বাধা উপেক্ষা করে স্বাধীনতার গণভোটে কাতালুনিয়া

স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার ও সাংবিধানিক আদালতকে উপেক্ষা করে পুলিশের বাধা আর বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটে অংশ নিচ্ছে কাতালুনিয়া।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2017, 05:09 AM
Updated : 1 Oct 2017, 01:05 PM

কাতালান ইমার্জেন্সি সার্ভিসের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৩৩৭ জন আহত হয়েছেন।

পুলিশ এই ভোট ঠেকাতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে বাধা দিয়েছে, ব্যালট পেপার ও বাক্স কেড়ে নেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে।

আঞ্চলিক রাজধানী বার্সেলোনায় রাবার বুলেট ছুড়ে স্বাধীনতাপন্থিদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছে পুলিশ।

স্পেন সরকার সাংবিধানিক আদালতের রায় মেনে কাতালানবাসীকে এই ভোট বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।

অন্যদিকে পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে কাতালান নেতা কার্লোস পুজদেমন বলেছেন, “স্প্যানিশ রাষ্ট্রের এই অন্যায় সহিংসতা কাতালান জনগণের ইচ্ছাকে দমাতে পারবে না।”  

স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের বসবাস কাতালুনিয়ায়। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ২৫.৬ শতাংশ এ অঞ্চল থেকেই আসে। মোট বিদেশি বিনিয়োগের ২০.৭ শতাংশ পাওয়া কাতালুনিয়াই স্পেনের জিডিপির ১৯ শতাংশের যোগান দেয়।        

ভোটের চিত্র

কাতালুনিয়ার এই গণভোটের ব্যালট পেপারে প্রশ্ন রাখা হয়েছে- আপনি কি চান কাতালুনিয়া একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক?

ভোটারদের উত্তর দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে দুটি ঘর- ‘হ্যাঁ’, অথবা ‘না’।

এই ভোট বন্ধ করতে কেন্দ্রীয় সরকারের চেষ্টার মধ্যেই কাতালান সরকার ঘোষণা দেয়, ভোটাররা নিজেদের মত করে ব্যালট পেপার প্রিন্ট করে নিতে পারবে এবং নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্র বন্ধ পেলে যে কোনো কেন্দ্রে ওই ব্যালট বাক্সে ফেললেই হবে।   

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রোববার সকাল ৯টায় শুরুর কথা থাকলেও কিছু কেন্দ্রে আগেই ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে যায়। একই সঙ্গে স্পেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ও বাক্স জব্দ করতে শুরু করে পুলিশ।

দাঙ্গা পুলিশ জিরোনা শহরের একটি স্পোর্টস সেন্টারে বসানো ভোটকেন্দ্রে ঢুকে ভোটারদের সরিয়ে দেয়; ওই কেন্দ্রেই ভোট দেওয়ার কথা ছিল কাতালান নেতা কার্লোস পুজদেমনের।

টিভি ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ ওই স্পের্টস সেন্টারের দড়জা ভেঙে ফেলেছে এবং যারাই ভোট দিতে যাচ্ছে, তাদের জোর করে বের করে দিচ্ছে। 

কার্লোস পুজদেমনে পরে অন্য একটি কেন্দ্রে তার ভোট দেন বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়।

স্বাধীনতাপন্থিরা গত শক্রবার থেকেই বিভিন্ন স্কুল ভবনের দখল নেন যাতে সরকার ভোট বন্ধ করতে না পারে। বহু অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে স্কুলের ভেতরেই রাত কাটান। আর কৃষকরা ট্রাক্টর দিয়ে স্কুলের ফটক আর ভোটকেন্দ্রের আশপাশের সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করেন, যাতে পুলিশ সহজে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে।

ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন বহু স্কুলের প্রধান ফটকও সরিয়ে ফেলা হয়, যেন চাইলেও ভবনগুলো আটকে দিয়ে ভোট বন্ধ না করা যায়।

