লেখকদের লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

. মাসুদুজ্জামানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2013, 02:06 AM
Updated : 13 Feb 2013, 02:30 AM

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৬) আমাদের প্রধান কথাসাহিত্যিক। শুধু আমাদের নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে যদি বিবেচনা করি, তাহলে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পাশাপাশি তাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারণ করতে হবে। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর স্থান এখন প্রায় শীর্ষে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, কটা উপন্যাস আর গল্পই-বা লিখেছিলেন তিনি? উপন্যাসের সংখ্যা মাত্র দুটি, গল্পের সংখ্যা সবমিলিয়ে ২৭/২৮টি। এর বাইরে ইলিয়াসের আছে একটি প্রবন্ধ সংকলন আর কিছু কবিতা। সবমিলিয়ে তাঁকে স্বল্পপ্রসূ লেখকই বলা যায়। কিন্তু সংখ্যায় নয়, গুণগত বিচারে তিনি সবাইকে প্রায় ছাড়িয়ে গেছেন। উপন্যাস রচনায় সমকালে তাঁর সমতুল্য একজন লেখককেও খুঁজে পাওয়া যাবে না- কী বাংলাদেশে, কী পশ্চিমবঙ্গে। গল্প রচনাতেও তিনি প্রথাগত পথ পরিত্যাগ করে একেবারেই নিজস্ব একটি ঘরানা তৈরি করে নিয়েছিলেন।

তাঁর আবির্ভাবের কালটিও আমাদের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে-বছর জন্মগ্রহণ করেন তার চার বছরের মাথায় ভারত-বিভক্তি ঘটে যায়। এই বিভক্তি, বলা বাহুল্য, এই অঞ্চলের মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল নতুন এক পরিস্থিতির মুখে। বিভক্তির আগেও সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই বঙ্গভূমিতে যে আলোড়ন তুলেছিল, তার দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল এই অঞ্চলের মানুষের জীবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তখন যেমন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল, তেমনি প্রধান দুটি সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল তীব্র টানাপোড়েন। রাজনৈতিকভাবে ‘স্বাধীনতা’র নামে তখন দেশভাগ হয়ে যায় ঠিকই, তবে অমানবিক বিপর্যয়ের শিকার হতে হয় পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু আর মুসলমানদের। ইলিয়াসের রচনাসমগ্রেও এর তীব্র, গভীর প্রভাব পড়েছে।

ইলিয়াস আমাদের মধ্যে আরেক বিস্ময়কর গৌরবদীপ্ত অনুভবের জন্ম দিয়েছেন। সেটি হল, তিনিই হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রথম সচেতন কথাশিল্পী রাজনৈতিক পটভূমিতে যার রচনায় উপজীব্য হয়েছে বৃহত্তর জনমানুষের জীবন। ১৯৬০-এর দশকে তিনি যখন লেখালেখি শুরু করেন, ততদিনে বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্প সাবালকত্ব অর্জন করে ফেলেছে। বাংলাদেশের প্রথম দিককার উপন্যাসগুলো লেখা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কিংবা তার ঠিক পরপর। ইতিমধ্যে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পেরিয়ে আবির্ভাব ঘটে গেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিন আধুনিক ঔপন্যাসিক ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। বাঙালি মুসলমান লেখকদের পদচারণায় বাংলাদেশের কথাসাহিত্য তখন মুখরিত। প্রচণ্ড না হলেও বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে যুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তরের ধাক্কা বেশ ভালোভাবেই এসে লাগে। সেই সঙ্গে তীব্রতা পায় পাকিস্তান আন্দোলন, বেধে যায় দাঙ্গাহাঙ্গামা, ঘটে দেশভাগ। কিন্তু ওই সময়ে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে যারা উপন্যাস লিখছিলেন আবুল ফজল, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, আবু ইসহাক, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, রশীদ করীম, সরদার জয়েনউদ্দিন তাঁদের কারও রচনাতেই ওই সময়ের তীব্রমোথিত ঘটনার প্রতিফলন পড়েনি। গ্রামের যে চেহারা পাওয়া গেল তা সামন্তশাসিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিবর্ণ, দুর্ভিক্ষপীড়িত, স্থবির গ্রাম। দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ রাজনীতির পটভূমিতে ব্যক্তিক অস্তিত্বের অন্তর্গত সংকটকে কোনো ঔপন্যাসিকই তাদের রচনার বিষয় করে করে তুলতে পারলেন না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন অবশ্যই ব্যতিক্রম, ওই সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ঔপন্যাসিক। ভাষাশৈলী ও ব্যক্তিক অস্তিত্বের সংকট উন্মোচনে তাঁর সিদ্ধি অবিস্মরণীয়, কিন্তু তাঁর রচনাতেও রাজনীতি বা উপনিবেশলাঞ্ছিত মানুষের ছবি ভালোভাবে পাওয়া গেল না। উপজীব্য হলো না উপনিবেশ-কবলিত বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক জীবন। পরে অবশ্য তিনি লিখেছেন আগলি এশিয়ান-এর মতো উপন্যাস, তবে সে তো ইংরেজিতে।

