বুদ্ধদেব বসুর কাব্যানুবাদ প্রসঙ্গে

মুহম্মদ নূরুল হুদাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2013, 09:10 AM
Updated : 6 Feb 2013, 09:12 AM


অনুবাদ কী ও কেন, এমন একটি সাধারণ প্রশ্ন দিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত করা যেতে পারে। শাস্ত্রীয় উত্তরটা কালে কালে বেশ জাঁকালো হয়ে উঠলেও সাধারণ উত্তরটা সহজবোধ্য বটে। এক ভাষার সাহিত্য বা জ্ঞান অন্য ভাষায় যথাসম্ভব অবিকৃত ও সুবোধ্য ভাষ্যে উপস্থাপন করাটাই অনুবাদ। তবে আভিধানিকভাবে এর অন্য অনেক অর্থ বিদ্যমান। যেমন, বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ অনুসারে ‘অনুবাদ’ শব্দটির ভালো-মন্দ অন্তত পাঁচ রকমের অর্থ রয়েছে। এগুলো হলো : ‘১বি. ভাষান্তর, তরজমা, ট্রানস্লেশন। ২. বি, পুনঃ পুনঃ কথন (গুণানুবাদ)। ৩. অনুকরণ, নকল। ৪বি. বিড়ম্বনা, প্রতিকূলতা। ৫বি. অপবাদ।’ এই পাঁচ রকমের অর্থে একটি অভিন্নতা এই যে, সবক্ষেত্রেই এই শব্দটিকে বিশেষ্য পদ হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে। তবে চতুর্থ (বিড়ম্বনা, প্রতিকূলতা) বা পঞ্চম অর্থের (অপবাদ) সাধারণ ব্যবহার সহজে চোখে পড়ে না। দ্বিতীয় অর্থে বলা হয়েছে ‘পুনঃ পুনঃ কথন’, যার প্রচলনও আজকাল নেই বললেই চলে। একইভাবে পঞ্চম অর্থের ‘অপবাদ’ও আমরা এখন প্রত্যক্ষ করি না। আসলে প্রথম অর্থটিই (ভাষান্তর) আমরা অনুবাদ বলতে বুঝে থাকি, যা এই বহুভাষাভাষী বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞান ও ভাবের আদান প্রদানের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। একারণে সাহিত্যের আদি যুগ থেকেই লেখক-পাঠকের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে এই রীতির প্রচলন ঘটেছে।

তবে ভাষান্তর ছাড়াও অন্য যে অর্থটি সুপ্রযুক্ত হতে পারে, তা হচ্ছে ব্যাখ্যা। ভাষান্তর বলতে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় পরিবর্তন বোঝায়। কিন্তু কখনো কখনো একই ভাষা থেকে একই ভাষাতেও একই টেক্সট সহজবোধ্যভাবে বা ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবর্তিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে অনুবাদের আরো কিছু গ্রহণযোগ্য অর্থ হতে পারে– ‘ব্যাখ্যা’, ‘রূপবদল’, ‘অভিযোজন’ ইত্যাদি। শুরুতেই আমরা অনুবাদের এই বিচিত্র ব্যঞ্জনা সম্পর্কে অতি সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি, কেননা সৃষ্টিশীলতার এই পদ্ধতিটি বিধিবদ্ধ আপন নিয়মে পরিচালিত হলেও নানা সময়ে এর বিচিত্রগামিতা ও ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এ নিয়ে আমরা যথাস্থানে আরো কিছু কথা বলবো।

আমাদের জানার দ্বিতীয় বিষয় : বাংলায় অনুবাদের বয়স কত? না, এর কোনো সঠিক জবাব আমাদের হাতে নেই। বাংলা সাহিত্যের আদিপর্ব বলা য়ায় ৯৫০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত। এইসময়ে অনুবাদ আমাদের চোখে পড়ে না। যা চোখে পড়ে তা হলো একই কাহিনী বা পাঁচালি বা আখ্যান বিভিন্ন লেখক কর্তৃক বিভিন্নভাবে বর্ণনা, যা কালপরম্পরায় ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে থাকে। সব লোকসাহিত্যের এই এক চলমান রীতি। এটি কিছুটা অভিযোজন হলেও আজকের পারিভাষিক অর্থে অনুবাদ নয়। তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে, বাংলায় মৌলিক কাব্যানুবাদ শুরু হয়েছিলো অন্তত মধ্যযুগে, ১৫০০ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। এই সময়ে সংস্কৃত, হিন্দি, ফারসি, আরবি ইত্যাদি ভাষা থেকে বাংলায় কাব্যানুবাদের প্রচলন ঘটে। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ এ-রকম একটি অনুবাদ, যার চারিত্র্য অভিযোজনাশ্রয়ী ও মৌলিক রচনার সমীপবর্তী। এ-সময়ে সংস্কৃত থেকে অনূদিত ও অভিযোজিত হয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ-কাহিনী, কিংবদন্তী, শাস্ত্রগ্রন্থ ইত্যাদি। আর হিন্দি ও ফরাসি থেকে অনূদিত ও অভিযোজিত। হয়েছে প্রণয়োপাখ্যান, মহাকাব্য, বাণীগ্রন্থ, এবাদতনামা, সুফী তরিকার বয়ান ইত্যাদি।

আসলে মধ্যযুগীয় জীবনযাত্রার সহায়ক যে বচন, পাঁচালি, সমাজদর্শন, জীবনভাবনা, রীতিনীতি ইত্যাদি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছিলো অবারিতভাবে। বাংলায় পাল-সেন-পাঠান-মোগলের পর যখন ইংরেজ শাসনের প্রবর্তন হলো, তখন ব্যাকরণ, বাইবেল, শেক্সপীয়র থেকে শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যের বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ নিদর্শনও বাংলায় নানাভাবে উপস্থাপিত হলো। আর এ-ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিলেন বৃটিশ পাদ্রী, শিক্ষক ও প্রশাসকদের একাংশ, যাঁরা এই দেশের জীবনরীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে চাইলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি ছাড়াও ফরাসি, জার্মান, পর্তুগীজ ভাষার কিছু গ্রন্থও বাংলায় অনূদিত হয়। এই সময়ে স্বদেশী চেতনা উত্তরোত্তর বিকাশের ফলে সংস্কৃত থেকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যসমূহ বাংলায় ব্যাখ্যাসহ অনূদিত বা পুনর্লিখিত হয়। রামমোহনের ‘বেদান্তসার’ ও ‘বেদান্তদর্শন’ তেমন দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় অনুবাদ একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। সাহিত্য ছাড়াও জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখার প্রয়োজনীয় গ্রন্থাবলী সরাসরি অনূদিত বা অভিযোজিত বা অনুলিখিত হয়ে আসছে। এই বিবেচনায় ১৫০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা অনুবাদের বয়স ৫০০ বছরের মতো। এই কালপরিধি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রায় অর্ধ-বয়সী। এই সুদীর্ঘ কাল ধরে নানা মনীষী নানাভাবে এই অনুবাদ-কর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছেন। তাঁদের নামের তালিকা অবশ্যই সুদীর্ঘ। এই তালিকায় রামমোহন ছাড়াও মাইকেল, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমূখ মহৎ বাঙালি স্রষ্টারা রয়েছেন।


