শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের আন্দোলন যেভাবে সাফল্যের দুয়ারে

গত জুন মাস, শ্রীলঙ্কার ঝিমিয়ে পড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে সে সময় কলম্বোর সমুদ্র তীরবর্তী তাঁবুতে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী নিয়মিত বৈঠক শুরু করেন বেশ কয়েকজন আন্দোলনকর্মী।

>>রয়টার্স
Published : 12 July 2022, 01:18 PM
Updated : 13 July 2022, 05:57 AM

এই দলে ছিলেন একজন ক্যাথলিক যাজক, ডিজিটাল কৌশলবিদ এবং জনপ্রিয় একজন নাট্যকারও। আন্দোলনকর্মীদের এ দলটিই শ্রীলঙ্কা সংকটে অপ্রত্যাশিত সফলতা পেয়েছে।

বৈঠক শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ কলম্বোর রাস্তায় নেমে পড়লে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়।

প্রাথমিকভাবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর প্রধান প্রধান সব সরকারি ভবন ও বাসস্থান দখলে নেয় বিক্ষোভকারীরা। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও তার প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য করে।

শ্রীলংকার একটি প্রধান বিজ্ঞাপনী সংস্থার ডিজিটাল কৌশলবিদ, যিনি আন্দোলনকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি আয়োজনে সহায়তা করেছিলেন, সেই চামিরা দেদ্দুভাগে বলেন, “আমি এখনও এ কর্মসূচিকে সচল রাখার চেষ্টা করছি।”

“৫০ শতাংশ পরিকল্পনা এবং সমন্বয়, আর ৩০ শতাংশ জনগণের সদিচ্ছা এবং ২০ শতাংশ ভাগ্যের জোরে এটি হয়েছে,” বলেন তিনি।

জুনে শুরু হওয়া নিয়মিত সেই ছোট ছোট বৈঠকে যারা ছিলেন প্রবীণ মুখ, তারাই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলনকে চাঙ্গা করার মূলমন্ত্র কী ছিল তা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, কীভাবে তারা সিংহলি ভাষায় ‘আরাগালায়া’ বা ‘সংগ্রাম’ হিসাবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পাওয়া এই আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চার করতে বহুমুখী প্রচারে রাজি হয়েছিলেন।

চরম অর্থনৈতিক সংকটকে সামনে রেখে গত মার্চে সরকার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সে সময় বিদ্যুৎ ঘাটতি ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামবৃদ্ধির ক্ষোভ প্রকাশ করতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল।

তখন তারা শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে দুই দশকের বেশি সময় আধিপত্য ধরে রাখা রাজাপাকসে ও তার পরিবারকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানায়।

বিক্ষোভের মুখে গত ৯ মে রাজাপাকসের বড় ভাই মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে সম্মত হন। মাহিন্দা ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন।

পরবর্তীতে ৯ জুন পার্লামেন্টের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘোষণা দেন তাদের ছোট ভাই বাসিল রাজাপাকসে। এরপর প্রেসিডেন্টকে গদি থেকে টেনে নামাতে ‘আরাগালায়া’ কর্মীরা ৯ জুলাইকে টার্গেট ধরে এগুতে থাকে। শুরু হয় নানা পরিকল্পনা। আর সেইমত চলতে থাকে কাজ।

অনলাইনে সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা, রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়ন ও ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক, এমনকী সরকারকে শেষ ধাক্কা দেওয়ার জন্য রাস্তায় আবারও যথেষ্ট মানুষকে বিক্ষোভে নামাতে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে প্রচার চালানোরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়।

দেশে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট, জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব এবং প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের ক্ষমতা থেকে সরে না দাঁড়ানোর একগুঁয়ে আচরণ নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরেই শ্রীলংকানরা হতাশায়, ক্ষোভে ফুঁসছিল।

সেই ক্ষোভেই জনজোয়ার দেখা যায় গত শনিবার। ট্রেন, বাস, লরি, সাইকেলে চড়ে এমনকী পায়ে হেঁটেও কলম্বোর বিক্ষোভে জড়ো হতে থাকে অগনিত মানুষ। সংখ্যায় তারা ছাড়িয়ে যায় সরকারি ভবন রক্ষায় নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সংখ্যাকে।