জীবনের ছবি নয়, জীবনাভিজ্ঞানই যে উপন্যাসের মর্মকথা, সেকথা আমাদের শুনিয়েছেন আধুনিক নন্দনতাত্ত্বিক ইতালির উমবার্তো একো। কিভাবে এই অভিজ্ঞানকে ছুঁয়ে দেওয়া যাবে? আমাদের আরেক প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘একমাত্র সজ্ঞান ও সচল প্রয়াস ছাড়া’ অর্জন করা যাবে না সেই শিল্পসিদ্ধি। ইলিয়াসের ছিল এই সচেতন অভিপ্রায় — বিস্ময় এইখানেই। দুটি উপন্যাসেই তার প্রতিভার অবিস্মরণীয় বিচ্ছুরণ ঘটলো কী বিষয়বস্তুতে, কী শৈলীসম্পাতে। চলমান রাজনীতির ধারাপ্রবাহের পটভূমিতে ব্যক্তির অস্তিত্বমোথিত এমন গাথা তিনি রচনা করলেন, যা শুধু বাংলা সাহিত্যেই অনন্য হয়ে ওঠেনি, বিশ্বসাহিত্যেরও হয়ে উঠেছে প্রতিস্পর্ধী। প্রথমেই ইলিয়াসের এই উপন্যাস প্রসঙ্গ।

