পেনশন পাবেন না অবৈধ রাষ্ট্রপতিরা

অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাদখলকারীদের অবসরভাতা, আনুতোষিক বা অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার পথ বন্ধ করার বিধান রেখে নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2015, 08:43 AM
Updated : 4 August 2015, 06:46 AM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে  সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘রাষ্ট্রপতির অবসরভাতা, আনুতোষিক  ও অন্যান্য সুবিধা আইন, ২০১৫ ’ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর অবসরভাতা, আনুতোষিক বা অন্যান্য সুবিধার বিষয়টি নির্ধারিত হয় ১৯৭৯ সালের ‘প্রেসিডেন্টস পেনশন অর্ডিনেন্স’ অনুযায়ী। ১৯৮৮ সালে অধ্যাদেশটি একবার সংশোধন করা হয়েছিল।

সামরিক শাসনামলের জারি করা প্রয়োজনীয় অধ্যাদেশগুলো আইনে পরিণত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর ‘রাষ্ট্রপতির অবসরভাতা, আনুতোষিক  ও অন্যান্য সুবিধা আইন’ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করে।

সে সময় মন্ত্রিসভার দেওয়া ‘অনুশাসন’ অনুযায়ী নতুন করে খসড়া প্রস্তুত করে সোমবার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয় বলে জানান সচিব।

তিনি বলেন, “অধ্যাদেশে শুধু ছিল, যদি কোনো রাষ্ট্রপতি নৈতিক স্খলন বা অন্য কোনো অপরাধে আদালতে  দণ্ডিত হন তাহলে অবসর ভাতা পাবেন না। নতুন আইনে এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে- ‘অসাংবিধানিক পন্থায় অবৈধ উপায়ে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন বা হয়েছিলেন মর্মে আদালত কর্তৃক ঘোষণা হলে তিনি অবসরভাতা, আনুতোষিক ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন না।”

২০১০ সালে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে হাই কোর্টের এক রায়ে বলা হয়, “খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা'দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের মতো এইচএম এরশাদও অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী।"

পরের বছর আপিল বিভাগেও ওই রায় বহাল থাকে; আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। ১৫ অগাস্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণাকারী মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ নিহত হওয়ার পর মোশতাকই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করে যান।

ওই বছরই ৩ ও ৬ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সায়েমকে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন; জিয়া হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়া ওই দায়িত্বও নেন।

তার আগে ৩০ মে জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়, যাতে ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে। 

পরে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।

জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ। তিনি নিজে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে রাষ্ট্রপতির আসনে বসান বিচারপতি এ এফ এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীকে।

১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর বিচারপতি আহসানুদ্দিনকে সরিয়ে এরশাদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। জিয়ার মতোই গণভোটের মাধ্যমে নিজের কর্তৃত্বকে বৈধ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ ওই গণভোটে তিনি পান ৯৪.৫ শতাংশ ভোট। 

পরে ১৯৮৬ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেন এবং নির্বাচিত হন। ৯ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

অবসরভাতার এ আইন এরশাদ বা জিয়া কিংবা তাদের উত্তরাধীকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তারা রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসরভাতা নেন না। তারা সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ভাতা নিয়ে থাকেন।”

আরেক প্রশ্নের জবাবে মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার কখনো পেনশন নেয়নি, কারণ ওই আইনটিই হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তবে নতুন আইন পাস হলে বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধীকারীরা তা পাবেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কেউ যদি রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন শেষে এমন কোনো দপ্তরে বা পদে দায়িত্ব পালন করেন, যার জন্য তিনি প্রজাতন্ত্রের সংযুক্ত তহবিল থেকে বেতন বা অন্যান্য সুবিধা পেয়েছেন বা পাচ্ছেন, তাহলে তিনিও রাষ্ট্রপতি পদের পেনশন পাবেন না বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে অধ্যাদেশ জারির সময় পর্যন্ত যারা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের সবার ক্ষেত্রেই এই আইন প্রযোজ্য হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান।

তিনি বলেন, “মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, এটি ১৯৮৮ সালের ৪ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু এ সময়ের আগে যারা রাষ্ট্রপতি ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে কী হবে?... কাজেই এ বিধানটা প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে যারাই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা পেনশন পাবেন।”

সচিব জানান, পেনশনের বিষয়ে মূল অধ্যাদেশে ন্যূনতম ৭ হাজার ৫০০ টাকার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতির বেতন ছিল ১০ হাজার টাকা।

“তখন ন্যূনতম সাড়ে সাত হাজার টাকা দরকার ছিল। এখন এটি অনাবশ্যক হয়ে গেছে। এ বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি ৬১ হাজার ২০০ টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। এর ৭৫ শতাংশ হারে মাসিক অবসর ভাতা হয় ৪৫ হাজার ৯০০ টাকা।”