বাংলায় কাব্যানুবাদের কথা বললেই সর্বপ্রথম যে নামটি মনে পড়ে, সেটি বুদ্ধদেব বসু কিনা সন্দেহ; কিন্তু আমাদের প্রিয় অনুবাদকদের প্রসঙ্গ এলেই যে নামটি অবলীলায় সামনে এসে দাঁড়ায়, সেটি নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধদেব বসু। বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে গ্রামবাংলা থেকে ঢাকা শহরের নগরবাংলায় পা দিয়ে ন্যুমার্কেট থেকে বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বোদলেয়ারের কবিতা কিনে তার ভূমিকা, অনুবাদ ও টীকা-ভাষ্য ইত্যাদি পাঠ করার পর যে মোহ আমাকে আনখাগ্র আচ্ছন্ন করেছিলো, আজ পাঁচ দশক পরে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পা দিয়েও সেই আচ্ছন্নতা থেকে আমি বা আমার সময়ের অনেকেই মুক্ত হতে পারিনি। এই সুদীর্ঘ সময়ে বাংলা-ইংরেজিতে বেশ-কিছু অনূদিত গদ্য-পদ্য পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। বাংলা একাডেমীর অনুবাদ সেলে দীর্ঘ চার দশক কাজ করার সুবাদে এদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের বহু অনূদিত পাণ্ডুলিপি পড়ার মওকা পেয়েছি, কিন্তু কোনোটিকেই বুদ্ধদেবের সঙ্গে তুলনীয় ভাববার অবকাশ পাইনি। একটি সর্বাঙ্গসুন্দর ও সর্বগ্রাসী কবিতা পাঠ করার পর পাঠক বা পাঠিকা যে নান্দনিক ঘোরের মধ্যে বন্দী হয়ে যায়, যেমনটি আমার হয়েছিলো জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ পাঠ করার পর, ঠিক তেমনটি ঘটলো শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা পাঠ করার পরও। আর আমার জানা প্রায় সব বাঙালি পাঠক-পাঠিকার মতো উৎসর্গ-পাতায় ‘অচেনা মানুষ’ শীর্ষক গদ্য-সংলাপাশ্রয়ী কবিতাটি ঢুকে গেলো আমারও স্মৃতিতে। আজও যা আমি আমার নিঃসঙ্গতম মুহূর্তে আউড়ে থাকি অনুচ্চ স্বরে :
বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আমি ভালোবাসি মেঘ… চলিষ্ণু মেঘ… ঐ উঁচুতে… ঐ উঁচুতে…
আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল।
কী সেই ‘আশ্চর্য মেঘদল?’ তারও কোনো সঠিক ও একার্থবোধক দ্যোতনা আমার কাছে স্পষ্ট হয়নি। শুধু বুঝেছি এটিই হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিশোধিত রচনার মুগ্ধ করার শক্তি, যা সৃষ্টিসুন্দরকে একই সঙ্গে মনপ্রিয় ও জনপ্রিয় করে তুলতে পারে। পুরো কবিতাটি প্রশ্ন ও উত্তর দানের কাঠামোতে সাজানো। আর শেষাংশে মীমাংসা এসেছে স্বীকারোক্তিমূলক রায়ের ভঙ্গিতে।

‘বনলতা সেন’ পাঠ করার সময় যেমন, ঠিক তেমনি ‘অচেনা মানুষ’ পাঠ করার সময়, কিংবা তা পাঠের পরও মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি, আমি ভিন্ন ভাষায় লিখিত একটি কবিতার ভাষান্তরিত ভাষ্য পাঠ করছি। এবং বারবার মনে হচ্ছিলো, সহজতম সুন্দরতম অনায়াসতম স্বতঃস্ফূর্ততম পদ্ধতিতে কেউ বহুবর্ণ দল মেলে উন্মীলিত হচ্ছে, আর নিত্যবদলরত রশ্মির ছটায় তার রূপচ্ছটাও বারংবার ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিফলিত বা প্রতিসরিত হচ্ছে। হ্যাঁ, মৌলিকভাবে রচিত শ্রেষ্ঠ রচনার এই তো বহুমাত্রিক দীপ্তি। তাহলে কি ‘অচেনা মানুষ’ বুদ্ধদেবের মৌলিক সৃষ্টি?  আমার স্পষ্ট মীমাংসা : হ্যাঁ, তাই। অনেক অনেক আগে বোদলেয়ার নামক এক স্বতঃসমর্পিত ফরাসি কবির চিত্তে প্রস্ফুটিত একটি বোধকে কবি স্বয়ং বন্দী করেছিলেন তাঁর মাতৃভাষার শব্দে-ছন্দে-বর্ণনাবৈভবে যা বুদ্ধদেব নামক এক বাঙালি কবির চিত্তলোকে নতুনভাবে ডানা মেলেছিলো কাল ও সমাজের দূরত্বকে অগ্রাহ্য করে পাঠ-প্রতিক্রিয়ার রহস্যরঙিন পদ্ধতিতে; আর বাঙালি বুদ্ধদেব সেই কাব্যভাষ্যটিকে হুবহু তাঁর উপলব্ধির রূপকল্পে পুনরায় সৃষ্টি করলেন বাংলা ভাষার শব্দে-ছন্দে-বর্ণনাবৈভবে।

অর্থাৎ অনুবাদ বলতে যে নৈর্ব্যক্তিক ভাষান্তরের কথা অনেকেই ভেবে থাকেন, বুদ্ধদেব সে পথে অগ্রসর হননি। তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন ‘আত্মসাৎ’ করার পথে। ভিন্ন ভাষার কবিতাটির উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করার পর কবিতাটিকে তিনি নিজের মতো নিজের উপলব্ধিতে, ও পরে তার ভাষিক অভিব্যক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। ফলে এটি একটি নবসৃষ্টি, কেবল প্রথাগত অনুবাদ নয়। এ কাজটি করতে হলে নবসৃষ্টিকারীকে বেশ কটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে তাঁর সৃষ্টি-প্রক্রিয়া পরিশ্রুত করতে হয়। আর সেই পর্যায়ের তিনটি অণু-পর্যায় হচ্ছে পাঠ, তুলনা-প্রতিতুলনা আর চূড়ান্ত পরিমার্জনা, যার অন্য নাম সম্পাদনা। আর পুরো প্রক্রিয়াটির নাম হতে পারে পুনর্সৃষ্টি, যা ‘অনুবাদ’ শব্দের আরেকটি অর্থব্যঞ্জনা হিসেবে গৃহীত হতে পারে। বুদ্ধদেবের কবিবন্ধু এই ধরনের অনুবাদ-ক্রিয়াকে প্রতিধ্বনি বলেও অভিহিত করেছেন। তবে আমরা পুনর্সৃষ্টি কথাটিকেই অধিক গ্রাহ্য বলে মনে করি।


বুদ্ধদেব যে সময় কালিদাসের মেঘদূত বা শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, তখনো অনুবাদ-ক্রিয়া বাংলা ভাষায় একটি নান্দনিক কাঠামোর মধ্যে একাডেমিক গ্রাহ্যতা পায়নি। বিশ্বের অন্যান্য অগ্রসর ভাষার ক্ষেত্রেও কতকাংশে তা-ই প্রযোজ্য। কিন্তু কালে কালে সৃষ্ট ভাষ্য বা টেক্স্টের ধরন বিবেচনা করে, তদুপরি বর্তমান বিশ্বে অনুবাদের বিকল্পরহিত প্রয়োজনহেতু, অনুবাদ একটি পদ্ধতিগত একাডেমিক শৃঙ্খলা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। টেক্সটের ধরন অনুসারে তাকে নানা পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। যেমন, সৃষ্টিশীল (মূলত সাহিত্য), বাণিজ্যিক, বিজ্ঞানবিষয়ক, সংবাদবিষয়ক, আইনবিষয়ক ইত্যাদি। সরাসরি এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা ছাড়াও দুই ভাষার মধ্যে অন্য ভাষার আরো একাধিক ভাষ্য থাকতে পারে, যা অনুবাদকে আরো জটিল করে তোলে। বুদ্ধদেবও অনুবাদকালে অন্তত তৃতীয় ভাষার অস্তিত্বের সংকটে পতিত হয়েছিলেন।

বোদলেয়ারের অনুবাদের ক্ষেত্রে ফরাসি ও বাংলার মাঝখানে ইংরেজি একই সঙ্গে সহায়ক ও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বুদ্ধদেব সেই সমস্যা সমাধানের জন্য নিজে ফরাসি ভাষার কার্যকর পাঠ নিলেন। এই কাজ করেছেন ভালো অনুবাদকের প্রায় সকলেই। আর হাল আমলে ব্যক্তি ও সামষ্টিক অভিজ্ঞতার পথ ধরে অনুবাদ এমন একটি সৃষ্টি-প্রক্রিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার মধ্যে অন্তত চারটি পরস্পর-সংযুক্ত পর্যায় রয়েছে।

সোর্স ল্যাংগুয়েজ বা টেক্স্ট (SL Text) বা উৎস ভাষার ভাষ্য থেকে টার্গেট ভাষার ভাষ্য (TL Text) তৈরি করতে হলে মূল রচয়িতার অভিপ্রায় অনুধাবন করে এই প্রক্রিয়ায় যথাসম্ভব মূল ভাষ্যটিকে লক্ষ্য-ভাষার (TL) ভাষ্যে রূপান্তরিত করা অত্যাবশ্যক। এ-ক্ষেত্রে এই চারটি পর্যায় হচ্ছে টেক্সটুয়াল লেভেল (১), রেফারেনসিয়াল লেভেল (২), কোহেসিভ লেভেল (৩) এবং লেভেল অব নেচারালনেস (৪)। বলা বাহুল্য, এই চারটি পর্যায়ের সব ক’টি যদি সফলভাবে পার হওয়া যায়, তাহলে লক্ষ্য-ভাষায় অনূদিত ভাষ্য প্রায়-ক্ষেত্রে মৌলিক সৃষ্টির বৈভব নিয়ে দাঁড়ায়।

কীভাবে পার হওয়া যায় এই চারটি প্রক্রিয়া?–না, এর কোনো সহজ উত্তর নেই। কৃত্রিমভাবে একেকটি পর্যায় বা লেভেল পার হয়ে অন্য একটি লেভেলে যাওয়া যত সহজ, নিরন্তর পাঠজাত উপলব্ধির ফলে প্রায়-অন্তর্বয়িত পদ্ধতিতে এই চারটি ধাপ পার হয়ে যাওয়া তত সহজ ও বাস্তবসম্মত। এই জন্যেই বলছিলাম, অনুবাদ্য মূল ভাষ্য অনুবাদক কর্তৃক বারবার পাঠ ও আত্মস্থ করার কোনো বিকল্প নেই। এই পাঠের মধ্য দিয়েই অনুবাদক প্রতিটি পর্যায় অতিক্রম করতে পারেন।

ধরা যাক প্রথম লেভেলের কথা। এটি হচ্ছে টেক্সটুয়াল লেভেল। অনুবাদক এই পর্যায়ে দেখবেন রচনাটির শব্দ, বাক্যাংশ, বাক্য, অনুচ্ছেদ ও সামগ্রিক কাঠামো। এটি কতকটা লিটারেল বা আক্ষরিক অনুবাদ। প্রতিটি শব্দের অর্থ (কখনো কখনো একাধিক অর্থ থাকতে পারে), বাক্য ও অনুচ্ছেদে গ্রথিত হয়ে সমূদয় শব্দগুচ্ছের উৎপাদিত পূর্ণাঙ্গ অর্থ এখানে পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে যাবে মূল রচয়িতা বাণীর পাশাপাশি কী অভিপ্রায় এখানে ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। কোনো শব্দ বা বাক্যের অর্থ অস্পষ্ট রেখে এই পর্যায়টি অতিক্রম করা যাবে না, তাহলে গোড়ায় গলদ থেকে যাবে। অনুবাদকের সতর্ক পাঠ কোনো শব্দ বা বাক্যের আর্থিক দ্যোতনাকে এড়িয়ে যাবে না। এই আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি প্রতিটি বাক্য ও অনুচ্ছেদের মধ্যে যে অর্থসঙ্গতি আছে তারও সতর্ক অন্তর্বয়ন অতি জরুরি। তা নাহলে পুরো টেক্সটি খাপছাড়া হয়ে যেতে পারে।

দ্বিতীয় স্তর বা লেভেলে টেক্স্টের ভিতরে যে সব রেফারেন্স বা অনুষঙ্গ সরাসরি আছে বা পরোক্ষে ইশারা করা হয়েছে, সেগুলি যথাসম্ভব উদ্ধার করতে হবে। এখানে আছে সামাজিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, পৌরাণিক, কিংবদন্তিমূলক, দর্শনমূলক, অলঙ্কারমূলক, বিজ্ঞানমূলক বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখাসঞ্জাত অনুষঙ্গ। সৃষ্টিশীল টেক্সটে এটি একটি প্রয়োজনীয় পর্যায়। কেননা প্রত্যেক কবি বা লেখক তাঁর নিজ-ঘরানার শৈলী তৈরি করেন, যেখানে উপরোক্ত প্রসঙ্গগুলো তিনি তাঁর মতোই প্রয়োগ করে থাকেন। শ্রেষ্ঠ মানের লেখক ও লেখার ক্ষেত্রে এটি একটি জরুরি পর্যায়। এখানে মূল সমস্যা এসএল টেক্সটের লেখকের স্বকীয় রীতি। ক্ষেত্রবিশেষে এই রীতি এতো বেশি লেখকের ব্যক্তিত্বাশ্রয়ী হয়ে দাঁড়ায় যে, টিএল টেক্সটে তার পুনর্মিমাণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই এই পর্যায়টি পার হয়ে গেলেই অনূদিত ভাষ্য তৈরির মূল কাজটি অর্ধেক সম্পন্ন হয়ে যায় বলে অনুমিত হয়।

টেক্সচুয়াল ও রেফারেনসিয়াল লেভেল আসলে মূল ভাষ্যের শরীর, যার কোনো প্রত্যঙ্গ বা আকৃতি বা কাঠামোকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এর ব্যত্যয় হলেই অনুবাদ মূলের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে। কবিতা, উপন্যাস, গল্প তথা সৃষ্টিশীল রচনার ক্ষেত্রে অনুবাদক আত্যন্তিক সতর্কতা সত্ত্বেও এই পর্যায়ে অসতর্ক বিচ্যুতির বা ব্যাখ্যা-বিভিন্নতাজনিত স্খলনের শিকার হয়ে পড়েন। ফলে এই দুই পর্যায়ের সতর্ক সম্পাদন ও ধারাবাহিক অন্তর্বয়ন অত্যাবশ্যক।

তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়দ্বয় মূলত পরিশোধন, পরিমার্জন, সংগ্রথন ও চূড়ান্ত সম্পাদনার পর্যায়। টেক্সটুয়াল লেভেল ও রেফারেনসিয়াল লেভেলে প্রাপ্ত, ভাষান্তরিত ও সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত-অনুষঙ্গগুলোকে অর্থবোধক পদ্ধতিতে সংগ্রথিত করে লক্ষ্য-ভাষ্যে (টিএল টেক্সট) একটি মানসম্মত রচনা দাঁড় করানোই এই পর্যায়ে অনুবাদকের মূল কাজ। প্রথম দুই পর্যায়ে মূলত আক্ষরিক ও কাঠামোগত অভিন্নতা রক্ষা করার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর তৃতীয় পর্যায়ে কোহেশন বা সামঞ্জস্য বিধানের ক্ষেত্রে অর্থ বা ব্যঞ্জনার রদবদল না ঘটিয়ে প্রয়োজনবোধে কাঠামোর ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা এমনভাবে বিষয়লগ্ন ও অনুল্লেখ্যভাবে করা হয়, যাতে মূল রচনার বা রচয়িতার অভিপ্রায়ের কোনো বিকৃতি না ঘটে। বলা যেতে পারে, এই পর্যায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেই অনূদিত ভাষ্যটি অর্থ ও ব্যঞ্জনার দিক থেকে একটি প্রমিত ভাষ্যে পরিণত হতে পারে। তবে অসম্পূর্ণতা এটুকু যে, সতর্ক পাঠক পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন, এটি অনুবাদ। আর এই অসম্পূর্ণতাটুকু মুছে দিয়ে অনূদিত ভাষ্য থেকে শ্রমের স্বাক্ষর বিলুপ্ত করার জন্য যে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া, তারই নাম লেভেল অব ন্যাচারালনেস বা স্বাভাবিকতার পর্যায়। এটি মূলত ভাষিক পরিমার্জন ও বর্ণিত বিভিন্ন প্রসঙ্গের হালতকায়নের মাধ্যমে পরিস্থিতিসম্মত করার পর রচনাটিকে প্রায়-পরিপূর্ণভাবে মৌলিক রচনায় পরিণত করার পর্যায়। মূলত সৃষ্টিশীল ভাষ্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে এটি একটি আবশ্যকীয় শর্ত। আর কবিতার ক্ষেত্রে তো অবশ্যপালনীয় শর্তও বটে। কেননা যে কোনো উত্তীর্ণ কবিতা প্রায়-ক্ষেত্রে বহু অর্থজ্ঞাপক, আলঙ্কারিক ও শৈলীগত উদ্ভাবনে অভূতপূর্ব ভাষাভঙ্গির অধিকারী। স্বাভাবিকতার পর্যায়ে ভিন্ন ভাষার একটি কবিতার মূলাশ্রয়ী ও কাঠামোগত অভিন্নতামূলক অনুবাদ সম্পন্ন করা প্রায়-ক্ষেত্রে একটা অসম্ভব ব্যাপার।
যে-কাজটি অধিকাংশ অনুবাদক কাব্যানুবাদে সম্পন্ন করেন, সেটি হচ্ছে পঙ্ক্তিনির্ভর আক্ষরিক ও ভাষিক অনুবাদ, যা প্রায়-ক্ষেত্রে অর্থহীন ও ব্যঞ্জনাহীন হয়ে দাঁড়ায়। অনুবাদকে পুনর্সৃষ্টির পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে অনুবাদককে এই সমস্যার সমাধান করতে হয়।


অনুবাদ-কর্ম শুরু করার মুহূর্তে বুদ্ধদেব বসু অনুবাদের উল্লিখিত চারটি পর্যায়ের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু অনুবাদ যে অনুবাদকের মনে একটি পুনর্সৃষ্টি, আর তা যে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় হুবহু প্রতিধ্বনিমূলক, এই প্রতীতি কবি ও সৃষ্টিশীল লেখক হিসেবেই তিনি অর্জন করেছিলেন। আর এক্ষেত্রে প্রধান অবলম্বন ছিল তাঁর অসাধারণ সাহিত্যবোধ, পাঠজাত উপলব্ধি এবং উপলব্ধিজাত পুনর্সৃষ্টির দক্ষতা। আগেই বলেছি, পাঠ আর পাঠের মধ্যেই প্রথম দুই পর্যায় সম্পন্ন করা সম্ভব; আর উপলব্ধি, ব্যাখ্যা ও পুনর্সৃষ্টির অনুশীলন দিয়ে স্বাভাবিকতার পর্যায় অতিক্রমও অসম্ভব নয়। বুদ্ধদেবের অনূদিত অধিকাংশ কাব্যভাষ্য পাঠ করতে করতে মনে হয়, গবেষকের পর্যায়ক্রমিক স্তর পেরিয়ে নয়, বরং সার্বভৌম সৃষ্টিশীলতার পুঞ্জীভূত শক্তি দিয়ে তিনি তাঁর স্বতন্ত্র পথেই এই চার-পর্যায় অতিক্রম করেছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর একটি প্রধান অস্ত্র ছিলো উৎস-ভাষা ও লক্ষ্য-ভাষার উপর গ্রহণযোগ্য দখল এবং লক্ষ্য-ভাষায় প্রয়োজনবোধে নতুন শব্দ বা চিত্র তৈরিতে তাঁর সাহসী দক্ষতা।

কবিতাসংগ্রহ : বুদ্ধদেব বসু শীর্ষক গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডের শেষে প্রদত্ত ‘সম্পাদকের নিবেদন’-এ বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদ-পদ্ধতি সম্পর্কে যথার্থই মন্তব্য করেছেন কবি নরেশ গুহ, “বিশেষ একটি কোনো অনুবাদের উপর তাঁর নির্ভর ছিলো না। বহু পরিশ্রমে যে-ভাবে তিনি মূল কবিতার মর্মস্থলে প্রবেশ করার চেষ্টা করতেন, তার মোটামুটি বিবরণ আছে তাঁর লেখা ‘অনুবাদকের বক্তব্য’ নামক নিবন্ধগুলিতে। পাউণ্ড যতোটা চীনা ভাষা জানতেন, মনে হয় না ফরাসি বা জার্মান ভাষার সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর মিত্রতা তার চাইতে কম ছিলো।…”


বুদ্ধদেব বসু যে-সব ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় কাব্যানুবাদ করেছিলেন, সে-সব ভাষা জানা পণ্ডিত বা গবেষক তাঁর আগে, তাঁর সময়ে বা তাঁর পরেও অনেক রয়েছেন। অনেকেরই ভাষাগত জ্ঞান তাঁর চেয়ে বেশি ছিলো বা আছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁদের কেউ ঐসব ভাষা থেকে গুণগত ও পরিমাণগত বিচারে বুদ্ধদেবের সমতুল্য কাব্যানুবাদ করেননি। কারণ ঐ একটাই। কবিতার প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্পণ, পরিশ্রমী পাঠ ও সতর্ক-সচেতন পুনর্সৃষ্টি। একটি কাব্যাংশ বা কবিতা বা পূর্ণকাব্য নিজের মতো করে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করার আগে বুদ্ধদেব সেটি বাংলায় রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেননি। আবার পৃথিবীর সব প্রান্তের সব কবির সব কবিতাও বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার কাজে হাত দেননি তিনি। এ-ক্ষেত্রে কাজ করেছে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ, শৈল্পিক বোধ এবং কৌশলগত নান্দনিক অভিপ্রায়।

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, বুদ্ধদেব হঠাৎ-করে বা খেলাচ্ছলে বা অবকাশযাপনকালে কাব্যানুবাদে হাত দেননি। কিংবা যে-ভাষার কবিতা (বাংলা ভাষা ছাড়া) তার পক্ষে সহজগম্য, সে-ভাষার কবিতা অনুবাদ দিয়েও তাঁর অনুবাদ-কর্ম শুরু হয়নি। বরং হয়েছে তাঁর প্রায়-না-জানা এক ভাষা চীনা কবিতার অনুবাদ দিয়ে। তার কারণ প্রথম এজরা পাউণ্ড, এবং চীনা কবিতার স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য, যা আধুনিকতার সূত্রলগ্নে পাউণ্ডের মাধ্যমে পশ্চিমা কবিতাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো। চীনা কবিতা (১৯৪৭) অনুবাদের শুরুতে ‘মন্তব্য’ শীর্ষক নিবন্ধে বুদ্ধদেব বলেছেন, “ভিক্টোরীয় উচ্ছ্বাসে বিরক্ত হয়ে আধুনিক পশ্চিমী মন চৈনিক চিত্রকলায় মুগ্ধ হলো। অপূর্ব লাগলো এই কম-করে-বলা কবিতা, গলা চড়ে না, ঘোষণা নেই, কোনো কথায় জোর দেয় না, সব কথা খুলেও বলে না। মৃদু, নিস্তাপ, বিষণ্ন, এর শক্তি সূক্ষ্মতায়, যাথার্থে, অবিচল পার্থিবপ্রণয়ে। উপমার বদলে বস্তুটারই ব্যবহার, বিবৃতির বদলে চিত্রকল্পের প্রয়োগ, চীনেদের কাছে এই দুই সূত্র শিখে নিয়ে এজরা পাউণ্ড তাঁর ইমেজিস্ট আন্দোলনে কেমন কাজে লাগিয়েছিলেন সে-খবর আজ সকলেই জানেন।” এর পরে নিবন্ধটির উপসংহারে তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর আসল উদ্দেশ্য, “কিন্তু সেখানে (প্রাচীন চীনে কবিতায়) যা আছে তা অন্য কোথাও নেই বলে বিশ্বসভায় তার এত সম্মান, তাছাড়া এখনকার তরুণ বাঙালি কবিরা, যাঁরা নতুন পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, চীন সংসর্গে তাঁরা হয়তো সৎ পরামর্শ পাবেন।”