কী রকম হওয়া উচিত সমকালীন উপন্যাস? অন্যান্য শিল্পের মতো একক কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে এর প্রকৃত চিহ্নায়ন সম্ভব নয়। তবু মিলান কুন্ডেরা একবার বলেছিলেন, উপন্যাসে ‘ব্যক্তির আত্মসত্তার অন্তর্গত জীবনের উন্মোচন’ ঘটিয়ে থাকেন ঔপন্যাসিক। ইলিয়াসও এটা জানতেন, “কথাসাহিত্যচর্চার সূত্রপাত মানুষ যখন ব্যক্তি হয়ে উঠছে এবং আর দশজনের মধ্যে বসবাস করেও ব্যক্তি যখন নিজেকে ‘একজন’ বলে চিনতে পারছে তখন থেকে।” ইলিয়াসও খুঁজছিলেন এই ব্যক্তিকে। আখ্যানের মধ্য দিয়ে গেঁথে তুলতে চাইছিলেন ‘ব্যক্তির অস্তিত্বের বোধ আর প্রাতিস্বিকতা’কে। কিন্তু ফ্রেডেরিক জেমিসন যেমন বলেছেন, পুঁজিবাদী বিশ্বরাষ্ট্র পুঁজিবাদের অন্তিমপর্বে ‘ব্যক্তিকে আমুণ্ডু গিলে খেয়ে ফেলেছে,’ তখন সেই ব্যক্তির ওপর ভর করে উপন্যাস লেখা হবে কী করে? ইলিয়াসের উপন্যাস আলোচনা প্রসঙ্গে হাসান আজিজুল হক জানাচ্ছেন, এই শূন্যতার মাঝে উপন্যাস রচনায় সাহিত্যতত্ত্ব যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে সাহায্য করেনি, তেমনি ‘উপন্যাসের বুর্জোয়া মডেল’ও নয়। বাংলা ঔপন্যাসিকদের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাননি তিনি। উপন্যাস রচনার বিকল্প পথের ধারণাটা তাঁর এসেছিল লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার কথাসাহিত্য থেকে চিলেকোঠার সেপাই রচনার সময়ে যেমন, তেমনি খোয়াবনামার সময়েও। এই আখ্যানদ্বয়ে পশ্চিমী ঘরানার ব্যক্তি নয়, ইতিহাস নয়, জনপদই হয়ে উঠলো উপন্যাসের নায়ক। হাসান আজিজুল হকের ভাষায়, “ব্যক্তি নয়, উপন্যাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ব্যক্তিকে সরিয়ে দিয়ে ইতিহাস সামনে চলে আসছে, ইতিহাসই ব্যক্তি। একটা গোটা জনপদ তার ক্ষয় ধস নামহীনতা ইতিহাসহীনতা নিয়ে উপন্যাসের নায়ক উপন্যাসের চেনা সত্তাটাকে ছোবড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন একটা পথ বের করতে পেরেছে।” ইউরো-মার্কিন উপন্যাসের পুরনো ধারাকে এভাবেই অস্বীকার করেছিলেন ইলিয়াস, বিশেষ করে খোয়াবনামায় : “সে কি বাংলার এই প্রাচীন ভূমি, তার ইতিহাস, তার স্মৃতি-বিস্মৃতি নয়? তার ভাঙাগড়ার অবিরল প্রক্রিয়ার ভেতর জনপদগুলো সেইসব জীবন্ত জনপদ, সেইসব নিশ্চল জনপদ, সেইসব ইতিহাসহীন বা ইতিহাসবিচ্যুত জনপদ, মানুষের টাটকা রক্ত, বাসি রক্ত। এই বাস্তব আর ইতিহাস মিলে লিখিত হলো খোয়াবনামা। কোন মডেল অনুসৃত হয়েছে দেখতে যাওয়া বিড়ম্বনা। আর কে না জানে এই কালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলি খোয়াবনামা মানের। নোবেল পুরস্কার-টুরস্কার কোন ব্যাপারই নয় (হাসান আজিজুল হক)।’

খোয়াবনামা আর চিলেকোঠার সেপাই এই প্রেক্ষাপটেই হয়ে উঠেছে এপিক। আখ্যানের বুনন আর ভাষারীতিই যে কথাশিল্পের মূলকথা নয়, সে তো অনেক আগেই জেনে গেছি আমরা জেমস জয়েসের সূত্রে। সমকাল কীভাবে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, দেখিয়ে গেছেন জয়েস। একারণেই চিলেকোঠার সেপাইয়ের বয়ানভঙ্গি ও চরিত্রচিত্রণের সঙ্গে জয়েসের ইউলিসিসের মিল খুঁজে পাওয়া যায় এর ডিটেল্স ও মনোজাগতিক জৈবরসায়নে। এরপর মার্কেজের মধ্য দিয়ে কিংবদন্তী আর ইতিহাস কীভাবে আঁশটে নোনাধরা অতীত থেকে উঠে এসে সমকালকে স্পর্শ করতে পারে, সেও তো জানা হয়ে গিয়েছিল। খোয়াবনামায় তো ঘটলো এই বয়ানভঙ্গি ও আখ্যানগঠনের মৌলিক দ্যুতিময় বিচ্ছুরণ। একারণেই আমরা অবাক হই না যখন শওকত আলীর স্মৃতিচারণায় শুনি, জয়েস ছিলেন ইলিয়াসের একজন প্রিয় লেখক, তেমনি ছিলেন মার্কেজও। অতীত তাই মৃত কিছু নয়, অতীত ‘সমকালীন সমাজের অবস্থান ও বিকাশকে’ যেমন বুঝতে সাহায্য করে’, তেমনি ‘ভষ্যিতের সঙ্গে যোগাযোগ’ ঘটাতে সক্ষম হয়। এরকমটাই ভাবতেন ইলিয়াস।

