের মৃতুদণ্ডের রায় কার্যকর করার পর এক বিবৃতিতে উদ্বেগের কথা জানায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর আমরা গভীর উদ্বেগ ও বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করলাম।”

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের এই বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে এ নিয়ে ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়ার’ কথা বলা হয় ওই বিবৃতিতে।

তলবি সাক্ষাতের সময় পাকিস্তানের হাই কমিশনারের হাতে একটি প্রতিবাদপত্র তুলে দেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানের এই প্রতিক্রিয়াকে ‘নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ’ বলা হয়েছে।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, “মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার সঙ্গে নিজেদের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ও সহযোগিতার বিষয়টি আবারও স্বীকার করল পাকিস্তান।

“অবিবেচনাপ্রসূত ওই মন্তব্যটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়, যা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াকে পাকিস্তানের ‘ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যা দেওয়াকে নাকচ করে বলা হয়, “স্বাধীন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই রায় দেওয়া হয়েছে। এতে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না।

“বিচারে শুধু তাদের সংঘটিত অপরাধ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও সংশ্লিষ্টতার সম্পর্ক নেই।”

পাকিস্তানের মন্তব্যকে ‘পক্ষপাতমূলক, ধার করা ও ভিত্তিহীন’ আখ্যা দিয়ে একটি সার্বভৌম দেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করার বিষয়ে ‘কড়াভাবে’ সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

১৯৭৪ সালের ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ চুক্তির আলোকে দুই দেশের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে ঢাকার প্রতি আহ্বান জানানো হয় ইসলামাবাদের বিবৃতিতে।

এই বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিকর’ উল্লেখ করে লিখিত প্রতিবাদে বলা হয়েছে, “বরং বাংলাদেশই বরাবর আঞ্চলিক শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ও সংহতির পক্ষে কথা বলে আসছে।”

এছাড়া যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটনকারীরা দায়মুক্তি ও বিচারের হাত থেকে রেহাই পাবেন বলে চুক্তির কোথাও কোনো ইঙ্গিত নেই বলে এতে উল্লেখ করা হয়।

বরং চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে গণহত্যার জন্য চিহ্নিত ও আটককৃত নিজ দেশের নাগরিকদের বিচারের আওতায় আনার বাধ্যবাধকতা অনুসরণে পাকিস্তান যে ব্যর্থ হয়েছে তা হাই কমিশনারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অব্যাহত হীন প্রচারণায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, ‘এটা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষার প্রতিশ্রুতির প্রকাশ নয়।’

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তোলা বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে তা পাকিস্তানের যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে হাই কমিশনারকে বলা হয়েছে।

“ভবিষ্যতে পাকিস্তানি মহল/কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল আচরণ করবে এবং এধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকবে বলে বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাশা করে।”

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে রোববারই পাকিস্তানের হাই কমিশনারকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর সুজা আলম সোমবার ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করেন।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সালে জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরও উদ্বেগ জানিয়েছিল পাকিস্তান।

‘পাকিস্তানের প্রতি অনুগত এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সমর্থন করায়’ কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে দাবি করে সে সময় দেশটির পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাবও গৃহীত হয়।

তা নিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন মহলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে ওই প্রস্তাব গ্রহণের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার।

২৫ বছরের শোষণ-বঞ্চনার পর বাঙালিদের স্বাধিকারের দাবিকে দমন করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

তখন প্রতিরোধ ‍যুদ্ধে নামে বাঙালিরা। নয় মাসের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঘটে।    

একাত্তরে বাঙালি নিধনে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশেরই কিছু দোসর পেয়েছিল। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে তাতে সমর্থন দেয়; গঠন করে রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী।

যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিতদের মধ্যে অধিকাংশই জামায়াত নেতা এবং তাদের রায়ের পর পাকিস্তান জামায়াত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে।