ভালবাসার বিজ্ঞান

. অভিজিৎ রায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2013, 11:51 PM
Updated : 13 Feb 2013, 11:52 PM

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যখন তার গানে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সখি, ভালবাসা কারে কয়?’ তখন কি তিনি একটি বারের জন্যও ভাবতে পেরেছিলেন, এর উত্তর লুকিয়ে আছে তার সমসাময়িক একজন শখের প্রকৃতিবিদের গবেষণার মাঝে? হ্যাঁ, প্রেম ভালবাসা, রাগ, অভিমান, ঈর্ষা কিংবা সৌন্দর্যের অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য সবচেয়ে আধুনিক তত্ত্বগুলোর জন্য আমরা যার কাছে ঋণী, তিনি প্রেম-পিরীতি বা মান অভিমান নিয়ে গবেষণা করা কোন কেউকেটা দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী বা আর্ট কালচারের বিশাল বোদ্ধা বা পোস্টমডার্নিস্ট সমালোচক নন, তিনি ছিলেন এক নিবিড় প্রকৃতিপ্রেমিক, যিনি বিশাল আকারের পারিবারিক বাগানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতেন- চরম আগ্রহ আর পরম বিস্ময় নিয়ে অবলোকন করতেন যত রাজ্যের ফুল,পাখি, ছোট বড় উদ্ভিদ আর পোকামাকড়, যত্ন করে পালতেন গুবরে পোকা, কেঁচো আর কবুতর। তিনি চার্লস ডারউইন।

১৮৮২ সালে চার্লস ডারউইন যখন মারা যান, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র একুশ বছর। রবীন্দ্রনাথ ডারউইনের কোন লেখা দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন – এ ধরণের কোন প্রমাণ আমরা পাই না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘সখি, ভালবাসা কারে কয়?’ সহ বিভিন্ন গানের বহু জটিল অভিব্যক্তি এবং প্রশ্নগুলোর সার্থক ব্যাখ্যা ধীরে ধীরে হাজির করতে শুরু করেছে বিবর্তন মনোবিজ্ঞান, যে শাখার ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো বহু আগে চার্লস ডারউইন নামে রবীন্দ্রনাথেরই সমসাময়িক এক শখের প্রকৃতিবিদের হাত ধরে। আমি আমার বইয়ে দেখিয়েছি বিবর্তনগত জানা জ্ঞানের কল্যাণে প্রেম ভালোবাসার অন্তিম রহস্যগুলোর অনেক কিছুই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। ডারউইনের জগদ্বিখ্যাত “প্রজাতির উৎস (Origin of Species)’’ আর “মানুষের উৎপত্তি (The Descent of man)’’ বই দুটির মাধ্যমে এক সময় এ ধরণের অনুসন্ধানী কাজের সূত্রপাত ঘটলেও পরবর্তীতে প্রতিভাবান আরো কিছু বিজ্ঞানী যেমন -রবার্ট রাইট, রবার্ট ট্রিভার্স, স্টিভেন পিঙ্কার, ডেভিড বাস, হেলেন ফিশার, জিওফ্রি মিলার, রবিন বেকার, ম্যাট রিড্লী, ভিক্টর জন্সটন, ডনাল্ড সায়মন্স সহ অনেকেই এ নিয়ে নিবিষ্টভাবে গবেষণা করে নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন।

শুরু করা যাক সেই চিরপুরাতন অথচ সদা নতুন প্রশ্নটি দিয়ে। প্রেম কি? শেক্সপিয়র তার একটি নাটিকায় তার সৃষ্ট চরিত্রের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিলেন, “what ’tis to love?”[2]। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার একটি বিখ্যাত গানে একই ধরণের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন[3] -

সখি, ভাবনা কাহারে বলে ?

সখি, যাতনা কাহারে বলে ?

তোমরা যে বলো দিবস-রজনী – ‘ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা’

সখি, ভালোবাসা কারে কয়!

সেকি কেবলি যাতনাময়।

সেকি কেবলই চোখের জল?

সেকি কেবলই দুখের শ্বাস? …

কিন্তু কবিগুরু যখন ‘সখি ভালবাসা কাহারে বলে?’ বলে গানে গানে প্রশ্ন করেছিলেন কিংবা শেক্সপিয়র তার নাটকের সংলাপ লিখেছিলেন, “what ’tis to love?” বলে, তখন কি তারা একবারের জন্যও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষা করছে তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে? বিবর্তন মনোবিজ্ঞান সহ বিবর্তনের বিভিন্ন শাখা থেকে পাওয়া প্রান্তিক জ্ঞানের বদৌলতে প্রেমের এক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু দেয়া সম্ভব।

কিছুদিন আগেও আমরা ঢালাও ভাবে আমরা বলে দিতাম ভালবাসার কোন সংজ্ঞা নেই, বিজ্ঞান ভালবাসার কোন ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ইত্যাদি। সেই দিন আর নেই। বিজ্ঞান এখন চোরের মত সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে ভালবাসার গোপন কুঠুরিতে। চলুন আমরাও সে কুঠুরিতে পা রাখি…

কুদ্দুস আর সিমির প্রেম: নিশা লাগিলো রে…

কুদ্দুছ ‘লবে’ পড়িয়াছে। তাহার মন উড়ু উড়ু। পড়ালেখায় মন নেই। বই খুললেই কেবল সিমির মুখ ভেসে উঠে। আনমনে গাইতে থাকে আগুনের গান -

ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে মন বসে না

বই খুললেই দেখি তার মুখখানা

অস্থির মন আর বাধা মানে না।

একা পথে চললেই পাশে চলে সে

নিবিড় হয়ে সে বলে সে মোরে

ভালবাসি ভালবাসি ..।

ক্যামন যেন ঘোরের মধ্যে থাকে কুদ্দুস সর্বক্ষণ। একটা পাখি দেখলে মনে হয় - ইস পাখির মত ডানা মেলে যদি সিমির সাথে উড়ে বেড়ানো যেতো। একটা গোলাপ ফুল দেখলেই মনে হয় - আহা যদি সিমির হাতে তুলে দেয়া যেত! রাস্তার পাশে চটপটির গাড়ি দেখলে মনে হয় - আহা সিমির সাথে মিলে ফুচকা খাওয়া যেত!

না সিমির সাথে ফুচকা খাওয়া আর কুদ্দুসের হয়ে উঠে না। কারণ সিমি রাস্তার আজে বাজে জিনিস খায় না। সিমি মহা বড়লোকের মেয়ে। বসুন্ধরার আলীশান ফ্ল্যাটে থাকে। পাজেরো জিপে করে ভার্সিটিতে আসে। ড্রাইভার সাহেব দরজা খুলে দেয়, আর সিমি আলতো পায়ে গাড়ি থেকে নেমে সটান হাটা দেয় ক্লাসের দিকে। স্টিফেনি মেয়র কিংবা লিসি হ্যারিসনের ইংরেজি উপন্যাসের বই বগলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ‘হাবিজাবি পোলাপাইনরে’ পাত্তাই দেয় না সিমি। মোটের উপর সিমি জানেই না তার জন্য কোন এক মজনু দিওয়ানা!

আর ওদিকে তো মজনু কুদ্দুসের অবস্থা আসলেই কেরোসিন। সারাক্ষণই ঘোরের মধ্যে থাকে। মনে মনে আকাশ কুসুম কল্পনা। ভাবে কোনদিন হয়তো চলতে গিয়ে কিংবা সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে গিয়ে সিমি উষ্ঠা খেয়ে পড়বে, স্টেফানি মেয়ারের বইগুলো বগল থেকে ছিটকে পড়ে যাবে, আর ঠিক সেসময়ই বীর পুরুষের মতো রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটবে নায়করাজ কুদ্দুসের। পড়ে যাওয়া বইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সিমির হাতে তুলে দিবে, সিমি প্রথম বারের মতো অবাক নয়নে তাকাবে কুদ্দুসের দিকে, সে দৃষ্টিতে থাকবে আধো কৃতজ্ঞতা, আধো প্রেম, আর আধো রহস্যের ছোয়া…

নিশা লাগিলো রে,

বাঁকা দু’ নয়নে নিশা লাআগিলো রে …

কিন্তু সাতমন ঘিও পুড়ে না, আর সিমিও উষ্ঠা খায় না। আর কুদ্দুসের প্রেমের শিকেও ছিঁড়ে না। কিন্তু ছিঁড়ে না ছিঁড়ে না বলেও শেষ পর্যন্ত ছিঁড়লো একদিন। ক্যামনে? ক্যামনে আর, এমনে -

চোখ থাকলেই চোখাচোখি হবে।

হল!

এখানেই শেষ হতে পারতো -

না, প্রেম হয়ে গেল!

তা কুদ্দুস-সিমির প্রেম ক্যামনে হল, আর তারপর আর কী কী হল আমরা আর সেখানে এখন না যাই। আমরা বরং চিন্তা করি - কুদ্দুসের এই সদা ঘোর লাগা অবস্থার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি? এ নিয়ে বছর কয়েক আগে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার এবং স্নায়ুচিকিৎসক লুসি ব্রাউন, আর্থার অ্যারোন প্রমুখ বিজ্ঞানীরা প্রায় ৪০ জন প্রেমে পড়া ছাত্রছাত্রীদের উপর এক গবেষণা চালান[4]। তাদের গবেষণার ধরণটি ছিলো এরকমের। প্রেমিক-প্রেমিকাদের সামনে তাদের ভালবাসার মানুষটির ছবি রাখা হল, এবং তাদের মস্তিষ্কের ফাংশনাল এমআরআই (fMRI) করা হলো। দেখা গেলো, এ সময় তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল এবং কডেট অংশ উদ্দিপ্ত হচ্ছে, আর সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামক এক রাসয়ায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটছে। অবশ্য কারো দেহে ডোপামিন বেশি পাওয়া গেলেই যে সে প্রেমে পড়েছে তা নাও হতে পারে। আসলে নন-রোমান্টিক অন্যান্য কারণেও কিন্তু ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়তে পারে। যেমন, গাঁজা কিংবা কোকেইন সেবন করলে। সেজন্যই আমরা অনেক সময়ই দেখি ভালবাসায় আক্রান্ত মানুষদের আচরণও অনেকটা কোকেইনসেবী ঘোরলাগা অবস্থার মতোই টালমাটাল হয় অনেক সময়ই।

তবে ভালবাসার এই রসায়নে কেবল ডোপামিনই নয় সেই সাথে জড়িত থাকে অক্সিটাইসিন, ভেসোপ্রেসিন সহ নানা ধরণের বিতিকিচ্ছিরি নামের কিছু হরমোন। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই হরমোনগুলো নাকি ‘ভালবাসা টিকিয়ে রাখতে’ মানে প্রেমিক প্রেমিকার বন্ধন দীর্ঘদিন জোরালো করে রাখতে সহায়তা করে। এমনকি বিজ্ঞানীরা এও বলেন কেউ মনোগামী হবে না বহুগামী হবে - তা অনেকটাই কিন্তু নির্ভর করছে এই হরমোনগুলোর তারতম্যের উপর। দেখা গেছে রিসেপটর বা গ্রাহক জিনে ভেসোপ্রেসিন হরমোনের আধিক্য থাকলে তা পুরুষের একগামী মনোবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করে। বিজ্ঞানীরা প্রেইরি ভোলস আর মোন্টেইন ভোলস নামক দুই ধরণের ইঁদুরের উপর গবেষণা চালিয়ে তারা দেখেছেন, একগামিতা এবং বহুগামিতার মত ব্যাপারগুলো অনেকাংশেই হরমোনের ক্রিয়াশীলতার উপর নির্ভরশীল। এমনকি বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম উপায়ে ভেসোপ্রেসিনের প্রবাহকে আটকে দিয়ে একগামী ইদুঁরকে বহুগামী, কিংবা অতিরিক্ত ভেসোপ্রেসিন প্রবেশ করিয়ে বহুগামী ইঁদুরকে একগামী করে ফেলতে সমর্থ হয়েছেন। তবে ইঁদুরের ক্ষেত্রে যেটা সত্য তার পুরোটুকু মানুষের ক্ষেত্রে সত্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে। কারণ, মানুষের আবেগ অনুভূতি আর যৌনতার ব্যাপারগুলো অনেক অনেক জটিল।

কথা হচ্ছে তীব্র প্রেমের সময়গুলোতে কেন দ্বিগবিদ্বিগশূন্য নেশার ঘোর লাগা ভাবের উদয় হয়, কেন বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই লোপ পায়? কেনই বা ভয়ভীতি উবে যায় রাতারাতি? এ সময় বন্ধুদের পরামর্শও মাথায় ঢোকে না। যদি কেউ কুদ্দুসকে বলতো ‘ঐ ব্যাটা কুদ্দুস - সিমির পিছে অযথা ঘুইরা লাভ নাই, ওর জগৎ আর তোর জগৎ আলাদা…’ কুদ্দুসের মাথার পুরু দেওয়াল ভেদ করে সেই তথ্য পৌঁছুবেই না। কিন্তু কেউ যদি আবার উলটো বলে যে, ‘সিমি আজকে তোর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলো …’ সাথে সাথেই কুদ্দুসের মনে হবে এ যেন ‘সিন্ধু বিজয়’! আসলে তীব্র-প্রেমের সময়গুলোতে কেন মানুষজনের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায় তার একটা ভাল ব্যাখ্যা আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। আমাদের মস্তিষ্কে অ্যামাগডালা বলে একটি বাদাম আকৃতির প্রত্যঙ্গ আছে। সেটা এবং মস্তিষ্কের কর্টেক্সের কিছু এলাকা আমাদের ভয় ভীতি নিয়ন্ত্রণ করে, অকস্মাৎ বিপজ্জনক পরিস্থিতি আসলে আমাদের আগাম সতর্ক করে দিতে পারে। দেখা গেছে প্রেমের রোমাঞ্চকর এবং উত্তাল সময়গুলোতে মস্তিষ্কের এ এলাকাগুলোর কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ভয় ভীতি কিংবা ‘ক্রিটিকালি’ চিন্তা করার ব্যাপার স্যাপারগুলো পুরোপুরি লোপ পায় তখন। দুর্মুখেরা বলে, বেশি পরিমাণে গাঁজাভাঙ খেলেও নাকি ঠিক এমনটিই হয়।

বিবর্তন ও প্রেম

কুদ্দুসের এই কোকেইন মার্কা প্রেমানুভূতির মূল উৎস বা কারণ কি তাহলে? উত্তরটা কিন্তু খুব সোজা। ঘুরে ফিরে সেই একই ব্যাপার, যা বিবর্তনের একেবারে গোড়ার কথা - বংশাণু রক্ষার তাগিদ বা নিজের জিনকে টিকিয়ে রাখার অবচেতন প্রয়াস। আসলে প্রতিলিপি, পরিব্যক্তি এবং প্রকারণের সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন শুধু প্রেমানুভূতিই নয়, বস্তুত এটি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কামনা, বাসনা, প্রণয়, আকাঙ্ক্ষা সহ মানুষের সবধরণের অনুভূতি ও আচরণেরই জন্ম দেয়।