উপরোক্ত বক্তব্যে এ-কথা স্পষ্ট যে, বুদ্ধদেব বসু বাংলা কবিতার বাঁককালে নতুন কবিদের পথ দেখানোর নান্দনিক উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁর কাব্যানুবাদ শুরু করেছিলেন। আর এ-ক্ষেত্রে নতুন কবিদের পাশাপাশি সর্বাধিক উপকৃত হয়েছিলেন তিনি নিজে। তাঁর কবিতার যে অসাধারণ চিত্রময়তা, পরোক্ষতা, সূক্ষ্মতা, যাথার্থ্য কিংবা অবিচল পার্থিবপ্রণয় ইত্যাকার বিষয়-শৈলীর অন্তর্বয়ন তার পাঠ ও পুনর্নির্মাণের এই যুগল কর্মযজ্ঞেরই মুখ্য ফসল। যে-অনুবাদ বুদ্ধদেবকে প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি দিয়েছে সেটি বোদলেয়ারে কবিতা, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৬১ সালে। অথচ তারও চৌদ্দ বছর আগে সম্পন্ন ও প্রকাশিত হয়েছিলো তার ‘চীনে কবিতা (১৯৪৭)’, যা তাঁর ‘কবিতাসংগ্রহ’-এর পঞ্চম খণ্ডের ‘পরিশিষ্ট’ অংশে সংকলিত।
তাঁর অনূদিত কবিতা ও কাব্যসমূহের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী আমরা এখানে একটি তালিকা দিচ্ছি। তালিকাটি তাঁর পাঠকর্ম, উপলব্ধি পর্যায় ও অনুবাদ-কর্ম ও পদ্ধতি অনুধাবনে সহায়ক হতে পারে। তালিকাটি নিম্নরূপ :
১. চীনে কবিতা (১৯৪৭)
[মন্তব্য/লি পো (১টি) / হান ইউ (২টি) / পো চু-ই (২টি/ য়ুয়ান চন (১টি]
২. মার্কিনি কবিতা (১৯৫০)
[এজরা পাউণ্ড অবলম্বনে (৩টি) / ওয়ালেস স্টিভেন্স (২টি) / ই. ই. কামিংস (২টি) / উইলিয়াম কার্লস উইলিয়ামস (৩টি)]
৩. কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭)
[সংস্কৃত কবিতা ও ‘মেঘদূত’, অনুবাদকের মন্তব্য, পূর্বমেঘ, উত্তরমেঘ, টীকা, চিত্র প্রসঙ্গ]
৪. রুশ কবিতা : বরিস পাস্টেরনাক : জিভাগোর কবিতা (১৯৬০)
[ভূমিকা, নোট ২৫টি কবিতা, টীকা]
৫. শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা (১৯৬১)
[অনুবাদকের বক্তব্য/ভূমিকা : শার্ল বোদলেয়ার ও
আধুনিক কবিতা/পাঠকের প্রতি/বিতৃষ্ণা ও আদর্শ (৬৫টি কবিতা)/প্যারিস-চিত্র (১৪টি কবিতা)/ মদ (৪টি কবিতা)/ ক্লেদজ কুসুম (৮টি কবিতা)/ বিদ্রোহ (১টি কবিতা) / মৃত্যু (৬টি কবিতা) / আরো কবিতা (১৩টি কবিতা)/ কবিতার টীকা / কালপঞ্জি / বোদলেয়ার-এর জীবনপঞ্জি]
৬. হ্যেল্ডারলিন-এর কবিতা (১৯৬৭)
[‘হ্যেল্ডারলিন’ (বুদ্ধদেব বসু)/ ভূমিকা : ফ্রীডরীশ হেল্ডারলিন : তাঁর জীবন ও কবিতা/অনুবাদকের বক্তব্য/মোট ২৫টি কবিতা/টীকা]
৭. রাইনের মারিয়া রিলকে-র কবিতা (১৯৭০)
[ভূমিকা : রাইনের মারিয়া রিলকে : তাঁর কবিতা ও তাঁর জীবন/অনুবাদকের বক্তব্য / প্রহর-পুঁথি (৮টি কবিতা) / চিত্র-পুঁথি (১২টি কবিতা) / নতুন কবিতা (১৫টি কবিতা) / ডুয়িনো এলিজি (০৫টি কবিতা) / অর্ফিয়ূসের প্রতি সনেট : প্রথম খণ্ড থেকে (১৫টি সনেট) / অর্ফিয়ূসের প্রতি সনেট : দ্বিতীয় খণ্ড থেকে (১৩টি সনেট) / টীকা]
দেখা যাচ্ছে, কালিদাসের ‘মেঘদূত’ ছাড়াও চীনে কবিতা (৪ কবি ৬ কবিতা), মার্কিনি কবিতা (৪ কবি ১৫ কবিতা), রুশ কবিতা (১ কবি ২৫ কবিতা), ফরাসি কবিতা (১ কবি ১০৩ কবিতা), জার্মান কবিতা (২ কবি ৯৩ কবিতা) মিলিয়ে মোট ছয় ভাষার (সংস্কৃত, চীনা, ইংরেজি, রুশ, ফরাসি ও জার্মান) ২৪২টি কবিতা (চীন ৬ + মার্কিনি ১৫ + রুশ ২৫ + ফরাসি ১০৩ + জার্মান ৯৩) তিনি অনুবাদ করেছেন, যা সংকলিত ও গ্রন্থভুক্ত অবস্থায় আছে। এর বাইরে আছে শঙ্করাচার্যের ‘আনন্দলহরি’ শীর্ষক আরেকটি কবিতা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বৎসর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এই অনূদিত কবিতাবলি। সর্বাধিক অনুবাদ করেছেন ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের কবিতা : ১০৩টি। বাংলা কবিতার তিরিশি আধুনিকায়নে যাঁদেরকে তিনি আবশ্যকীয় মনে করেছেন, দৃশ্যত তাঁদেরকেই তিনি অধিক মনোনিবেশ সহকারে পাঠ, আত্মস্থ ও পুনর্নির্মাণ করে নিজের সৃষ্টিসত্তার পাশাপাশি বাংলা কবিতার বৈশ্বিক সংযোগাশ্রিত নব-বাঁকবদলের পথ প্রশস্ত করেছেন। এ-জন্যে বাংলার কবি ও কবিতা তাঁর কাছে চির-কৃতজ্ঞ।