বিবিসি লিখেছে, সকালে বার্সেলোনার বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করতে এসে মানবপ্রাচীরের মুখোমুখি হয়ে ফিরে যেতে হয় কেন্দ্রীয় সরকারের দাঙ্গা পুলিশকে।  

বার্সেলোনার একটি স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ৬৫ বছর বয়সী ইউলিয়া এসপিনা তারো বলেন, “সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছি, কারণ আমাকে দেশের প্রয়োজন। জানি না কী হবে, তবে আমাদের এখানেই থাকতে হবে।”

কাতালান আঞ্চলিক সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওরিও জেনকুয়েরাও ভোটের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় জানান।

টিভিথ্রি-কে তিনি বলেন, রোববার গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন হতে যাচ্ছে।

স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার কাতালুনিয়ার এই গণভোটকে ‘সাংবিধানিকভাবে অবৈধ’ অ্যাখ্যা দিয়ে যে কোনো মূল্যে তা বন্ধের হুংকার আসছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অতিরিক্ত কয়েক হাজার পুলিশ এনে মোতায়েন করা হয়েছিল বার্সেলোনা ও অন্যান্য শহরে।

রোববার সকালে ৩০টি ভ্যান, বিভিন্ন আকারের যানবাহন ও ট্রাক নিয়ে সিভিল গার্ড পুলিশের  সদস্যদের বার্সেলোনার বন্দর ছাড়তে দেখা যায়। শহরজুড়ে দেখা যায় অসংখ্য পুলিশ।

বিবিসি জানিয়েছে, স্পেন সরকার কাতালান আঞ্চলিক পুলিশের কর্মকর্তাদের কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করার নির্দেশ দিলেও তারা মাঠে নামেনি।

কেন এই গণভোট

সম্পদশালী কাতালুনিয়া স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। প্রায় ৭৫ লাখ বাসিন্দার এই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিও আলাদা।

গৃহযুদ্ধের আগে কাতালুনিয়া আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন পেলেও ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনের সময় তা নানাভাবে খর্ব করা হয়। ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর কাতালান জাতীয়তাবাদ ফের শক্তিশালী হতে শুরু করে, আন্দোলনের মুখে ১৯৭৮ সালে তাদের স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

স্পেনের পার্লামেন্ট ২০০৬ সালে নতুন আইন করে কাতালুনিয়ার আঞ্চলিক সরকারের হাতে আরও কিছু ক্ষমতা দেয়। কাতালানদের দেওয়া হয় জাতির মর্যাদা। কিন্তু পরে স্পেনের সাংবিধানিক আদালতে সেসব বাতিল হয়ে যায়।

স্বাধীনতাকামী কাতালানরা ২০১৪ সালে অনানুষ্ঠানিক এক গণভোটের আয়োজন করে, যাতে ৫৪ লাখ ভোটারের মধ্যে ২০ লাখের বেশি ভোটার অংশ নেয়। ওই ভোটের পর বলা হয়, ৮০ শতাংশের বেশি ভোটার স্পেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে।

স্বাধীনতাকামীরা ২০১৫ সালে কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক সরাকরের  নির্বাচনে জয় পেলে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দেয়।

গণভোট আয়োজনে এ মাসের শুরুর দিকে কাতালান পার্লামেন্ট নতুন একটি আইন পাস করে, যাতে স্থগিতাদেশ দেয় স্পেনের সাংবিধানিক আদালত। দেশটির সংবিধানে বলা হয়েছে, স্পেনকে বিভক্ত করার যে কোনো উদ্যোগই হবে অবৈধ।

এরপরও কাতালুনিয়ার স্থানীয় সরকার যথাসময়ে গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে থাকলে তাদের থামাতে বল প্রয়োগ শুরু করে মাদ্রিদ; শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড় ও তল্লাশি অভিযান।

কাতালান আঞ্চলিক সরকার বলছে, গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় এলে তা বাস্তবায়নে প্রক্রিয়া শুরু করবে তারা।