আসলে বংশাণু রক্ষার জন্য যে কোন প্রাণী অন্ততঃ দুটি কাজ সুচারু ভাবে করতে চায়। এক- প্রজননক্ষম বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চায়, আর দুই - সঠিক যৌনসঙ্গি নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের বংশাণু পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে চায়। সঠিক সঙ্গি নির্বাচন করাটা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিই প্রধাণতঃ প্রণয়াকাঙ্ক্ষার মূল উপলক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। ডারউইন নিজেও ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক চিন্তা করেছিলেন এবং তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনের (Natural selection) পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন (sexual selection)কেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন। না দিয়ে তো উপায় ছিলো না। ডারউইন লক্ষ্য করেছিলেন যে, প্রাণী জগতে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাচ্ছে যা কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারণ এ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে টিকে থাকার কথা নয়। এগুলো টিকে আছে, কারণ এই বৈশিষ্ট্যগুলো বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গির দ্বারা বংশপরম্পরায় দিনের পর দিন আদৃত হয়েছে। একটি ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে পুরুষ ময়ূরের দীর্ঘ পেখম থাকার উদাহরণ। এমন নয় যে দীর্ঘ পেখম পুরুষ ময়ূরকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে কোন বাড়তি উপযোগিতা দিয়েছিলো। বরং দীর্ঘ পেখম স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহতই করার কথা, এবং করেছেও। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে ময়ূরের দীর্ঘ পেখমকে ব্যাখ্যা করা যায় না। দীর্ঘ পেখম ময়ূরদের জন্য চরম অসুবিধাজনক। দীর্ঘ পেখম থাকলে দৌড়াতে অসুবিধা হয়, শিকারিদের চোখে পড়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশীমাত্রায়। কাজেই টিকে থাকার কথা বিবেচনা করলে দীর্ঘ পেখম ময়ূরের জন্য কোন বাড়তি উপযোগিতা দেয়নি বিবর্তনের পথ পরিক্রমায়। দীর্ঘ পেখম টিকে গেছে মূলত: নারী ময়ূর অর্থাৎ ময়ূরীর পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে। পুরুষ ময়ূরের লম্বা পেখমকে ভাল বংশাণুর নির্দেশক হিসেবে দেখত ময়ূরীরা । কাজেই দীর্ঘ পেখমের ঢেউ তোলা সুশ্রী ময়ূরেরা যৌনসঙ্গি হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছিলো, কারণ বিপরীত লিঙ্গের যৌনসঙ্গিদের কাছে তারা ছিলো একেকজন ‘ব্র্যাড পিট’ কিংবা টম ক্রুজ! তারাই শেষপর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলো ময়ূরীদের যৌনাকর্ষণের ভিত্তিতে[5]।

মোটা দাগে, যৌনতার নির্বাচন কোন বাড়তি সুবিধা দেয়া না প্রজাতির বেঁচে থাকায়। এগুলো কেবলই গয়নাগাটির মতো ‘অর্নামেন্টাল প্রোডাক্ট’। ময়ূরের পেখমের মত মানব সমাজেও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো অর্নামেন্টাল বা অলঙ্কারিক। কবিতা লেখা, গান করা থেকে শুরু করে গল্প বলা, আড্ডা মারা, গসিপ করা, ভাস্কর্য বানানো – প্রভৃতি হাজারো বৈশিষ্ট মানব সমাজে দেখা যায় যেগুলো স্রেফ অলঙ্কারিক – এগুলো বেঁচে থাকায় কোন বাড়তি উপাদান যোগ করেনি, কিন্তু এগুলো টিকে গেছে যৌন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে।

এই ‘মেটিং সিলেকশনের’ মায়াবী খেলা চলে কম বেশী সব প্রাণীর মধ্যেই। স্তন্যপায়ী প্রানীর প্রায় সব প্রজাতিতেই দেখা যায় পুরুষেরা সাধারণত অনেক বড় এবং বলশালী হয়, সেই সাথে দেখা যায় অনেক আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের সমাহার (যেমন, উজ্জ্বল রঙ, শিং, কেশর, দ্রুতগামিতা, ক্ষিপ্রতা, নৃত্য এবং সঙ্গীতে পারদর্শিতা ইত্যাদি)। মানুষও এর ব্যতিক্রম নয়। বড় চুল রাখা, দামী সানগ্লাস, কেতাদুরস্ত কাপড় পরা থেকে শুরু করে দামী গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষা, বাকচাতুর্য, প্রতিভা, নাচ, গান, বুদ্ধিমত্তা সবকিছুই মানুষ কাজে লাগায় বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণের কাজে। মানব সমাজের নারীপুরুষের বহু বৈশিষ্ট্য এবং অভিব্যক্তিই মোটা দাগে সম্ভবত: যৌনতার নির্বাচনের ফল। বিজ্ঞানী লীন মার্গুলিস ও ডরিয়ান স্যাগান “Mystery Dance: On the Evolution of Human Sexuality” বইয়ে খুব প্রাসঙ্গিক ভাবেই বলেছেন[6] -

“প্রযুক্তি কিংবা সভ্যতা আমাদেরকে আমাদের পশুত্ব থেকে খুব দূরে সরাতে পারেনি, বরং তা আরও জোরাল ভাবে সেটা অধিষ্ঠিত করেছে। সৌখীন চশমা, স্কন্ধালঙ্কার ইত্যাদি যেন অনেকটা ময়ূরের পুচ্ছের মতই।”