কবি নরেশ গুহ-র মতে প্রাচীন ভারতীয় মহাকবি কালিদাস আর উনিশ শতকী ইউরোপের অন্যতম প্রধান কবি বোদলেয়ার ছাড়াও যে তিন ভাষার তিনজন কবিকে বুদ্ধদেব বসু বিশেষভাবে বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা হলেন আয়ারল্যাণ্ডের ইয়েট্স্, জার্মানির রিলকে আর রাশিয়ার পাস্টেরনাক। আমরা এর সঙ্গে এজরা পাউণ্ডের নামটিও অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত করতে চাই। বুদ্ধদেবের উপর অমিতপ্রভাবসঞ্চারী একটি কাব্যের নাম অবশ্যই ‘পিজান ক্যান্টোজ’। ‘কবিতা’ পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন, “আজ যারা বাংলা সাহিত্যে এলিয়টের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছেন, অবাক লাগছে তাঁরা কখনো পাউণ্ডের নাম করেন না। বাঙালি সাহিত্যসমাজকে তাই মনে করিয়ে দিই যে পূর্বে পাউণ্ডের কবিতাগুলির জন্যই সমর সেনের কয়েকটি কবিতা জন্মাতে পেরেছিলো, বিষ্ণু দে-র চোরাবালি-তে এবং সম্ভবত ভিন্ন ভঙ্গিতে অমিয় চক্রবর্তীর খসড়া-তেও সে-বীজ সক্রিয়, নিম্ন-স্বাক্ষরকারীও [অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসু] নিজেকে নানাভাবে পাউণ্ডের কাছে ঋণী মনে করে।” কবি নরেশ গুহ তাঁর ‘সম্পাদকের নিবেদন’-এ এই উদ্ধৃতি দেবার পর মন্তব্য করেছেন, “মনে হয়, এই ঋণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে ‘নতুন পাতা’র শেষ দিকে স্বতন্ত্র চিহ্নিত কয়েকটি কবিতায়।” অতএব পাউণ্ড বুদ্ধদেবের উপর এক অনস্বীকার্য নান্দনিক প্রভাবের নাম। কথাটি বলছি এই জন্যে যে, কবিতার পরিশ্রমী পাঠ, সচেতন নির্মাণ ও শ্রমসাধ্য উপলব্ধির পর তাঁর অনুবাদ তথা নান্দনিক পুনর্সৃষ্টির পরোক্ষ প্রেরণাও বুদ্ধদেব পেয়েছিলেন এজরা পাউণ্ডের কাছ থেকে। যুদ্ধবন্দী হিসাবে পিজায় গেরিলা-খাঁচা বন্দী থাকাকালে (মে-অক্টোবর ১৯৪৫) পাউণ্ড তাঁর তুঙ্গীয় সৃষ্টি পিজান ক্যান্টোজ রচনার পাশাপাশি কনফুসিয়াস শীর্ষক গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন। এটি পরে কলকাতার ওরিয়েন্ট লংম্যান্স কোম্পানি থেকে ‘Confucius : The Unwobblling Pivot & The Great Diges’ নামে প্রকাশিত হয়েছিলো। মনে হয়, প্রিয় ও দিঙ্নির্দেশক রচয়িতা ও রচনাকে আত্মস্থ করে নিজ ভাষায় পুনর্নির্মাণের এই প্রেরণা বুদ্ধদেব বিশেষভাবে পেয়েছিলেন পাউণ্ডের কবিসত্তা থেকেই।


পাশাপাশি অন্য যুক্তিও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। চীনে কবিতা (১৯৪৭) ও মার্কিনি কবিতা (১৯৫৪) অনুবাদের প্রায় ৭ বছর পর প্রকাশিত হয় বুদ্ধদেব অনূদিত কালিদাসের মেঘদূত কাব্য। কেন হঠাৎ তিনি পশ্চিমী ভাষা ও চীনা ভাষার সম্পদ থেকে ফিরে এলেন প্রাচীন ভারতীয় ভাষার এক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির দিকে? বিশেষত সংস্কৃত ভাষার কবিতার দিকে, যার সঙ্গে ‘আজকের দিনে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটেছে’? বুদ্ধদেবের মতে ‘সেই বিচ্ছেদ দুস্তর না হোক, সুস্পষ্ট।’ এর কারণ একাধিক। বুদ্ধদেবের মতানুসারে প্রথমত ‘এই অবস্থার জন্যে আমাদের অত্যধিক পশ্চিমপ্রীতিকে দোষ দেয়া সহজ’, ‘দ্বিতীয় কারণ সংস্কৃত ভাষার ও ব্যাকরণের দু-একটি বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃত শব্দসংখ্যা বিপুল, প্রতিশব্দ অসংখ্য। তার কিছু অংশ বাংলাতেও চলে এসেছে…। কিন্তু সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার–যে কোনো জীবিত ভাষার–একটি মৌল প্রভেদ দাঁড়িয়ে গেছে।’ বুদ্ধদেব এই প্রভেদটাকে দূর করে প্রাচীন ও বর্তমানের মধ্যে একটি সংযোগসেতুই কেবল রচনা করতে চাননি, বরং সংস্কৃত কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা আধুনিক শিল্পকলার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, তাকেই পুনরাবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধদেব তৎকৃত ভূমিকা-র তৃতীয় অংশে বলেছেন, ‘সংস্কৃত কবিতা সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম, আদর্শ ও তত্ত্বের দিক থেকে তা-ই, অভ্যাসের দিক থেকেও তা-ই।’ একই সঙ্গে বলা যায়, বুদ্ধদেব মেঘদূত-এর যক্ষ চরিত্রের মধ্যে একজন ‘লিবিডোভারাতুর জীব’, যার প্রেমের ধারণা শৃঙ্গার-বাসনায় সীমাবদ্ধ, তাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন, ‘তার কামাতুরতাকে স্বীকার করে নিলেই কাব্যটিকে আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারবো’। অর্থাৎ শিল্পের প্রকরণ যে কৃত্রিমতায় আবদ্ধ, আর অন্তর্প্রেরণা যে লিবিডোতাড়িত কর্মশক্তি, মেঘদূতে এই যুক্তিটি উদ্ধারযোগ্য। অনেক বিবেচনার পাশাপাশি মেঘদূত-এর এই শৈলীগত ও বিষয়গত যুগল-যুক্তিও এই কাব্যটি অনুবাদের পেছনে এক প্রমুখ প্রণোদনা।

তারপর ‘অনুবাদকের বক্তব্য’ নিবন্ধে তিনি প্রাচীন কাব্য আধুনিক ভাষায় অনুবাদের প্রয়োজন সম্পর্কে বলেছেন, “দেশ ও কালের দূরত্ব মোচনের কয়েকটি উপায় আমাদের জানা আছে। তার মধ্যে অনুবাদ একদিক থেকে সবচেয়ে কার্যকরী। লেখক ও তাঁর ভাষা যখন প্রাচীন, তখন তাঁকে সমকালীন জীবনের মধ্যে সংকলিত করার কাজটি অনুবাদকের বলে স্বীকার্য; পণ্ডিত বা পুরাবিদের নয়। অনুবাদই সেই ঘটক, অনুবাদ সেই প্রাচীনকে সজীব ও সমকালীন সাহিত্যের অংশ করে তোলে। আর সেই জন্যেই যুগে যুগে নতুন অনুবাদের প্রয়োজন হয়।” এর পরে মেঘদূত অনুবাদ বা তজ্জাতীয় যে কোনো প্রাচীন ক্লাসিক অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা বুদ্ধদেব কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন, তা মীমাংসিত হয়ে যায়। তবে এর বিপক্ষে নান্দনিক যুক্তিও আছে অবশ্যই। অনূদিত ভাষ্যে মূলের সৌন্দর্য, রহস্য ও কালানুগত্য রক্ষিত না হলে পাঠকপাঠিকা মূলের রসাস্বাদন থেকে কেবল বঞ্চিতই হবেন না, বরং সমকালকে অতিক্রম করে অতীতের স্বপ্নযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়তে পারেন। অনুবাদক শক্তিশালী হলে মূল লেখক খানিকটা আড়ালেও পড়ে যেতে পারেন। চাপম্যানের অনুবাদে হোমারের মতো মহাকবিকেও তেমন নান্দনিক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। কিংবা মাইকেলের হাতে ভিন্ন ব্যাখ্যায় উপনীত হয়েছে রাম, রাবণ বা সীতা। অভিযোজনমূলক নবসৃষ্টির ক্ষেত্রে এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা সমধিক। এক্ষেত্রে অনুবাদক নিজেই স্রষ্টাকে প্রতিস্থাপিত করার স্পর্ধা দেখান। মেঘদূত অনুবাদে বুদ্ধদেবের মগ্নতা তাঁকে তেমনি এক নবস্রষ্টার ভূমিকায় উন্নীত করেছে বলে মনে হয়।


