গ্লোবের হ্যামলেটে মুগ্ধতা

রুবাইয়াৎ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2015, 12:45 PM
Updated : 18 July 2015, 11:51 AM

সারাদিনই বৃষ্টি ছিল ঢাকায়। কখনও মুষলধারে আবার কখনও বা গুঁড়িগুঁড়ি। তবে সরকারি ছুটি থাকায় যানবাহনের তেমন ভিড় রাস্তায় ছিল না। রোজার এই সময়ে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ ওয়ানডে ম্যাচের ফলের দিকেও দেশবাসীর দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা। যে কারণে কোথাও তেমন ভিড় নেই। বেশিরভাগ মানুষই টেলিভিশনের সামনে।

কিন্তু একটি জায়গা ছিল ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা। বুধবার বিকাল থেকেই সেখানে লোকে লোকারণ্য। কারণ একটি নাট্যদল আজ এখানেই মঞ্চস্থ করবে বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের সর্ববৃহৎ ট্র্যাজেডি ‘হ্যামলেট’। তবে বিষয়টি এখানে শেষ হলে মানুষের আগ্রহের নেপথ্য রহস্যটুকু ঠিক উন্মোচিত হবে না।

একটু খোলসা করা প্রয়োজন। ‘হ্যামলেট’ মঞ্চায়ন করবে শেক্সপিয়ারেরই প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল ৪০০ বছরের পুরনো লন্ডনের ‘গ্লোব থিয়েটার’। এবার নিশ্চয় পাঠক একটু নড়েচড়ে বসেছেন।

জাতীয় নাট্যশালার আসন সংখ্যা মাত্র ৭৩৮। আর নাটকটির মঞ্চায়নও হবে মাত্র একটি। ফলে নাট্যামোদী সবার তৃষ্ণা মেটানো সম্ভব হয়নি। হাজার হাজার দর্শক চাহিদার বিপরীতে মাত্র কয়েকশ’ ভাগ্যবান দর্শকই এটি উপভোগের সুযোগ পেয়েছেন। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের থেকে শুরু করে মঞ্চনাটকের নিয়মিত দর্শক সবারই এক মিলনমেলায় পরিণত হয় জাতীয় নাট্যশালা।

এবারই এ ধরনের কোনো মঞ্চায়নে অনলাইনে টিকেট বিক্রি হওয়ায় বক্স অফিসের (টিকেট কাউন্টার) সামনে নেই কোনো ভিড়। অনলাইনে টিকেট ছাড়ার মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে সব টিকেট শেষ হয়ে যায়। মঞ্চনাটকের জন্য দর্শকের এমন সাড়া আর আগ্রহ আশা জাগানিয়া হতে পারত যদি আমাদের দেশীয় ‘মানসম্মত’ প্রযোজনার ক্ষেত্রে অনুরূপ ভালোবাসা পাওয়া যেত। কিন্তু তেমনটা ঘটে না।

এরপরও টেলিভিশনের আগ্রাসনের সময়ে মঞ্চনাটকের প্রতি মানুষের এই আগ্রহ দেখে ভাল লাগল। রোজা থাকায় নিয়মিত সময়ের আধ ঘণ্টা পর নাটকটি মঞ্চায়নের পূর্ব ঘোষণা ছিল। ঠিক সোয়া ৭টায় মিলনায়তনের দরজা খুলে দেওয়া হয়। সুশৃঙ্খলভাবে দর্শক একে একে প্রবেশ করেন প্রেক্ষাগৃহে। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন অনেককেই দেখা গেল দর্শক সারিতে।

ঠিক সাড়ে ৭টায় বাদ্যযন্ত্র আর কণ্ঠের যুগল উদ্বোধনে নাটক শুরু হয়। সচরাচর পাশ্চাত্যের নাটকে যেমনটা দেখে থাকি, ধারণকৃত সঙ্গীতায়োজনের মধ্য দিয়ে মঞ্চায়ন, এই নাটকটি তেমন নয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই বাদ্যযন্ত্রে সুর তোলার পাশাপাশি গানে কণ্ঠ দেন। বাংলাদেশের নাটকের দর্শকের কাছে এ তেমন অভিনব কোনো দৃশ্য নয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে গীতবাদ্যের মধ্য দিয়েই ঐতিহ্যনিঃসৃত আঙ্গিকে এ ভূখণ্ডে নাট্যাভিনয় চলছে আর দর্শক তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার

কিন্তু চমৎকৃত হতে হয় তাদের অভিনয় এবং সংলাপ ছোড়ার পারঙ্গমতায়। প্রায় নির্ভুল কিউ আর সাবলীলতায় তারা ভুলিয়ে দিয়েছেন ভাষার ব্যবধান। শিক্ষিত কে আর জানে না ‘হ্যামলেট’ নাটকের কাহিনি? এ কারণে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর কিংবা চরিত্রের চলন-বলন-ঘটনা কোনো কিছুর বোঝাপড়াতে কারও তেমন সমস্যা হয়নি। হ্যামলেটের খানিক অসংলগ্ন আচরণ, বাবার আকস্মিক মৃত্যু, চাচা বিয়ে করেন মাকে, প্রেমিকা ওফেলিয়ার সঙ্গে অসফল পরিণতি, ওফেলিয়ার অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়া, অতঃপর মৃত্যু। পিতৃহত্যার কাহিনি মঞ্চায়ন, পিতার হত্যাকারী প্রার্থনারত চাচা অর্থাৎ সৎবাবাকে নাগালে পেয়েও প্রতিশোধ নিতে না পারা, তলোয়ার যুদ্ধের আয়োজন এবং হ্যামলেটকে বিষ মেশানো মদ পানের আহ্বান, সেই মদ পানে মায়ের মৃত্যু, সৎবাবাকে জোর করে সেই মদ খাইয়ে হত্যা, অতঃপর সেই বিষাক্ত পানীয় নিজে পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে হ্যামলেট, ইত্যকার সবকিছুই নিরাভরণ আর স্বল্প আয়োজনে সহজে বুঝিয়ে দেওয়া গেছে।

তাহলে এই প্রযোজনা বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে কেন? তার অনেক কারণ রয়েছে। তবে এত আড়ম্বরহীন আয়োজনে শেক্সপিয়ারের দীর্ঘতম ট্র্যাজেডিকে মঞ্চে উপস্থাপন এবং একইসঙ্গে দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। অথচ যে আশঙ্কা শুরুতে মনে উঁকি দিয়েছিল, আড়াই ঘণ্টার এই পরিবেশনায় দেড় ঘণ্টা পর ১৫ মিনিটের যে বিরতি সেই সময়েই হয়ত দর্শক আসন অর্ধেকই খালি পড়ে থাকবে- তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়ে যায় নাটক শেষে কানায় কানায় পূর্ণ মিলনায়তন দেখে।

নাটক শেষে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিনের হাত দিয়ে ‘হ্যামলেট’ নাটকের কলাকুশলীদের ক্রেস্ট তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।

২০১৬ সালে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ৪৫০তম জন্মজয়ন্তি। তার এই জন্মদিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অভিজ্ঞান হিসেবেই গ্লোব থিয়েটার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। বিশ্বের ২০৫টি দেশে নাটকটি মঞ্চায়ন হবে। তাদের এই যাত্রা শেষ হবে আগামী বছরের এপ্রিলে শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর দিনে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ ১২০টি দেশে মঞ্চায়ন হয়েছে নাটকটির।  

কিন্তু ভিন্ন ভাষার একটি নাটক এ দেশের দর্শকের কী উপকারে আসবে? যাদের আমন্ত্রণে গ্লোব থিয়েটার এসেছে নাটক মঞ্চায়ন করতে সেই ঢাকা থিয়েটারের প্রধান নাসির উদ্দীন ইউসুফের বক্তব্য থেকে তার উত্তর খোঁজা যেতে পারে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের জন্য এটি বড় অর্জন। মঞ্চকর্মীদের জন্যও এ মঞ্চায়নটির গুরুত্ব অনেক। এ কারণে যে, এতদিন পরে এসে তারা কীভাবে শেক্সপিয়ারের কাজকে মঞ্চে আনছে- সেটি আমাদের দেখা প্রয়োজন।”

সত্যিই তো। আন্তর্জাতিকতার এই সময়ে শুধু দেশীয় ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে থাকলে তা আমাদের সংকীর্ণই করে তুলবে। পারস্পরিক বিনিময়ের মধ্য দিয়েই আমাদের সংস্কৃতির আরও বিকাশ ঘটবে, বিশ্বের দরবারে আমাদের বার্তা পৌঁছাবে।

[প্রতিবেদনে ব্যবহার করা আলোকচিত্র ঢাকা থিয়েটারের আমিরুল রাজিবের সৌজন্যে]