যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনায় (রিভিউ) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আবেদন শুনানির জন্য সর্বোচ্চ আদালতের মঙ্গলবারের কার্যতালিকায় এসেছে।
Published : 16 Nov 2015, 05:53 PM
গত ২ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ সাবেক এই দুই মন্ত্রীর রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য ১৭ নভেম্বর দিন ঠিক করে দিয়েছিল।
সোমবার বিকালে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, পরবর্তী দিনের কার্যতালিকার ২ নম্বর ক্রমিকে মুজাহিদ এবং ৩ নম্বর ক্রমিকে সালাউদ্দিন কাদেরের রিভিউ শুনানির জন্য রয়েছে।
এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর করা আপিলও (আংশিক শ্রুত) রয়েছে কার্যতালিকায়। তা আছে ৪ নম্বর ক্রমিকে।
কার্যতালিকা অনুসারে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চে আছেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এর আগে রিভিউ শুনানিতে পাঁচ পাকিস্তানিসহ আটজনের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়ার যে আবেদন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের করেছিলেন, তা ২ নভেম্বর খারিজ হয়।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের রিভিউ শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে কনিষ্ঠ দুই আইনজীবী যাতে নির্বিঘ্নে সহায়তা করতে পারেন, সে নির্দেশনা চেয়ে করা আবেদনও নাকচ হয়ে যায়।
আপিল বিভাগের এই বেঞ্চ গত ১৬ জুন একাত্তরের বদর প্রধান মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরের আপিলের রায় আসে ২৯ জুলাই।
দুই আপিলের রায়েই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল থাকে। তাদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় একই দিনে, ৩০ সেপ্টেম্বর।
এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজাহিদকে এবং গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে থাকা সালাউদ্দিন কাদেরকে সেই মৃত্যু পরোয়ানা ১ অক্টোবর পড়ে শোনানো হয়।
দণ্ড কার্যকরের আগে দুই যুদ্ধাপরাধীর শেষ আইনি সুযোগ এই রিভিউ আবেদন। এ আবেদনে রায়ের কোনো পরিবর্তন না হলে তাদের শেষ সুযোগ থাকবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার।
এর আগে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, রিভিউ নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে যাবে এবং কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করবে।
সালাউদ্দিন কাদের ও মুজাহিদ রিভিউ আবেদন দায়েরের পর রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য গত ১৫ অক্টোবর আবেদন করে।
এরপর সালাউদ্দিন কাদের রিভিউ শুনানিতে পাঁচ পাকিস্তানিসহ আটজনের সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য ১৯ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন, যাতে আদালতে এসে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ওই আটজনের নামে সমন জারির আরজি জানানো হয়।
এরা হলেন- পাকিস্তানের স্থপতি মুনিব আরজুমান্দ খান, পাকিস্তানের ডন গ্রুপের চেয়ারম্যান আমবর হারুন সায়গল, পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী ইসহাক খান খাকওয়ানি, ভিকারুন্নেসা নূনের নাতি রিয়াজ আহমেদ নূন এবং পাকিস্তানের প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মিয়া মোহাম্মদ সুমরো।
২০ অক্টোবর এসব আবেদন অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতির আদালতে ওঠে, আদালত রিভিউসহ এ আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়।
পরে মুজাহিদের রিভিউ শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে কনিষ্ঠ দুই আইনজীবী যাতে নির্বিঘ্নে সহায়তা করতে পারেন, সে নির্দেশনা চেয়ে ২৫ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করা হয়।
দুটি মামলায়ই প্রধান আইনজীবী হিসেবে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাকে সহায়তা করতে যে আইনজীবী দল রয়েছে, তাতে শিশির মনির ও আসাদ উদ্দিন সদস্য রয়েছেন।
আসামির আইনজীবীদের অভিযোগ, ওই দুই আইনজীবীকে শুনানি থেকে বিরত রাখতে সরকার হয়রানি করছে। তাদের জন্যই আবেদন দুটি করা হয়। পাশাপাশি রিভিউ শুনানির আগে চার সপ্তাহ সময়েরও আবেদন করেন মুজাহিদের আইনজীবীরা।
২ নভেম্বর শুনানি শেষে আপিল বিভাগ সালাউদ্দিন কাদেরের আবেদন খারিজ করে রিভিউ শুনানির দিন ঠিক করে দেয়। মুজাহিদের আবেদনেও কোনো সাড়া দেয়নি আদালত।
নিজামীর আপিল কার্যতালিকায়
যুদ্ধাপরাধের দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত আমির নিজামীর করা আপিলের ওপর ৯ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়।
ওই দিন শুনানি নিয়ে আদালত ৩ নভেম্বর দিন ধার্য করেছিল। সেদিন শুনানি হয়নি।
বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় গত বছরের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে করা সাতটি আপিল ইতোমধ্যে আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এর আগে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে দুই নেতার করা রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে আপিল বিভাগে তা খারিজ হয়।
এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয়। এর বিরুদ্ধে তার করা রিভিউ খারিজের পর ওই বছর ১২ ডিসেম্বর তার দণ্ড কার্যকর করা হয়।
২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ তৃতীয় রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। এর বিরুদ্ধে তার রিভিউ খারিজের পর ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
আর ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিলে দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখন প্রকাশের অপেক্ষায়।
এ ছাড়া শুনানি পর্যায়ে এলেও জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম মারা যাওয়ায় তাদের আপিল ‘অকার্যকর’ হয়ে যায়।