তবে তিনি যে চিন্তাভাবনা করে বা পরিকল্পিতভাবে মেঘদূত অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, এমন নয়। সাময়িক অসুস্থতাবশত অবকাশযাপনকালে বুদ্ধদেব কিছুটা কৌতূহলবশে, কিছুটা আকস্মিকভাবে এই অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। তারপর প্রায় এক বৎসর সময় ধরে এই অনুবাদ তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। এই কাব্যের অনুবাদে তিনি যে পদ্ধতি ও চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তা-ও তিনি উল্লেখ করে গেছেন। প্রারম্ভে বর্ণিত অনুবাদের চারটি পর্যায়ের মধ্যে টেক্সচুয়াল ও রেফারেনসিয়াল পর্যায়টিকে তিনি তাঁর পদ্ধতিতে একাকার করে দেখেছেন বলে মনে হয়। প্রথমে তিনি আক্ষরিক ও বাক্য বা চরণগত অনুবাদের কথা না বলে মাত্রা-বিন্যাসের কথা বলেছেন। অর্থাৎ টেক্সচুয়াল ভাষ্যটির বিকৃতিহীন অনুবাদ যে অত্যাবশ্যকীয়, এটি তিনি স্বতঃসিদ্ধভাবে গ্রহণ করেছেন। তারপর এসেছেন কাঠামোগত অভিন্নতা সাধনের প্রশ্নে। তাই তিনি মাত্রাবিন্যাস, ভাষাভঙ্গি, রীতিমিশ্রণ, অব্যয়ের ব্যবহার, বিশেষজ্ঞের সহায়তা গ্রহণ, বানান ও ব্যাকরণ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।

তবে মেঘদূতের বঙ্গানুবাদের তাঁর চুম্বক বক্তব্য : ‘কালিদাসের বক্তব্যকে বিশ্লেষণধর্মী বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা– অনুবাদকালে এই ছিলো আমার প্রধান লক্ষ্য; অর্থাৎ আমি চেয়েছি রচনার ভাষা যতদূর সম্ভব বাংলা হোক এবং আধুনিক বাংলা।’ পাশাপাশি তিনি মূলের স্বাদ রক্ষার্থে ‘অম্বু’, ‘অম্ভোজ’, ‘দ্বিরদ’, ‘করভি’ প্রভৃতি তৎসম বা তদ্ভব শব্দও ব্যবহার করেছেন। পারম্পর্য রক্ষার জন্য চরণের শুরুতে ধ্বনিসম্মতভাবে ‘এবং’ বা তদ্রুপ অব্যয় ব্যবহারের দুঃসাহস দেখিয়েছেন : ‘এবং জলধারা জনকতনয়ার স্নানের স্মৃতি মেখে পুণ্য।’ তবে মাত্রাবিন্যাসে মূলের সঙ্গে সব সময় সাম্য বজায় রাখেননি। মন্দাক্রান্তা ছন্দ ব্যবহার করেছেন নিজের বিন্যাসে : ৭+৭+৭+(৫) বা (৪) বা (৩); এই বিন্যাস সত্যেন্দ্রনাথ প্রদর্শিত পর্ববিন্যাসের চেয়ে ভিন্নরূপ : ৮+৭+৭-৫। আবার সর্বত্র ‘আধুনিক বাংলা’ ব্যবহারের কথা বলা হলেও তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। যেমন : ‘ব্রহ্মাবর্তের প্রথিত জনপদ, একদা যেথা কুরুক্ষেত্রে/ কমলদলে তুমি যেমন ঢালো জল, তেমনি অবিরল শরজল/…”। আসলে এই ধরনের অনুবাদে সব সময় উক্তি ও উপলব্ধি অদ্বৈতসাধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে সুসংবাদ এই যে, সংস্কৃত ভাষ্য বাদ দিয়ে কেবল বুদ্ধদেব-কৃত বাংলা-ভাষ্য পাঠ করলে মনে হয়, এটি একটি গ্রহণযোগ্য পুনর্সৃষ্টি, যেখানে তদ্ভব-তৎসম-আশ্রিত বাংলা ভাষাভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে। মূল ভাষ্যের পাশাপাশি বুদ্ধদেব সত্যেন্দ্রনাথ দত্তসহ আরো কয়েকজন পূর্বসূরীর অনুবাদ ও ব্যাখ্যার সাহায্য পেয়েছিলেন। আর তিনি তো নিজেই বলেছেন, তাঁর অনুবাদ যতোটা ব্যাখ্যামূলক ততোটা অভিন্নমূলক নয়। ফলে তিরিশি আধুনিকতার স্পর্শধন্য এই অনুবাদ এখনো বাঙালি পাঠককে আনন্দ দিচ্ছে। ভাষাভঙ্গির স্বতঃশ্চলতার কারণে এখন যদি নতুন কোনো কবির হাতে মেঘদূত-এর নতুন অনুবাদ আসে, তা-ও হবে ভঙ্গি ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পরিবর্তনমূলক। বুদ্ধদেবের অনুবাদের কারণে সে কাজটি এখন যথেষ্ট ঝৃঁকিপূর্ণ। কেননা একালের অনুবাদককে পাঠে, অনুধাবনে ও পুনর্নিমাণে বুদ্ধদেবের চেয়ে অধিক না হলেও অন্তত সমান পরিশ্রমী ও কুশলী হতে হবে।

১০
মার্কিনি কবিতারুশ কবিতার সঙ্গে অনুবাদকের কোনো মন্তব্য নেই। ধরে নেয়া যায়, এই বক্তব্য অপরাপর পশ্চিমা কবিতা অনুবাদে যে-পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে, তার অনুরূপ। মার্কিনি কবিতার সঙ্গে ভূমিকাও নেই। রুশ কবি বরিস পাস্টেরনাক ও তাঁর রচিত ‘জিভাগোর কবিতা’ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা আছে। তাছাড়া অনূদিত প্রায় কবিতার বিভিন্ন আপাত-অপরিচিত বাক্যাংশ, সল্যুশন ও অন্যান্য অনুষঙ্গ সম্পর্কে টীকা-ভাষ্য আছে। এটি যেমন শ্রমসাধ্য, তেমনি গবেষণাধর্মী ও অন্তর্ভেদী। বুদ্ধদেব বসুর পাঠ-গভীরতা ও ব্যাপ্তির পরিচয় এসব কাজে এতোটাই বিস্তৃত যে, এক্ষেত্রে সমগ্র বাংলা ভাষায় তাঁর কোনো নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া ভার। আর বোদলেয়ার, রিলকে ও হ্যেল্ডার্লিনের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে তথ্যনির্ভর ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। বলা চলে, রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতার নতুন বিন্যাসে তাঁর প্রদর্শিত কাব্যনিরিখ, যা মূলত এইসব কবির কাব্য-উৎকর্ষ ও নন্দনভঙ্গির অনুবর্তী, বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