যৌনতার নির্বাচন আমাদের মানসপটে কাজ করে বলেই কারো সুন্দর চেহারা কিংবা মনোহারী ব্যক্তিত্ব দেখলে আমরা সবাই মনের অজান্তেই আন্দোলিত হয়ে উঠি। বঙ্কিমচন্দ্র যে একসময় বলেছিলেন, ‘সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র’ - ব্যাপারটা কিন্তু মিথ্যে নয় একেবারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা সংস্কৃতিভেদে সবাই বিপরীত লিঙ্গের যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে ‘আকর্ষণীয়’ বলে মনে করে সেগুলো হল - পরিষ্কার চামড়া এবং প্রতিসাম্যময় মুখ, পরিষ্কার চোখ, সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত, সতেজ এবং সুকেশী চুল এবং চেহারার গড়পড়তা। পরিষ্কার চামড়া[7] (Unblemished skin), স্বচ্ছ চোখ (clear eyes), সুন্দর এবং সুগঠিত দাঁত (intact teeth), সতেজ এবং সুকেশী চুল (luxuriant hair) কেন পছন্দনীয় তা বোঝা কঠিন কিছু নয়। এগুলো তারুণ্য, সুস্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি প্রজনন ক্ষমতার বাহ্যিক প্রকাশ ছিলো আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের কাছে। একই ব্যাপার খাটে প্রতিসাম্যময় মুখের (symmetrical face) ক্ষেত্রেও। এ ধরণের সুগঠিত চেহারা বিপরীত লিঙ্গের কাছে প্রমাণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো যে তার পছন্দনীয় মানুষটি অপুষ্টির শিকার নয়, কিংবা জীবাণু কিংবা পরজীবীদের আবাসস্থল নয়। অর্থাৎ এ বৈশিষ্ট্যগুলো ছিলো বংশাণু টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে সঠিক যৌনসঙ্গি নির্বাচনের একধরণের ‘সফল মার্কার’।

চেহারার গড়পড়তা ব্যাপারটা সাদা দৃষ্টিতে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কেন গড়পড়তা চেহারাকে ‘আকর্ষণীয়’ বলে মনে হবে? এটা মনে হয় কারণ, ‘গড়পড়তা চেহারা’ একটা বিশেষ ব্যাপারকে তুলে ধরে। সেটা হচ্ছে ‘জেনেটিক ডাইভার্সিটি’ বা বংশাণবিক বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য বজায় থাকা মানে বাহক অধিকতর রোগ প্রতিরোধে সক্ষম এবং প্রতিকূল পরিবেশে সহজে অভিযোজিত হবার ক্ষমতা সম্পন্ন বলে ধরে নেয়া হয়। আসলে আমরা যে গড়পড়তা চেহারাকে ‘সুন্দর’ বলে রায় দেই, তা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন একটি ছোট পরীক্ষার মাধ্যমে। নির্বিচারে ১০ টি চেহারা নিয়ে ফটোশপ কিংবা কোন প্রফেশনাল সফটওয়্যারে চেহারাগুলো মিশ্রিত (blend) করে উপস্থাপন করলে সেটিকে অধিকতর আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। নীচের ছবিটি লক্ষ্য করুন। প্রথম দুটো ছবিকে মিশ্রিত করে তৃতীয় ছবিটি তৈরি করা হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক জরিপে অধিকাংশ লোকই তৃতীয় ছবিটিকে অন্য দুটো ছবির চেয়ে অধিকতর আকর্ষণীয় বলে রায় দেয়!

তবে যৌনতার নির্বাচন শুধু অভিন্ন মানব প্রকৃতি গঠন করেছে ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। বহুক্ষেত্রেই এটি পার্থক্য সূচিত করেছে নারী পুরুষের পছন্দ অপছন্দে। অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি যৌনতার নির্বাচন আবার কাজ করেছে নারী-পুরুষের পার্থক্যসূচক মানস জগৎ তৈরিতেও – পলে পলে একটু একটু করে। আসলে সত্যি বলতে কি যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে পুরুষ যেমন গড়েছে নারীকে, তেমনি নারীও গড়েছে পুরুষের মানসপটকে। এক লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলোর আবেদন তৈরি করেছে আরেক লিঙ্গের চাহিদা। তৈরি এবং ত্বরান্বিত হয়েছে বিভিন্ন লিঙ্গ-ভিত্তিক নানা পছন্দ অপছন্দ। পুরুষ দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছে বলে স্বভাবে হয়ে উঠেছে অনেক সহিংস। আবার নারীরাও একটা সময় পুরুষদের এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, কারণ এ ধরণের পুরুষেরা নিজ নিজ ট্রাইবকে রক্ষা করতে পারত বহিঃশত্রুর হাত থেকে। এ ধরণের সমর দক্ষ পুরুষেরা ছিলো সবার হার্টথ্রব – এরা দিয়েছিলো নিজের এবং পরিবারের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা। এ ধরণের সাহসী পুরুষেরা নিজেদের জিন ছড়াতে পেরেছে অনেক সহজে, আমার মত কাপুরুষদের তুলনায়! ফলে নারীরাও চেয়েছে তার সঙ্গীটি কাপুরুষ না হয়ে সাহসী হোক, হোক বীরপুরুষ! এই ধরণের চাহিদার প্রভাব এখনো সমাজে দৃশ্যমান। ডেট করতে যাওয়ার সময় কোন নারীই চায় না তার সঙ্গী পুরুষটি উচ্চতায় তার চেয়ে খাটো হোক। সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এ যেন এক অলিখিত নিয়ম, শুধু আমেরিকায় নয়, সব দেশেই! বাংলাদেশে বিয়ে করতে গেলে পাত্রের উচ্চতা বউয়ের উচ্চতার চেয়ে কম দেখা গেলেই আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গাই-গুই শুরু হয়ে যায় মুহূর্তেই। খাটো স্বামীকে বিয়ে করতে হলে স্ত্রীরও মনকষ্টের সীমা থাকেনা। হাই হিল জুতো আর তার পরা হয়ে ওঠে না। আসলে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রভাব মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই এটি ঘটে। লম্বা চওড়া জামাই সবার আদরণীয়, কারণ একটা সময় লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান এই সব পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করতে পেরেছিলো স্বীয় গোত্রকে, রক্ষা করেছিলো উত্তরপুরুষের জিনকে - অন্যদের তুলনায় অনেকে ভালভাবে। সেই আদিম মানসপট আধুনিক মেয়েদের মনে রাজত্ব করে তাদের অজান্তেই!