ইলিয়াস এভাবেই ইতিহাসমোথিত সময়, মানুষ আর সমাজকে উপজীব্য করেছেন তাঁর উপন্যাসে। তিনি যথার্থই জানতেন ঔপন্যাসিকের এটাই মূল কাজ, “সমাজের বাস্তব চেহারা তাঁকে তুলে ধরতে হয় এবং শুধু স্থিরচিত্র নয়, তার ভেতরকার স্পন্দটিই বুঝতে পারা কথাসাহিত্যিকের প্রধান লক্ষ্য।” কিন্তু কিসের টানে এই কাজটি করবেন তিনি? লক্ষ্য সেই ‘ব্যক্তির স্বরূপসন্ধান’ আর সমকালকে এই সময়ের পাঠকের কাছে মূর্ত করে তোলা। তবে ব্যক্তির যে বিকাশ ও পরিণতি তাঁর অন্বিষ্ট ছিল, তার সবই ঘটেছে ‘ব্যক্তিপ্রেক্ষিত, সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি’র প্রেক্ষাপটে। ইলিয়াস মনে করেছেন, যে-সমাজ অনড়, অচল, স্থবির, গতি নেই, সেই ধরনের স্পন্দনহীন সমাজের রূপকার নন ঔপন্যাসিক। সমাজ উপন্যাসে ‘রক্তমাংস নিয়ে হাজির হয়’ কিনা, আর ব্যক্তি সেই সমাজের মধ্যে ‘উপযুক্ত প্রেক্ষিত পায়’ কিনা, সেই দিকগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজপ্রেক্ষিতনির্ভর ব্যক্তির এই গতিময় ডিটেলসমৃদ্ধ জীবনযাপনের কথা না থাকলে কোনো উপন্যাস সম্পূর্ণতা পায় না, এরকমই ভাবতেন ইলিয়াস। আর এই ভাবনার প্রেক্ষাপটেই তিনি মনে করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ই ছিলেন ‘আন্তর্জাতিক’ মাপের কথাসাহিত্যিক। লক্ষণীয়, ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামায় বিভিন্ন চরিত্রের সামাজিক জীবন এবং ব্যক্তির জীবনযাপনের যে অনুসূক্ষ্ম ডিটেলসমৃদ্ধ গতিশীল বর্ণনা পাই, তার পূর্বসূত্র শুধু খুঁজে পাওয়া যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে। এরই সঙ্গে তাঁর উপন্যাসে এসে মিশেছিল মার্কেজের মহাকাব্যিক মেজাজ। কিংবদন্তী, লোককথা, লোকগান, প্রবাদ-প্রবচন, পুরাণ আর সমাজের অনুপুঙ্খ বর্ণনার সঙ্গে অবিমিশ্র হয়ে গিয়েছে ইতিহাস ও রাজনীতি। এই প্রেক্ষাপটে ইলিয়াস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে যেকথা বলেছিলেন, তা তার উপন্যাস সম্পর্কেও বলতে পারি আমরা : “নিজস্ব প্রকরণ তিনি অর্জন করেছিলেন, ভাষার বুনট, চরিত্রসৃষ্টি, মনোবিশ্লেষণ, মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সম্পর্ক যাচাই করা, সমাজের সঙ্গে ব্যক্তি ও ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর উৎকর্ষ যে-স্তরে পেঁছেছিল, তার সাহায্যে একজন শিল্পী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা পেতে পারেন।”
এই সূত্রেই মনে পড়ছে হাসান আজিজুল হকের সেই কথাটিও, ইলিয়াসের উপন্যাস প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বমানের, নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন যেসব কথাসাহিত্যিক, তিনি ছিলেন সেই মাপেরই লেখক।

শুধু কী উপন্যাস রচনায় অদ্বিতীয় হয়ে আছেন ইলিয়াস? একেবারেই নয়। তাঁর গল্পগুলিও বাংলা গল্পঘরানার উল্টো দিক থেকে রচিত। বাংলা কথাসাহিত্য সামগ্রিকভাবে মধ্যবিত্তের রচনা, মধ্যবিত্তই এর পাঠক। মধ্যবিত্তের রুচি, মনমানসিকতাই প্রতিফলিত হয়ে আসছে বাংলা ছোটগল্পে। কী এর ভাষা, কী এর বিষয়আশয়, মধ্যবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে কখনও কখনও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ বা কৃষকজীবনকে স্পর্শ করলেও বাংলা ছোটগল্প ওই মধ্যবিত্তের গণ্ডিতেই আটকে ছিল। কিন্তু ইলিয়াসই প্রথম ভেঙে দিলেন সেই বৃত্ত। বিষয়ের এই অভিনব উদ্ভাসের ফল হিসেবেই তাঁর গল্পের ভাষারীতিকে যাবতীয় ছুৎমার্গ থেকে মুক্তি দিতে পেরেছেন। মধ্যবিত্তের রুচি আর দেখার চোখটাকেও বদলে দিয়েছেন তিনি।

