একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নিষ্ঠুরতার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াই যথাযথ হয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ এসেছে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে।
Published : 01 Oct 2015, 12:03 AM
নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতার জন্য কোনো উদারতা পাওয়ার যোগ্য সাবেক এই মন্ত্রী নন বলেও মন্তব্য করেছে সর্বোচ্চ আদালত।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ২৯ জুলাই মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের ত্রাস সালাউদ্দিন কাদেরের আপিলের রায় ঘোষণা করে।
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার দণ্ড বহাল রেখে দেওয়া এই রায়ে বিচারকদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা বুধবার তা প্রকাশ করে।
২১৭ পৃষ্ঠার পৃষ্ঠার এই রায় প্রদানকারী বেঞ্চের অন্য তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
একই দিন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ও প্রকাশিত হয়। তার রায় ঘোষণা হয়েছিল গত ১৬ জুন। তার ক্ষেত্রেও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে।
সালাউদ্দিন কাদেরের রায়ে বলা হয়, “দলিল প্রমাণাদি বিবেচনায় নিয়ে আমরা সম্মত যে, প্রসিকিউশন ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১৭ ও ১৮ নাম্বার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
“মৌখিক, দালিলিক ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণের মাধ্যমে আপিলকারী এই সব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। আসামিপক্ষ ঘটনাগুলো স্বীকার করেছে, সেই সঙ্গে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সম্পৃক্ততার বিষয়টাও স্বীকার করেছে।”
আদালত বলেছে, আসামিপক্ষের যুক্তিতে কোনোই সারবত্তা নেই। তাদের দালিলিক প্রমাণে তাদের অবস্থানকে আরও নেতিবাচক করেছে।
“অপরাধস্থলে আপিলকারীর উপস্থিতি এবং দুটি প্রধান অভিযোগে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি ওই দালিলিক প্রমাণেই প্রসিকিউশন প্রমাণ করেছে। তবে ৭ নম্বর অভিযোগে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করায় ট্রাইব্যুনাল আইন প্রয়োগে ভুল করেছে।”
“যদিও আমরা পেয়েছি, ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল দুপুরে সতীশ চন্দ্র পাল খুন হয়েছেন এবং তার বাড়ি পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই অভিযোগে অভিযুক্তের সংযোগ প্রমাণে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে, যার ফলে অভিযুক্ত সন্দেহের সুবিধা পেয়েছেন।”
“২ ও ৪ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার পরও দণ্ডের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল উদার দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেছেন। অন্য অভিযোগগুলো, বিশেষ করে ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগের ঘটনাগুলো নিষ্ঠুর এবং নারকীয়।”
“এই সব ঘটনায় অভিযুক্ত কেবল শারীরিকভাবে উপস্থিতই ছিলেন না, বরং তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করেন। কখনোই তিনি তার এই কাজের জন্য অনুশোচনা বা অনুতাপ দেখাননি। বরং তিনি বিচার প্রক্রিয়াকেই অবহেলা করেছেন।”
আপিল বিভাগের এই রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের উদ্ধৃতিও দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, ট্রাইব্যুনাল তার আচার আচরণ নথিভুক্ত করেছে। তিনি উদ্ধত ছিলেন এবং চিৎকার-চেঁচামেচির দ্বারা আদালতের বিধিভঙ্গ করেছেন। সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি তার এই আচরণ চালিয়ে গেছেন। তিনি ট্রাইব্যুনাল সদস্যদের প্রতি কোনো সম্মান প্রদর্শন করেননি এবং ট্রাইব্যুনালের কর্তৃত্বকে আমলেই নেননি।
“তার আচার-আচরণ, এই সব অপরাধে তার সরাসরি অংশগ্রহণ এবং তার নিষ্ঠুরতার জন্য তাকে সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়া তার অপরাধের সমান হয়েছে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যথাযথ হয়েছে এবং তার প্রতি কোনো উদারতা দেখানো উচিত নয়।”
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিনাশ করতে চট্টগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন কাদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে অংশ নিয়েছিলেন বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
“মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা মানব সভ্যতায় বিদ্যমান জঘন্যতম অপরাধ। সভ্যতার সব যুগে এই সব অপরাধকে সবচেয়ে নৃশংস, আতঙ্কজনক ও ভয়াবহ কাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।”
“আসামি এসব অপরাধ সর্বোচ্চ নির্দয়তা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে করেছেন। বেসামরিক ও নিরস্ত্র মানুষকে তিনি নিপীড়ন করেছেন, নির্যাতন করে হত্যা করেছেন, নির্দোষ মানুষের অন্তর্ধানের কারণ হয়েছেন, মানুষকে অন্তর্ধানে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছেন। তিনি নির্বিচারে মানুষের সম্পত্তি লুটপাট করেছেন, লুটপাটে সহায়তা করেছেন।”
সালাউদ্দিন কাদের ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিত ছকে এসব অপরাধ সংগঠন করেছেন বলেও রায়ে উঠে আসে।
“সেই এলাকায় তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও হিন্দু সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ বিনাশ করতে তিনি এই সব অপরাধ সংগঠন করেছেন। গণ মানুষকে হত্যায় তার এই মিশনকে তিনি সফলতার সঙ্গে সম্পূর্ণ করেছেন, যা দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগিদের সাহায্যে সংগঠিত নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতা।”
“সে মতে, এটা এই ধরনের দণ্ড প্রদানের অন্যতম উপযোগী মামলা। এই মৃত্যুদণ্ডে হস্তক্ষেপ করার মতো কোনো অকাট্য যুক্তি খুঁজে পাইনি।”
এই বিশ্লেষণের পর আদালত তাকে ৭ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে বাকী অভিযোগগুলোর দণ্ড বহাল রাখে।
গত দুই দশকে চটকদার,‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ এবং কখনও কখনও ‘অশালীন’ মন্তব্যের কারণে বার বার সংবাদপত্রের শিরোনামে এসেছেন সালাউদ্দিন কাদের, যাকে সংক্ষেপে সাকা চৌধুরী নামে চেনে বাংলাদেশের মানুষ।
তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার গহিরা গ্রামে। বাবা মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এক সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকারও হয়েছিলেন।
সালাউদ্দিন কাদেরের রাজনীতির শুরুও মুসলিম লীগ থেকেই। পরে জাতীয় পার্টি ও এনডিপি হয়ে তিনি বিএনপিতে আসেন।
একাত্তরের অপরাধের জন্য বিতর্কিত এই রাজনীতিবিদ ১৯৭৯ সালে মুসলিম লীগ থেকে রাউজানের সাংসদ নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং কার্যত এর মধ্যে দিয়েই মূল ধারার রাজনীতিতে তার পুনর্বাসন ঘটে। পরে এনডিপি ঘুরে তিনি বিএনপিতে আসেন।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বও তিনি পালন করেন। এর আগে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
সর্বশেষ ২০০৮ সালের র্নিবাচনে রাঙ্গুনিয়া ও ফটিকছড়ি থেকে অংশ নেন সাকা। রাঙ্গুনিয়াতে হেরে গেলেও ফটিকছড়ি, অর্থাৎ চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে বিএনপির সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি। তিনি সাংসদ থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তার ফাঁসির রায় আসে।
ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের বড়। তার সেজ ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। তিনিও একসময় সাংসদ ছিলেন।
বাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী মারা গেছেন। আর জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেওয়ার আগেই তা ফাঁসের অভিযোগ এনেছিল এই বিএনপি নেতার পরিবার। তদন্তের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, তার স্ত্রী-পুত্র ও আইনজীবী ওই রায়ের খসড়া ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।