আবার পুরুষদের মানসজগতেও নারীদেহের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে উদগ্র আগ্রহ দেখা যায় সম্ভবত: বিবর্তনীয় তথা যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানসপট তৈরি হবার কারণেই। যে কোন দেশের সাহিত্যের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে - নারীর পীনোন্নত স্তন, সুডোল নিতম্ব আর ক্ষীণ ক’টিদেশ নিয়ে যুগের পর যুগ কাব্য করেছে পুরুষ – সকল সংস্কৃতিতেই। কারণ নারীদেহের এই বৈশিষ্ট্যগুলোই সকল পুরুষের কাছে মহার্ঘ্য বস্তু। কিন্তু কেন? কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেন, আদিম সমাজে পুরুষদের কাছে বৃহৎ স্তন এবং নিতম্বের মেয়েরা অধিকতর আদৃত ছিলো প্রাকৃতিক কারণেই। বিপদ সঙ্কুল জঙ্গুলে পরিবেশে মেয়েদের বাচ্চা কোলে নিয়ে পুরুষদের সাথে ঘুরতে হত, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে হত এলাকায় খাদ্যস্বল্পতা দেখা দিলে। অতি আধুনিক কালের কৃষি-বিপ্লবের কথা বাদ দিলে মানুষকে আসলেই শতকরা নব্বই ভাগ সময় যুদ্ধ করতে হয়েছে খাদ্য-স্বল্পতার বিরুদ্ধে। যে নারী দীর্ঘদিন খাদ্য-স্বল্পতার প্রকোপ এড়িয়ে বুকের দুধ খাইয়ে বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তারা টিকে গেছে অনেক বেশি হারে। কাজেই কোন নারীর বৃহৎ স্তন পুরুষদের কাছে প্রতিভাত হয়েছে ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের জন্য ‘অফুরন্ত খাদ্যের ভাণ্ডার’ হিসবে। এ এক অদ্ভুত বিভ্রম যেন। এই বিভ্রম দীর্ঘদিন ধরে পুরুষকে করে তুলেছে পৃত্থুল স্তনের প্রতি আকর্ষিত। তারা লালায়িত হয়েছে, লুব্ধ হয়েছে – এ ধরণের দৈহিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে জৈবিক তাড়নায়। ঠিক একই ভাবে, বহিঃশত্রু যখন আক্রমণ করেছে তখন যে নারী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বাঁচতে পেরেছে, তাদের জিন রক্ষা পেয়েছে অনেক সহজে। এই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে নারীর কোমর হয়েছে ক্ষীণ, আর নিতম্ব হয়েছে সুদৃঢ়। আর এ বৈশিষ্ট্যগুলো পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি আদরণীয়।

নারীর সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষদের আগ্রহের অবশ্য আরো একটি বড় কারণ আছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন বিগত পাঁচ মিলিয়ন বছরে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। ফলে এটি বাচ্চার জন্মের সময় তৈরি করেছে জন্মসংক্রান্ত জটিলতার। এই কিছুদিন আগেও সাড়া পৃথিবীতেই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাওয়া মায়েদের সংখ্যা ছিলো খুবই উদ্বেগজনক-ভাবে বেশি। আজকের দিনের সিসেক অপারেশন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি এই জটিলতা থেকে নারীকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু আদিম সমাজে তো আর সিসেকশন বলে কিছু ছিলো না। ধারণা করা হয়, সভ্যতার ঊষালগ্নে ক্ষীণ নিতম্ববিশিষ্ট নারীদের মৃত্যু অনেক বেশি হয়েছে বড় মাথাওয়ালা বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে। টিকে থাকতে পেরেছে সুডোল এবং সুদৃঢ় নিতম্ব-বিশিষ্ট মেয়েরাই। কারণ তারা অধিক হারে জন্ম দিতে পেরেছে স্বাস্থ্যবান শিশুর। ফলে দীর্ঘদিনের এই নির্বাচনীয় চাপ তৈরি করেছে নারী দেহের সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক উদগ্র কামনা!