মধ্যবিত্তের বৃত্তাবদ্ধ ব্যক্তিজীবন, স্বরচিত নৈঃসঙ্গ্য, কু-লায়িত আত্মরতি অথবা তীব্রমোথিত রোমান্টিকতা আর স্বপ্নলোকের কথায় ভরা ছিল বাংলা সাহিত্য। নিম্নবিত্তের জীবনকে যে তা ছুঁতে চায়নি তা নয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিজীবনকে গল্পকারেরা প্রত্যক্ষ করেছেন কিছুটা আর্দ্র, করুণ রঙিন চোখে। এই দৃষ্টিকোণ নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের উঁচুনিচু অবস্থাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে লেখক কখনই যে-ব্যক্তিমানুষকে উপজীব্য করতে চান, সেই সমতলে নেমে আসতে পারেননি। কিন্তু ইলিয়াস নিম্নবৃত্তের সেই স্তরে নেমে এসেছেন, যেখান থেকে চরিত্রগুলোকে তাদের নিজস্ব পরিম-ল থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। তাদের একজন হয়ে ওঠা যায়। বাংলা ছোটগল্পে যে ‘রূপকথা-লোলুপতা’ ছিল, সেখান থেকে তিনি সরে এসে কর্কশ, তিক্ত, ‘ফাঁস-লাগানো’ বাস্তবতাকেই গল্পের পর গল্পে উপস্থাপন করে গেছেন। বিষয়ের এই টানে নতুন এক ভাষারীতি ও বর্ণনাভঙ্গিও তিনি আবিষ্কার করে নিয়েছিলেন। এই কারণেই অনেকের কাছেই মনে হতে পারে তাঁর গল্পের ভাষা অশ্লীল, খিস্তিখেউরে ভরা, অমার্জিত, শ্লেষমিশ্রিত। হাসান আজিজুল হকেরও একসময় মনে হয়েছিল, ‘নিষ্ঠুরতা, আক্রোশ, বিবমিষা কিংবা তীব্য ঘৃণা’ই গুরুত্ব পেয়েছে ইলিয়াসের কাছে। তাঁর গল্পগুলি ‘নিষ্করুণ ব্যক্তিবাদিতা’র বন্দনা মাত্র। জীবন, সমাজ বা মানুষ সম্পর্কে গভীরতর কোনো সত্য তাতে প্রতিফলিত হয়নি। তাঁর গল্পগুলি উদ্দেশ্যহীন রচনা। কিন্তু এই মন্তব্যটি হাসান করেছিলেন সেই ১৯৭৯ সালে লেখা একটা প্রবন্ধে। পরে তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, বাংলা ছোটগল্পের তথাকথিত ‘পুতু পুতু’ ধারণাকে কিভাবে ভেঙে দিতে চাইছেন ইলিয়াস। গড়ে তুলছেন ছোটগল্পের এক নতুন ধারা। নিম্নবিত্তের জীবনকে যে তাদের স্তরে নেমেই প্রত্যক্ষ করা দরকার, সেকথা বুঝতে তাঁর ভুল হয়নি।

উল্লিখিত বিষয়ের টানে ইলিয়াসের গল্পের ভাষাও হয়ে উঠেছে অনন্য। ভাষাই হচ্ছে তার গল্পের প্রধান শক্তি। যে-মানুষগুলো তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে এসেছে, তাদের মুখের ভাষা সেইভাবে তুলে না আনলে চরিত্রগুলোই তো ফুটতো না। এরা হচ্ছে আসলে সেই নিম্নবিত্তের মানুষ যাদের ভাষাপরিবেশই এরকম, মধ্যবিত্ত রুচির কাছে তা অমার্জিতই মনে হবে। কিন্তু ওই মানুষগুলোর কাছে এটা সহজ একধরনের প্রকাশভঙ্গি মাত্র। বিষয়, চরিত্র আর ভাষার এই অবিমিশ্রতা সম্পর্কে ইলিয়াস ছিলেন বেশ সচেতন, “ভাষা-ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর বৈশিষ্ট্য মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করা দরকার।” ইলিয়াস ঠিকই বুঝেছিলেন, “আধুনিক কালে শিল্প ঠিক প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে ওঠে না, শিল্পীর সচেতন ভাবনা ও তৎপরতার ফল আধুনিক শিল্প-সাহিত্য।” এই সচেতন প্রয়াসই মূলত তাঁকে বাংলা ছোটগল্পের এক মহান রূপকার করে তুলেছে।

