হিযবুত: মামলা হয়, এগোয় না

নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারের পর মামলা হলেও তাতে ত্রুটি এবং প্রশাসনিক মনোযোগের অভাবে পার পেতে যাচ্ছে আসামিরা।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2012, 00:26 AM
Updated : 17 Dec 2017, 03:59 AM

ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে উগ্রবাদী এই সংগঠনটির সম্পৃক্ততা উঠে আসার পর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বিষয়ে সরকারের বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার আদালতে হিযবুত সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হলেও শর্ত অনুযায়ী প্রায় ক্ষেত্রেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৪০ ধারায় বলা হয়েছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এই আইনের অধীন কোনো অপরাধের তদন্ত করতে পারবেন না।

সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো আদালত এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ বিচারের জন্য আমলেও নিতে পারবেন না বলে আইনে বলা রয়েছে।

মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, অধিকাংশ মামলাতেই সরকারের অনুমোদন নেই। রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর কার্যালয় অথবা প্রসিকিউশন পুলিশের কার্যালয়ে এই ধরনের তদন্তাধীন এবং বিচারাধীন মামলার কোনো পরিসংখ্যানও পাওয়া যায়নি।

এই বিষয়ে ফৌজদারি মামলা সম্পর্কে অভিজ্ঞ আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিন এবং আমিনুল গণী টিটো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই ত্র“টির কারণে শুধু আসামিরা খালাস পেয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয়, বিচারের আগে অব্যাহতিও পেয়ে যেতে পারেন।

“তাই এই ধরনের মামলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে,” বলেন টিটো।

ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের পেশকার আরিফুর রহমান জানান, তার আদালতে এই ধরনের বেশির ভাগ মামলাতেই অনুমোদন নেই।

এই আদালতে মামলা রয়েছে জিগাতলার আব্দুর রকিব খানের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি জিগাতলা একটি বাড়ি থেকে তাকে হিযবুত তাহরীরের বইসহ গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলারও নথিপত্রে দেখা যায়, আমলে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেই। মামলাটি খারিজে গত ২৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে। তাতে প্রধান যুক্তি দেখানো হয়েছে সরকারি অনুমোদন না থাকার কথা।

একই চিত্র দেখা যায় অন্য আদালতের মামলাগুলোতেও। ঢাকার মহানগর দায়রা জজ ও বিশেষ জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের কৌঁসুলিদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট নয়।

মহানগর দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত কৌঁসুলি শাহ আলম তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইনের অনেক ফাঁক রয়েছে। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি চর্চার ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত মনিটরিং সেলের বৈঠকে উত্থাপন করেছি। তাতে কতদূর কাজ হয়েছে বলতে পারব না।”

“মামলা দায়েরের সময় নেওয়া সম্ভব না হলেও তদন্ত প্রতিবেদন অর্থাৎ অভিযোগপত্র দাখিলের সময় এই অনুমোদন নেওয়া উচিৎ বাদি এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের। তা না হলে কোনো আদালতই আসামিদের আটকে রাখতে পারবে না,” বলেন তিনি।

ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ জামাল লিটন বলেন, হিযবুত তাহরীর সদস্যদের ক্ষেত্রে পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমোদন ছাড়া মামলা দায়ের করে এবং তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

“আর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সেইসঙ্গে নিু আদালতের বিচারকরা অতিরিক্ত সর্তকতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে এই মামলাগুলো অন্য মামলার মতোই দেখে থাকেন,” বলেন তিনি।

২০০৯ সালের অক্টোবরে হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ করে সরকার। তবে মাঝে-মাঝেই সংগঠনটি প্রকাশ্য তৎপরতার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। আর এতে গ্রেপ্তার হচ্ছে ইসলামী এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

গত ডিসেম্বরে অভ্যুত্থান চেষ্টার কথিত নায়ক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে সেনাবাহিনী জানিয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে হিযবুত সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের পাঁচটি মামলা। এর মধ্যে তিনটি অভিযোগ গঠনের এবং দুটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

এর একটি মামলার আসামি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ছাত্র মো. সাইদি হাসান সজিব এবং এমবিএ ছাত্র মো. শামীম তালুকদার (২৬)। এই ইনস্টিটিউটেরই শিক্ষক ছিলেন হিযবুতের বাংলাদেশ শাখার প্রধান মো. মহিউদ্দিন, যিনি দুই বছর আগে গ্রেপ্তার হন।

সজিব ও শামীমকে গত বছরের ৪ মার্চ সরকার উৎখাতের আহ্বান সম্বলিত পোস্টারসহ র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। পরদিন র‌্যাব-২ এর ডিএডি দিলীপ কুমার বাগচী বাদি হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে হাজারীবাগ থানায় মামলা করেন। এক মাস পর থানার উপ-পরিদর্শক শাহীনূর রহমান তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এই মামলা দায়েরের জন্য কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে মামলার নথিপত্রে দেখা যায়। গত বছরের ২৫ মে বিচারক এ এফ এম আমিনুল ইসলাম এক আদেশে উল্লেখ করেছেন, কোনো অনুমোদন বা অনুমতি নথিতে নেই। মামলার দুই আসামিই জামিনে রয়েছেন।

গত বছরের ১৫ এপ্রিল পুরানা পল্টনের কস্তুরি হোটেলের সামনে থেকে হিযবুত তাহরীরের প্রচারপত্র বিলির অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কাদের জামিলসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়, এতেও কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়ান।

এই ধরনের মামলায় পদক্ষেপ গ্রহণ, শুনানির দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি জাহাঙ্গীর হোসেন দুলাল স্বীকার করেন, যথাযথভাবে মামলা না হওয়ায় আসামিরা পার পেয়ে যেতে পারেন।

যথাযথ অনুমোদনহীনতার পাশাপাশি বিচারাধীন মামলায় সাক্ষীদের অনুপস্থিতিও বিচারকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিচ্ছে বলে আইনজীবীরা বলছেন।

২০০৯ সালের ১২ মার্চ বেইলি রোড এলাকা থেকে বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য সম্বলিত প্রচারপত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এস এম সরফরাজ শিশিরকে।

ঢাকার ২ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন রমনা থানার এই মামলায় অভিযোগ গঠনের পর ৫/৬টি তারিখ পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্র পক্ষ অভিযোগ প্রমাণে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।

ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে হিযবুত সদস্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র মাসুম পারভেজ ও আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলাটিও একই ভাবে আটকে রয়েছে। ২০১০ সালের ৩০ জুন অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য নয়টি তারিখ পার হলেও এখনো কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি।

এভাবে জঙ্গি এই সংগঠনটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো মামলার পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে, বিচার আর শেষ হচ্ছে না।