পুরুষের চোখে নারীর দেহগত সৌন্দর্যের ব্যাপারটাকে এতদিন পুরোপুরি ‘সাংস্কৃতিক’ ব্যাপার বলে মনে করা হলেও আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক দেবেন্দ্র সিংহ তার গবেষণা থেকে দেখিয়েছেন যে, সংস্কৃতি নির্বিশেষে নারীর কোমর এবং নিতম্বের অনুপাত ০.৬ থেকে ০.৮ মধ্যে থাকলে সার্বজনীনভাবে আকর্ষণীয় বলে মনে করে পুরুষেরা। অধ্যাপক সিংহের মতে মোটামুটি কোমর : নিতম্ব = ০.৭ - এই অনুপাতই তৈরি করে মেয়েদের ‘classic hourglass figure’, যা পুরুষদের মনে তৈরি করেছে আদি অকৃত্রিম যৌনবাসনা । সংস্কৃতি নির্বিশেষে এই উপাত্তের পেছনে সত্যতা পাওয়া গেছে বলে দাবী করা হয়[8]। সম্প্রতি পোলিশ একটি গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, সুডোল স্তন, সরু কোমর এবং হৃষ্ট নিতম্ব মেয়েদের সর্বোচ্চ উর্বরতা প্রকাশ করে, যার পরিমাপ পাওয়া গেছে দুটো প্রধান যৌনোদ্দীপক হরমোনের (17-β-estradiol & progesterone) আধিক্য বিশ্লেষণ করে[9]। পুরুষের মনে প্রথিত হওয়া যৌনোদ্দীপক কোমর/নিতম্বের অনুপাত আসলে তারুণ্য, গর্ভধারণক্ষমতা(Fertility) এবং সাধারণভাবে সুস্বাস্থ্যের প্রতীক। কাজেই এটিও পুরুষের কাছে প্রতিভাত হয় এক ধরণের ‘ফিটনেস মার্কার’ হিসেবে। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর জন্সটন তাঁর ‘Why We Feel? The Science of Emotions’ বইয়ে বলেন যে মেয়েদের কোমর ও নিতম্বের অনুপাত ০.৭ হলে এন্ড্রোজেন ও এস্ট্রোজেন হরমোনের যে অনুপাত গর্ভধারণের জন্য সবচেয়ে অনুকূল সেই অনুপাতকে প্রকাশ করে। এরকম আরেকটি নিদর্শক হল সুডৌল ওষ্ঠ। সেজন্যই গড়পড়তা পুরুষেরা এঞ্জেলিনা জোলি কিংবা ঐশ্বরিয়া রাইয়ের পুরুষ্টু ওষ্ঠ ছবিতে দেখে লালায়িত হয়ে ওঠে। কাজেই দেখা যাচ্ছে সৌন্দর্যের উপলব্ধি কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয়। এর সাথে যৌন আকর্ষণ এবং সর্বোপরি গর্ভ ধারণক্ষমতার একটা গভীর সম্পর্ক আছে, আর আছে আমাদের দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় পথ পরিক্রমার সুস্পষ্ট ছাপ।

বিবর্তনের ছাপ কেবল আমাদের দেহের উপরেই পড়েনি, পুরোমাত্রায় পড়েছে আমাদের মানসজগতের উপরেও। আমরা যেমন স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন সঙ্গী পছন্দ করি, তেমনি পছন্দ করি এমন কাউকে যে রসিকতা বুঝে, প্রেম ভালবাসার ব্যাপারে রোমান্টিক এবং বিশ্বস্ত, শিল্প সাহিত্য সঙ্গীতের ব্যাপারে সমঝদার। আমরা এ ধরণের গুণাবলীগুলো পছন্দ করি কারণ বিপরীত লিঙ্গের চাহিদাকে মূল্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক অভিযোজিত হয়েছে আর আমাদের পছন্দ অপছন্দ আর ভালোলাগা গুলো বিবর্তিত হয়েছে যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরে। যৌনতার নির্বাচনই আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি করেছে গান বাজনা, নৃত্য গীত, কাব্য, শিল্প সাহিত্য, স্থাপত্যকর্ম, খেলাধুলা, বাগ্মিতা প্রভৃতির প্রতি অনুরাগ। যাদের মধ্যে এ গুণাবলীগুলো আমরা খুঁজে পাই, তারা অনেক সময়ই হয়ে উঠে আমাদের পছন্দের মানুষজন। বিখ্যাত বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলার তার বহুল প্রচারিত ‘মেটিং মাইণ্ড’ বা ‘সঙ্গমী মনন’ বইয়ে[10] দাবী করেছেন মানুষের মস্তিস্ক এবং এর আচরণের অনেক কিছুই আসলে যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে আমাদের পছন্দ আপছন্দ অভিরুচিকে মূল্য দিয়ে। পাঠকেরা যদি এ বিষয়ে আরো জানতে চান, তবে জিওফ্রি মিলারের ‘মেটিং মাইণ্ড’ বইটি আমি পড়ে দেখতে উৎসাহিত করব।

‘A Midsummer Night’s Dream’ নাটিকায় শেক্সপিয়র উচ্চারণ করেছিলেন, ‘Love looks not with the eyes but with the mind’। শেক্সপিয়র মিথ্যে বলেননি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার একটি গানে যে কথাটি বলেছিলেন, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’; সেই কথাটিকেই সামান্য বদলে দিয়ে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বললে বলা যায় -