বোদলেয়ার, হ্যেল্ডারলিন ও বরিস পাস্টেরনাকের মধ্যে একটি বিষয়ে খানিকটা মিল আছে। সেটি সমকালে ও স্বদেশে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা। এই গ্রহণযোগ্যতা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপ্ত থাকার কথা ছিল, প্রকৃত প্রস্তাবে তা ছিল না। কারণও সেই পুরনো যুক্তি। তাঁরা বোধে ও প্রতীতিতে, এমনকি তাঁদের শৈল্পিক শৈলীতে সমকালের চেয়ে অগ্রণী ছিলেন। সর্বপর্যায়ে শিল্পে ও কবিতায় সমর্পিত ছিলেন এই তিনজন। একই কথা প্রযোজ্য রাইনের মারিয়া রিলকের ক্ষেত্রেও। ‘এমন এক কবি যিনি সর্বতোভাবে কবি হতে চেয়েছিলেন। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তের কবি। দৈনন্দিনতম জীবনের অর্থহীনতম মুহূর্তেও। ভ্রমণে ও মননে, বাক্যে, ব্যবহারে, পত্ররচনায়। যখন তিনি কবিতা লিখছেন না বা লিখতে পারছেন না, তখনও।’
যতই মহৎ কবি হোক-না-কেন, একজন শিল্পী সম্পর্কে এ ধরনের উক্তি অত্যুক্তির পর্যায়ে পড়ে। বুদ্ধদেব বসুর প্রশংসার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তাতে অতিকথনের ছড়াছড়ি। এটি কবিতার জন্য প্রয়োজনীয় হলেও গদ্যের জন্য নয়। বোদলেয়ার সম্পর্কে এই ধরনের মূল্যায়ন বুদ্ধদেবের : ‘প্রথম দ্রষ্টা তিনি, কবিদের রাজা এক সত্য দেবতা।’ যদিও আর্তুর র‌্যাবো-র উক্তি এটি, তাতে সমর্থন আছে বুদ্ধদেব বসুর। এর একটি কারণ সাহিত্যিকভাবে কৌশলগত। শ্রেয়ঃবোধ, মানবিক কল্যাণকামিতা কিংবা বহির্মুখী অভিব্যক্তির প্রাবল্যে বাংলা কবিতার মূল স্রোত যখন অতিপ্লাবিত, রাবীন্দ্রিক সর্বমাত্রিকতা যখন বাংলা কবিতার উৎকর্ষের মাপকাঠি, তখন এ ধরনের বিষাদাশ্রিত, অন্তর্মুখী ও মননশাসিত কবিতার শর্তহীন জয়ধ্বনি ছাড়া বাংলা কবিতার বাঁকবদলের আর উপায়ান্তর কী? বুদ্ধদেব বসু একা তাঁর কাব্যপাঠ, বীক্ষণ, মনন ও পরিশীলন দিয়ে এ কাজটি করেছেন। আর এ কাজে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল অনুবাদ। ফলে তাঁর অনুবাদ তাঁর মৌলিক সৃষ্টির মতো শক্তিশালী ও সমান্তরাল ধারা।

১১
আর বুদ্ধদেবের অনুবাদের পদ্ধতি? সেটি, আগেই বলেছি, বোদলেয়ার, হ্যেল্ডার্লিন, পাস্টেরনাক, রিলকেসহ পাশ্চাত্যের সব ভিন্ন ভাষার কবির ক্ষেত্রে প্রায় সমপর্যায়ের। বোদলেয়ার অনুবাদের পদ্ধতি সম্পর্কে বুদ্ধদেব বলেছেন, ‘সর্বত্র অবিকল রেখেছি বোদলেয়ারের স্তবকসজ্জা ও মিলের বিন্যাস, চিত্রকল্পের ব্যবহারেও নিজেকে কোনো স্বাধীনতা নিতে দিইনি, যদিও বিশেষণ বা বিশেষ্যপদের সংখ্যায় বা সংস্থাপনে আক্ষরিক অনুকরণের চেষ্টা কোথাও-কোথাও অসম্ভব বুঝে ত্যাগ করেছি।…এর কারণ, বলা বাহুল্য, বাংলা ভাষার প্রকৃতি, বাংলা ব্যাকরণের বৈশিষ্ট্য, ও ছন্দ-মিলের অনুশাসন।’

এই সময়ে বুদ্ধদেবের নিজের কবিতায় মিলের দুর্ভিক্ষ দেখা গেলেও বোদলেয়ারের কাব্যানুবাদে যথাসম্ভব মিল অটুট রাখতে পেরে তিনি আনন্দিত। হ্যেল্ডারলিনের কবিতার অনুবাদ পদ্ধতিও প্রায় অনুরূপ। তবে এক্ষেত্রে তাঁর আরো সুপ্রযুক্ত উক্তি, ‘অন্য একটি বিষয়েও আমি নিরন্তর মনোযোগী ছিলাম যাতে বাংলা ভাষার কবিতা হিশেবে অনুবাদগুলো পাঠযোগ্য হয়, কেননা আমার বিশ্বাস যে কবিতার অনুবাদের পক্ষে কবিতা হয়ে ওঠাই সবচেয়ে জরুরি দরকার।’
রিলকের কবিতার অনুবাদের পদ্ধতি প্রায়-সমরূপ হলেও ব্যতিক্রম এটুকু যে, “মূলের মিলবিন্যাস সর্বত্র বজায় রাখতে পারিনি, ব্যতিক্রমগুলি টীকার অংশে উল্লেখিত হলো।…ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করেছি চঞ্চল ছন্দ, মধ্য-মিল ও স্বরব্যঞ্জনের অনুবাদ ব্যবহার করে।”

এই একই ঊনতা ঘটেছে পাস্টেরনাকের কবিতার অনুবাদেও। ছন্দে-মিলে পাস্টেরনাকের খ্যাতি অসামান্য। বুদ্ধদেব যেহেতু ইংরেজি অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন, আর ইংরেজি ভাষ্যে যেহেতু মূলানুগ মিল ছিল না, সেহেতু বুদ্ধদেব সেই মিল অনুসরণ করতে পারেননি। তা না থাকলেও, বুদ্ধদেবের ধারণা, তাঁর অনুবাদ গ্রহণযোগ্য মানের। কারণ পাস্টেরনাকের কবিতার সারবস্তু প্রশ্নাতীত। বুদ্ধদেবের যুক্তি হচ্ছে, কবিতায় সারবস্তু যত বেশি থাকে, অনুবাদের জন্য ততই মঙ্গল। সারবস্তুসম্পন্ন কবিতাকে অনুবাদ তেমন জখম করতে পারে না। এই যুক্তি যেমন বৈষয়িক, তেমনি নান্দনিক।
বুদ্ধদেব অনূদিত পাস্টেরনাকের ‘নেশা’ কবিতাটি পড়া যাক :
উইলো গাছ, আইভি লতায় ঘেরা,
ঝড়ের দিনে লুকিয়েছি তার তলায়,
এক চাদরে দুজনে রই ঢাকা।
আমার বাহুবন্ধে বাঁধা তুমি।
ভুল হ’লো যে, ঝোপের গাছগুলো
আইভিতে নয়, কড়া নেশায় ঘেরা।
তাহলে, বেশ, চাদরটাকে টেনে
নাও মাটিতে পেতে।
তিরিশোত্তর বাংলা কবিতার রুচি-পরিশীলনে, শব্দে, ছন্দে, চিত্রে বা অভিব্যক্তিতে এটি একটি নিটোল বাংলা কবিতা। ভাষিক দূরত্ব বা শৈলীগত ভিন্নতা সত্ত্বেও এক ভাষার কবিতা যখন অন্য ভাষায় এমন মৌলিকতার দাবি নিয়ে দাঁড়ায়, তখন তাকে অনুবাদ বলা যায় না। সেহেতু বুদ্ধদেব বসু অনুবাদ ও মৌলিকতার সযত্ন সহচর। আর অনুবাদক বুদ্ধদেবও এক মৌলিক স্রষ্টা। ভিন্ন ভাষার ঐশ্বর্য নিয়ে তিনি বাংলা ভাষার দিগন্তকে বিশ্বসীমায় প্রসারিত করেছেন। তাই তিনি উত্তরকালে সর্বমান্য।
০৫.০২.২০১৩