কলোম্বার ফোর্ট এলাকায় ‘গোটা গো হোম’ স্লোগান দেয় বিক্ষোভকারীরা। শিগগিরই তারা প্রেসিডেন্টের ঔপনিবেশিক আমলের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এর আড়াই কিলোমিটার দূরে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনেও ঢোকে তারা।

অবস্থা বেগতিক দেখে রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সর্বদলীয় অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তরে কথা জানিয়ে তারা আলাদাভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

আগামী বুধবার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগ করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদত্যাগ করলে গোটাবায়াই হবেন শ্রীলঙ্কার পদত্যাগ করা প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি দেশে কয়েক দশকের গৃহযুদ্ধ থামিয়ে এক সময় নায়ক হিসেবে সম্মান পেয়েছিলেন।

বিক্ষোভের অন্যতম সংগঠক নাট্যকার রুওয়ান্থিয়ে দ্য চিকেরা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “এটিকে আমি দেশের নজিরবিহীন আন্দোলন বলে মনে করি।”

তবে পদত্যাগ ও বিক্ষোভের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রতিনিধিদের তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তারা কেন সরে দাঁড়াচ্ছেন এবং কোথায় আছেন সে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসেনি।

সম্মিলিত প্রচেষ্টা

শ্রীলঙ্কায় প্রায় ৫০ লাখ পরিবার এবং ৮০ লাখ সক্রিয় ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে; ফলে অনলাইনে বিক্ষোভকারীদের কাছে পৌঁছানো এবং সংগঠিত করাটা ছিল খুবই কার্যকর একটি পন্থা, বলেছেন ডিজিটাল কৌশলবিদ চামিরা দেদ্দুভাগে।

তিনি বলেন, “এর মানে হচ্ছে, মূলত ফেইসবুকে কোনো খরচ ছাড়াই আমরা দেশের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে যেতে পারি।”

প্রেসিডেন্টকে ব্যাঙ্গ করে ‘গোটা গো ভিলেজ’ নামে কলোম্বোয় চালু হয়েছে বিক্ষোভের মূল ওয়েবসাইট। সেই সাইট সামনে নিয়ে একটি তাঁবুতে বসে কথাগুলো বলেন দেদ্দুভাগে।

জুলাইয়ের শুরুতে ওই বিক্ষোভকারী গ্রুপের স্যোশাল মিডিয়া বার্তা যারা পেয়েছেন তেমনই একজন হচ্ছেন, সাথিয়া চরিথ অমরাতুঙ্গে। কলোম্বো থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের শহর মোরাতুওয়াতের বাসিন্দা তিনি। আগেও সরকার বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন অমরাতুঙ্গে।

৩৫ বছর বয়সী অমরাতুঙ্গে গত ২ জুলাই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সিংহলি ভাষায় ‘দ্য কান্ট্রি টু কলম্বো, ৯ জুলাই’ লেখা একটি পোস্টার পান এবং সেটি তার ব্যক্তিগত ফেইসবুক পেইজে আপলোড করেন।

সেই থেকেই তিনি লাখো মানুষ নিয়ে কলম্বোর দিকে পদযাত্রায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রচার অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করেন।

আরাগালায়ার অন্যান্য সদস্যরা মূলত বিরোধী রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, প্রভাবশালী ইন্টার ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ফেডারেশনসহ (আইইউএসএফ) ও ছাত্র ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে সমর্থন জোরদার করেন।

শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম ছাত্র গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আইইউএসএফ এর রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য খ্যাতি রয়েছে এবং সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, কাঁদানে গ্যাস ও জলকামানের মধ্যেও তারা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙেছে।

ওদিকে, আরাগালায়া গ্রুপ স্বেচ্ছাসেবকদেরও কলম্বোর বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার বাড়ি পরিদর্শন করে তাদেরকে শনিবারের বিক্ষোভ সম্পর্কে জানাতে নির্দেশনা দেয়। তাছাড়া, শহরের বাইরে থেকে মানূষের জমায়েত বাড়াতে কর্মীরা সারাদেশ ৩০টিরও বেশি ‘গোটা গো ভিলেজ’ সাইট তৈরি করে আন্দোলনকে চাঙ্গা করে তুলে।

অপরদিকে, বিক্ষোভ থামাতে ৮ জুলাইয়ের শেষ দিকে কলম্বোর পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলায় কারফিউ ঘোষণা করা হয়। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ থামিয়ে দিতে এটি পুলিশের পরিকল্পনার অংশ ছিল বলেই ভাষ্য বিক্ষোভকারীদের।

তবে পুলিশ বলেছিল, শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিক্ষোভকারীরাও তাদের গ্রেপ্তার ঠেকাতে নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছিল।

ক্যাথলিক যাজক জীবন্থ পিরিস রয়টার্সকে বলেন, বিধিনিষেধের কারণে বিক্ষোভে মাত্র ১০ হাজার লোকের জমায়েত হবে বলে ধারণা করেছিলেন তিনি। তার ওপর জ্বালানি ঘাটতির কারণে পরিবহন কয়েক সপ্তাহ ধরেই কম ছিল।

“আমরা এই সব বিধিনিষেধ ও গ্রেপ্তারের ভয় কাটিয়ে বিক্ষোভে মাত্র ১০ হাজার মানুষই আসতে পারবে বলে ভেবেছিলাম। মনে করেছিলাম, পাঁচ থেকে ১০ হাজার মানুষের জমায়েত হবে।”

হাল না ছাড়ায় গণমানুষের জয়:

স্যোশাল মিডিয়ায় বিক্ষোভের বার্তা পাওয়া অমরাতুঙ্গে জানান, ৯ জুলাই ভোরে তিনি অন্তত ২০০০ বিক্ষোভকারীকে সঙ্গে নিয়ে মোরাতুওয়া থেকে কলম্বোর দিকে হেঁটে যাত্রা শুরু করেন। অনলাইনে এক সপ্তাহ প্রচার চালিয়ে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়ার কথা জানান তিনি।

অমরাতুঙ্গে আরও বলেন, হাঁটার পথে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কত মানুষ কলম্বো যেতে চায়। কারফিউ দেখে অনেকেই ছিল ক্ষুব্ধ। যদিও শনিবার সকালে পুলিশ তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

ওইদিন অমরাতুঙ্গের পোস্ট করা একাধিক ফেইসবুক লাইভে কয়েক হাজার মানুষকে কলম্বোর প্রধান সড়কে হাঁটতে দেখা যায়। তাদের কারও কারও হাতে ছিল জাতীয় পতাকা।

সব বাধা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভের স্থান কলম্বোর দুর্গ এলাকায় পৌঁছান। নাম প্রকাশ না করা এক পুলিশ কর্মকর্তার মতে সেখানে কমপক্ষে দুই লাখ মানুষের জমায়েত হয়েছিল।

শনিবার বিকালের মধ্যেই পুলিশের ব্যারিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাড়ি আগলে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা দরজাগুলো ভেঙে ফেলে। প্রেসিডেন্ট বাসভবনের নিরাপত্তায় থাকা বিশাল বাহিনীও তখন হয়ে পড়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়

রাতে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া এবং প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সরকারি বাসভবন  বিক্ষোভকারীদের দখলে চলে যায়। এ সময় সচিবালয়ের বাইরের সীমানা প্রাচীর উপড়ে ফেলে সেটিরও একটি অংশ দখলে নেয় বিক্ষভকারীরা।

বিক্রমাসিংহের ব্যক্তিগত বাসভবনের একটি অংশে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নেতারা পালিয়ে যেতে মনস্থির করেন।

এই গণবিক্ষোভের কথা স্মরণ করে যাজক জীবন্থ পিরিস বলেন, “বিক্ষোভে বহু বৃদ্ধ, কিশোর, যুবক, নারী অংশ নিয়েছে। মানুষ হাল ছাড়তে চায়নি, সফল না হয়ে তারা বাড়ি ফিরে যেতে চায়নি।”