চোখের আলোয় দেখেছিলেম মনের গভীরে।

অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে।।

এক ধরণের বিদ্রোহ ভালবাসা, এক ধরনের বিদ্রোহ হল দাবী

আমরা জানি, এবারের ভ্যালেণ্টাইন্স ডে অন্যান্য বারের মতো নয়। এ বছরের ভালবাসা দিবস আক্ষরিক অর্থেই যেন অনন্য। শাহবাগ চত্বরে কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবীতে উত্তাল হয়ে উঠেছে তরুণ প্রজন্ম। বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত তরুণ তরুণীদের বুকে বোধ হয় একটু বেশিই অনুভূত হবে ভালবাসার আগুন। প্রতিভাত হবে তাদের চোখের চাহনি, শরীরী ভাষা আর গোলাপ বিনিময়ে। তাদের নীল খামে হয়তো থাকবে লিপস্টিকের হাল্কা দাগ। মুঠোফোনের বার্তা, ই-মেইল কিংবা ফেসবুক ভরে উঠবে প্রেম-কথার কিশলয়ে। তারা হয়তো সুমনের গানের মতো করেই গাইবে –

‘এক ধরণের বিদ্রোহ ভালবাসা

এক ধরনের বিদ্রোহ হল দাবী

উগ্র প্রেমের ছুরিতে দিচ্ছি শান

দখল করব জীবনের মৃগনাভি’

পাঠকদের সবাইকে ডারউইন দিবস এবং ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।

তথ্যসূত্র:

[2] William Shakespeare (1564–1616), Dialogue between Phebe and Silvius, in As You Like It, act 5, sc. 2, l. 83-98.

[3] গানটি ইউটিউবে শোনা যাবে শ্রাবনী সেনের কণ্ঠে, এই লিঙ্ক থেকে -

http://www.youtube.com/watch?v=emvIYPWbqDk

[4] Helen Fisher, What is Love?, On Air, BBC International Magazine 98:12-15

[5] এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, যৌনতার নির্বাচন কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন থেকে একটু আলাদা। যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত বৈশিষ্টগুলো বেঁচে থাকায় বাড়তি উপাদান যোগ করে না, এগুলো বৈশিষ্ট হিসেবে থেকে যায় কেবল বিপরীত লিঙ্গের পছন্দ এবং অভিপ্রায়কে মূল্য দিয়ে। তারপরও, ময়ূরের যে পেখম বেঁচে থাকায় কোন সহায়তা দিচ্ছে না, সেটা কেন বিপরীত লিঙ্গের অর্থাৎ ময়ূরীর কাছে কাছে সৌন্দর্য হিসেবে প্রতিভাত হবে – এই প্রশ্ন করা যেতেই পারে। এর কারণ হল, যে ময়ূরের দীর্ঘ পেখম আছে, সে ময়ূর জেনেটিকভাবে অধিকতর ‘ফিট’ বলে ময়ূরীর কাছে প্রতিভাত হয়; কারণ, দীর্ঘ পেখম তৈরি এবং এবং এর অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠে টিকে থাকায় কিছু বাড়তি শক্তি ব্যবহার করতে হয়। যারা এটা করতে পারে, ময়ূরীর কাছে তারাই ‘সুন্দর’! ইসরাইলী বিজ্ঞানী জাহাবির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রিন্সিপাল আছে – Handicap principle, যার আলোকে আলোকে ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করা যায়। বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ে ব্যাপারটি নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন।

[6] Lynn Margulis and Dorion Sagan , Mystery Dance: On the Evolution of Human Sexuality, Touchstone Books , 1992; উদ্ধৃতিটির অনুবাদ পাওয়া যাবে, অপার্থিব, ভালবাসা ও বিবর্তন, মুক্তমনা, ২৯ মাঘ ১৪১৬ (ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১০) প্রবন্ধে।

[7] পরিস্কার চামড়া বলতে এখানে সাদা চামড়া বোঝানো হচ্ছে না, বোঝানো হয়েছে Unblemished skin বা নিষ্কলঙ্ক চামড়াকে। বলা বাহুল্য, সাদা, কালো বাদামী সব চামড়াই আনব্লেমিশড বা নিষ্কলঙ্ক হতে পারে। এই নিষ্কলঙ্ক চামড়া এক ধরণের ‘ফিটনেস মার্কার’ ছিলো আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে সংগী নির্বাচনে বলে ধারনা করা হয়, কারণ এ ধরণের চামড়া সুস্থতার প্রতীক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিলো তাদের কাছে।

[8] Singh, D. (2002) Female Mate Value at a Glance: Relationship of Waist-to-Hip Ratio to Health, Fecundity, and Attractiveness. Neuroendocrinology Letters. Special Issue, 23, 81-91.

[9] Jasienska, G., Ziomkiewicz, A., Ellison, P.T., Lipson, S.F., Thune, I. (2004)“Large breasts and narrow waists indicate high reproductive potential in women.” Proceedings of the Royal Society of London “B”, 271: 1213-1217

[10] Geoffrey Miller, The Mating Mind: How Sexual Choice Shaped the Evolution of Human Nature, Anchor, 2001