নিম্নবিত্তের মানুষের জীবনকে এভাবে তুলে আনা প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াসের জীবনাদর্শের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল। ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ প্রবন্ধে তিনি একারণেই আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, “আজ মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু যে-মধ্যবিত্ত আজ তাদের ‘মুক্তির জন্য স্থিরসংকল্প’, তাদের ‘শ্রমজীবী নিম্নবিত্তের সঙ্গে যোগাযোগ’ রাখতে হবে। তিনি এও জানতেন শিল্পসিদ্ধির চাবিকাঠি আসলে কী : “নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতি শিল্পীর হাতে নতুন ব্যঞ্জনা পায়, এই সংস্কৃতি শিল্পে উত্তীর্ণ হয়ে সর্বজনীনতা লাভ করে।’ ইলিয়াসের এই অবস্থান বিস্ময়কর হলেও ইতালির প্রখ্যাত মার্কসবাদী ভাবুক আন্তোনিও গ্রামসির ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়। গ্রামসিও চেয়েছিলেন নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরা যদি যুক্ত না হতে পারেন, তাদের জীবনযাপনের সমতলে যদি নেমে না আসতে পারেন, তাহলে জনমানুষের সার্বিক মুক্তি অর্জন করা কখনই সম্ভব হবে না। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এই শিল্পচর্চার জন্যে কোনো শিল্পীকে আনুষ্ঠানিক মার্কসবাদের আশ্রয় নিতে হবে এমনটা কখনই মনে হয়নি ইলিয়াসের। নানন্দিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তিনি ছিলেন একেবারেই নির্মোহ। ব্যক্তিজীবন ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, মানবিক সম্পর্কশূন্য একধরনের ক্লেদাক্ত দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে মানুষ — এসব নিয়ে তাঁর কোনো সংশয় ছিল না। কিন্তু আরোপিত মার্কসীয় পথে যে এই মানুষের মুক্তি ঘটবে, ইলিয়াসের কথাসাহিত্যে সেই মতাদর্শ কখনই প্রকট হয়ে ওঠেনি। এইধরনের আরোপন থেকে বিস্ময়করভাবে মুক্ত তাঁর রচনা। একথাই সর্বাংশে সত্য যে, “পরিচিত অভিজ্ঞতার প্রায় সর্বস্তরে জীবনকে নির্মোহ দৃষ্টিতে একেবারে এর গভীরতম শাঁস পর্যন্ত অশেষ কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে শিল্পকর্মে তা বেপরোয়াভাবে প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা দেখতে পাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখায়।” এই পর্যবেক্ষণ যেমন সত্যনিষ্ঠ, তেমনি কৌতুকাবহ, নান্দনিক উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দুকে যা ছুঁয়ে দিতে পেরেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প প্রসঙ্গে খালেকুজ্জামান ইলিয়াস যথার্থই বলেছিলেন, “ইলিয়াস তাঁর গল্পের বিভিন্ন বিচিত্র মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের বিশ্বাস, সংস্কার, দুঃখ, শোক, আনন্দ, আহ্লাদ, অনুভূতি, উপলব্ধি, ভঙ্গি, সংলাপ ইত্যাদি যে স্বচ্ছন্দ অথচ তীর্যক ও কৌতুকবহ ভঙ্গিতে সৃষ্টি করেন তাতে তাঁর লেখা যেমন জীবনের সামগ্রিক, পূর্ণ-বৃত্ত বাস্তবতা তৈরি করে, তেমনি তাঁর স্বকীয় ধাঁচও প্রতিষ্ঠিত হয়।”

বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে গল্পরচনার প্রায় শুরু থেকেই তিনি একজন পরিণত লেখক। অনেক প্রস্তুতি নিয়ে, দীর্ঘদিনের নেপথ্য অনুশীলনীর মাধ্যমে পরিণতির একটা পর্যায়ে পৌঁছুবার পরেই যে তিনি গল্পরচনায় হাত দিয়েছিলেন, সেটা তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য ঘরে অন্য স্বর থেকে জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল পর্যন্ত সংকলিত গল্পগুলো পড়লেই তা বোঝা যাবে। ‘জীবনের শেষ গল্পের শেষ বাক্যে কলম থামা পর্যন্ত তিনি সর্বাংশে প্রস্তুত পরিণত এবং অমোঘ একটি কলমের অধিকারী ছিলেন।’ তার ন্যারেটিভের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, চরিত্রের ক্রিয়াশীলতা, ভাবনা, পরিপ্রেক্ষিত, সংলাপ, বর্ণনা এবং মতাদর্শ সামগ্রিক ঐক্যে গ্রোথিত হয়ে এক-একটা রচনাকে মহৎ শিল্পকর্মে রূপান্তরিত করেছে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো লেখক তাই সত্যি বিরল।

এই আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনার সংখ্যা বেশি নয় কিন্তু গভীরতার দিক থেকে অতলস্পর্শী। তাঁর প্রবন্ধ সম্বন্ধেও এই একই কথা বলা যায়। জীবদ্দশায় তাঁর একটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুর পর অপ্রকাশিত নানা ধরনের রচনা নিয়ে বেরিয়েছে আরও একটি বই। তবে দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্যে আর তীক্ষè মতাদর্শিক গভীরতায় তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধ উজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যতো বটেই বিশ্বসাহিত্যও ছিল তাঁর নখদর্পনে। তাঁর প্রবন্ধ পড়লেই বোঝা যায়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি বিশ্বসাহিত্য পড়েছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁর আগ্রহ ছিল সমাজতত্ত্ব, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে। এই পঠনপাঠনের সূত্রেই গড়ে উঠেছিল তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর যে পক্ষপাত ছিল, সেকথা তাঁর প্রবন্ধে সুস্পষ্ট। তবে মানবমুক্তির জন্যে মানবস্বভাব ও ব্যক্তিসত্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর মনে হয়েছে গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা এসব কোনো কিছুর বিকাশ ঘটেনি, সামরিক শাসনের প্রভাবে মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। প্রাচ্যের এই পচনের পাশাপাশি বিলম্বিত পুঁজিবাদী পশ্চিমী বিশ্বও আজ ভেঙে পড়ছে। ইলিয়াসের দৃষ্টি মূলত গভীরভাবে নিবদ্ধ ছিল ব্যক্তিবিকাশের প্রতি। কীভাবে এই ব্যক্তিমানুষ পঙ্গু হয়ে পড়ছে, বিপর্যস্ত, বিপন্ন, তাঁর প্রবন্ধের এই হচ্ছে মূল নির্যাস। জটিল বিষয়কে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন বেশ প্রাঞ্জল ভাষায়। সামান্য দীক্ষিতই হোন, কিংবা গভীরতাস্পর্শী, তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু বুঝে নেবার কোনো বাধা নেই — এমনভাবেই তিনি লিখেছেন তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধ। ইলিয়াস কবিতাও লিখেছেন কিছু। ব্যক্তিক অনুভবের কারণে ওই কবিতাও আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তবে ইলিয়াসের সৃজনীপ্রতিভা মূলত গভীর হয়ে উঠেছে তাঁর কথাসাহিত্যে। দুই বিপরীত বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে পৌঁছুতে চেয়েছেন ব্যক্তিসত্তার গভীরে। মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসতেন, তাঁর রচনায় এই বিষয়টি সুস্পষ্ট। ব্যক্তির জীবনপরিসরকে কিংবদন্তী, ইতিহাস আর সমকালের এমন অভাবনীয় পটে মেলে ধরেছেন যে তার প্রতিটি রচনাই হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের অস্তিত্বগাথা, একই সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মহাকাব্যিক ডিসকোর্স। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্থান যে শীর্ষে অধিষ্ঠিত থাকবে, আমার অন্তত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।