টিপুর চলে যাওয়া

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম টিপু। বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ছিলেন বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনেরও কার্যনির্বাহী সদস্য। গত ২৫ জুলাই নিজের বাসার সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন বাংলাদেশ টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সহ-সভাপতি মুনিরা রহমান হেলেন।

মুনিরা রহমান হেলেনমুনিরা রহমান হেলেন
Published : 16 August 2023, 12:40 PM
Updated : 16 August 2023, 12:40 PM

প্রতিদিনের মতো আমি ঘুম থেকে উঠে সকালের কাজকর্ম করছি। হঠাৎ চপল ভাইয়ের পাঠানো মেসেজ, কিন্তু কেন জানি না আমি হোয়াটসঅ্যাপে চপল ভাইয়ের ছবি দেখে একটু চমকে উঠলাম। চপল ভাই অর্থাৎ কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদ চপল, বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। ভাবলাম এর আগেও শরীর খারাপ হয়ে তিনি হাসপাতালে ছিলেন, হয়তো আবারও সেরকম কিছু হয়েছে।

অভ্যাসবশত কিছু হলেই আমি যার কাছে ভরসার আশ্বাস পাই সেই টিপু ভাই মানে আর্চারি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম টিপুকে ফোন করলাম। ফোন ধরল তার মেয়ে তাবাসসুম। কিছুটা কান্নাজড়িত গলা। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন আছো? ভেবেছিলাম হয়তো সর্দি হয়েছে। ও বলল, ‘ফুফু তুমি কোথায়?’ আমি বললাম আমি ইউএসএ-তে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আব্বা কোথায়’? টিপু কি বাইরে যে তুমি ফোন ধরলে? ও তখন বলল, ‘আব্বা তো হাসপাতালে’। হাসপাতালে? ভীষণ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম কারণ মাত্র ১২ ঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে ওর কথা হয়েছে। কোনোকিছুই তো বলেনি, হলে তো অন্তত বলত বরং আমার কাছে আরও জানতে চেয়েছে কবে আমি ফিরে আসব। এও বলেছি, এবার ফিরে আসার পর দুই ভাইবোন মিলে অনেক কথা বলব। সেই শেষ ওর সঙ্গে আমার কথা বলা, তখনও বুঝতে পারিনি আমার টিপু কতখানি গুরুতর অবস্থায়!

এবার চপল ভাইকে ফোন করলাম, ভাই বললেন আপা আপনি কোথায়? আমাদের টিপুর অবস্থা খুবই খারাপ? আপনি এখনও দেখতে আসেননি তাই ফোন করেছি। আমার পায়ের নিচের মাটি যেন দুলে উঠল। আমি চিৎকার করে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে, কী হয়েছে আমার টিপুর? আমি বিশ্বাস করতে বা ভাবতে পারছিলাম না আমার টিপুর কিছু হতে পারে। ১২ ঘণ্টা আগে কত কথা বললাম ওর সঙ্গে, ওর মনের কথা।

সবাই হয়তো ভাবছেন কেন আমার এই কথাগুলো। রক্তের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক হয় কিন্তু আত্মার সঙ্গে যে আত্মার সম্পর্ক সেটা ছিল আমার আদরের টিপু ভাইয়ের সঙ্গে। বয়সে সে আমার ছোট ছিল। কিন্তু সেই কৈশোরে ওর সঙ্গে যখন থেকে পরিচয়, তখন থেকেই টিপু ভাই বলে ডেকেছি। ও অনেক বলেও আমাকে দিয়ে টিপু ডাকাতে পারেনি। পরে ভোর রাতে চপল ভাই লিখে জানাল, টিপু আর নেই। আমার আদরের সেই টিপু ভাই আজ আর নেই। কারোর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল না। সারারাত বসেছিলাম যদি মিরাকল হয় সেই আশায়। কথায় আছে যেখানে বড় ব্যথা সেখানে ভাষা নীরব।

টিপুকে ক্রীড়াঙ্গনে সবাই যেমন চেনে-জানে মনে হয় না এত সহজে টিপুর শূন্যস্থান কখনও পূরণ হবে। জীবনে কিছু কিছু বিষয় আছে যার কোনো বিকল্প হয় না, তেমনি টিপু ভাই। যাকে কোনোদিন আর দেখতে পাব না! ওর মতো করে কেউ আর আমাকে ক্রীড়াঙ্গনের সব খবর দেওয়ার জন্য বসে থাকবে না। কেউ টিপুকে কিছু দিলে সে ‘আমার হেলেন আপার জন্য এটা’ বলে উঠিয়ে রেখে দিত। ফেডারেশনের কাজে কেউই আমাকে আর আবদার করে বলবে না আপা আপনি কিছুই বোঝেন না, চুপ করে যা বলি শুনে যান। খেতে যদি না বসতাম, জোর করে নিজে না খেয়ে আগে আমার খাওয়ার কথা চিন্তা করত। আমার মনে হয় ক্রীড়াঙ্গনের যত ক্রীড়া সাংবাদিক আছেন তাঁরাও জানেন যে টিপু হেলেন আপার কত আপন। আমার প্রয়াত ক্রীড়ানুরাগী বাবা যেমন আমাকে খেলার জগতে প্রবেশ করিয়েছিলেন ঠিক সেইরকম টিপুও আমাকে ক্রীড়া সংগঠনের কাজকর্মে পাশে থেকে সাহায্য করে গেছে।

টিপুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় সেই ১৯৭৪ সালে। আমি যখন টেবিল টেনিস প্র্যাকটিস করতাম, দেখতাম পিংপং বল এদিক-ওদিক চলে গেলে একটি ১৩/১৪ বছরের ছেলে মাঝেমধ্যে তা কুড়িয়ে টেবিলের কাছে দৌড়ে এসে আমার হাতে দিত। আমি একটু মুচকি হেসে তার হাত থেকে বল নিয়ে নিতাম। ওইভাবে তার সঙ্গে পরিচয়। খুব লাজুক ধরনের ছেলে ছিল। একদিন ওর নাম জিজ্ঞাসা করাতে সে আমাকে বলল তার নাম রফিকুল ইসলাম টিপু। আমি বললাম তোমায় আমি টিপু সুলতান না বলে শুধু টিপু ডাকব কেমন।

আমি খেলতে এলে সেও প্রায়ই আসত খেলা দেখতে। একদিন সে আমাকে বলল, আপনাকে আমি আপা না বলে আপু বলব। হয়তো ও বড়ো হতে হতে ওর সম্বোধন একসময়ে আপু থেকে আপা হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমি অনেক দূরে চলে গেলাম। বহু বছর পর ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে দেখি সেই ছো্ট্ট টিপু অনেক বড় হয়ে গেছে। সে তখন টেবিল টেনিস ফেডারেশনে। টিপুই প্রথম ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ ইউসুফ হোসেনকে প্রস্তাব করল হেলেন আপাকে আমাদের ফেডারেশনে আসতে বলব। কোনো মেয়ে প্রতিনিধি নেই আমাদের মহিলা খেলোয়াড়দের জন্য। সেই-ই প্রথম বাংলাদেশের টেবিল টেনিস ফেডারেশনে, বোধ করি দেশের কোনো ক্রীড়া ফেডারেশনে টিপু এবং আরও কয়েকজনের উৎসাহে আমি প্রথম মহিলা প্রতিনিধি হলাম।

টিপু তখন সাধারণ সম্পাদক আর আমি ছিলাম যুগ্ম সম্পাদক। টিপু মিটিংয়ের আগে আমাকে সব বুঝিয়ে দিত ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র, কার্যবিবরণী কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, কীভাবে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলব। আমার সম্মানহানি যাতে না হয় সেদিকে তার একশ ভাগ নজর ছিল। ক্রীড়াঙ্গনে এমন কোনো লোক নেই যে তার শ্রদ্ধা বা স্নেহের পরশ পায়নি। কি সাংবাদিক, কি খেলোয়াড় কিংবা অফিস কর্মকর্তা বা কর্মচারী।

আমার মনে আছে ২০০২ সালে ভারতের আগরতলায় ফ্রেন্ডশিপ টুর্নামেন্ট খেলতে গেলে ওখানকার সকলকে দেখেছি টিপুকে খুব সমাদর করতে এবং তার থাকার জন্য বিশেষ বন্দোবস্ত করলেও সে আমাদের ছেড়ে অন্য হোটেলে গেল না। এটা বলার মানে হলো, টিপু কখনোই নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়নি। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে তাকে আমরা হলুদের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যা কিনা সব কিছুতেই লাগে। একপর্যায়ে টিপু টেবিল টেনিস ফেডারেশন থেকে আর্চারি ফেডারেশনে চলে যায় কিন্তু তা সত্ত্বেও পুরোনো ধারাবাহিকতায় সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিল।

রফিকুল ইসলাম টিপুর মতো নিরহংকার সংগঠক আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের সবার মনে যে জায়গা করে নিয়েছে তা চির অম্লান থাকবে। আমরা সবসময় অভিনেতা-অভিনেত্রী, খেলোয়াড়, গায়ক-গায়িকা, কবি, লেখক সকলকে নিয়ে লেখালেখি করি। কিন্তু কখনও ক্রীড়াসংগঠক যারা তাঁদের শ্রম ও মেধা দিয়ে আমাদের মতো খেলোয়াড় তৈরি করেন তাঁদের কতটুকু মনে রাখি। আজ ভালো সংগঠক যারা আছেন তাঁদের জন্য আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা দেশে-বিদেশে নাম করতে পারছে। তাঁদের চেষ্টা না থাকলে আমরা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতাম। তাই আমাদের উচিত ক্রীড়াসংগঠকদের অবদান মনে রাখা এবং তাঁদের জীবন নিয়ে লেখা।