আত্মহননকে কেন 'না' বলবেন?

একই ভবনের একই তলায় পাশাপাশি দুইটি ফ্ল্যাটে এমন ঘটনা ঘটে কী করে? তবে কি প্রথম জনের আত্মহনন দ্বিতীয়জনকে কোনওভাবে প্রভাবিত করেছিল?

এম এল গনিএম এল গনি
Published : 18 Oct 2022, 05:28 PM
Updated : 18 Oct 2022, 05:28 PM

ঘটনাস্থল চট্টগ্রাম শহরের দেবপাহাড়। বর্তমানে এটি চট্টগ্রামের অন্যতম এক অভিজাত আবাসিক এলাকা। মাস দুয়েক আগে দেশ ভ্রমণকালে আমার এক স্বজনের বাসায় কয়েকদিন ছিলাম এই আবাসিক এলাকায়। একদিনের ঘটনা শুনুন। সকাল সাতটা কি আটটা হবে। আমাদের বাসার দরজায় জোরে জোরে আঘাত করে এক নারী বলতে লাগলেন, “ডাক্তারদের কেউ বাসায় থাকলে একটু আসেন, আমার ছেলেটাকে বাঁচান। দয়া করে আসেন, এক্ষুণি আসেন। ...' বলা বাহুল্য, আমি যে বাসায় অবস্থান করছিলাম সে-ই পরিবারে চার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বসবাস।

ভাগ্যক্রমে তখন তাদের একজন বাসায় ছিলেন। তিনি একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ; চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। দ্রুত বাসার দরজা খুলে তিনি ভদ্রমহিলার সাথে একই ভবনের অন্য একটি ফ্ল্যাটে গেলেন। আমিও তাদের অনুসরণ করলাম। দেখলাম, বিশ-বাইশ বছরের এক তরুণকে একটি লম্বা সোফায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার এক স্বজন মাথাটা কোলে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছেন। বাসার অন্যরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছেন। সবাই দিশেহারা।

ডাক্তারকে রোগীর অবস্থা পরীক্ষা করার সুযোগ করে দেওয়া হলো। তিনি নাড়ির স্পন্দন পরীক্ষা করলেন, চোখ দেখলেন, বুকে কান পেতে দেখলেন, সিপিআর করলেন। এভাবে নানা উপায়ে বুঝার চেষ্টা করলেন রোগীর প্রকৃত অবস্থা। চিকিৎসককে জানানো হলো এই তরুণকে খানিক আগে ঝুলন্ত অবস্থা হতে নামানো হয়েছে। বাসার বৈদ্যুতিক পাখার হুক আর পর্দা ব্যবহার করে সে ঝুলেছে। দ্রুতই ডাক্তার মুখ গম্ভীর করলেন। আর, পরামর্শ দিলেন তাকে দ্রুত মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যেতে। একইসাথে তিনি মেডিকেলে কোনও একজন পরিচিতের কাছে ফোনেও বিষয়টা শেয়ার করলেন।

তরুণের বাবা চরম অস্থিরতায় প্রলাপ বকতে শুরু করলেন। কী কারণে এ তরুণ গলায় ফাঁস দিয়েছে তাও অবলীলায় বলে চললেন। এই তরুণের সাথে নাকি এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ে করে তাকে এখনই ঘরে তুলতে চায় তরুণ। কিন্তু, তার চাকরিবাকরি নেই বলে পরিবারের সম্মতি পাওয়া যাচ্ছিল না তাতে। এ নিয়ে পরিবারের সাথে বাড়াবাড়ির জেরে সমস্যার সমাধানে শেষতক নিজেকে বিলীন করে দেবার এই ‘সহজ’ অথচ কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়েছে এ তরুণ। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর দায়িত্বরত চিকিৎসক তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেন।

ওই ভবনের যে তলায় এই তরুণের পরিবার বসবাস করেন সে তলায় আরও তিনটি ফ্ল্যাট আছে। ওই তিন ফ্ল্যাটের একটির এক বাসিন্দা আমাকে দেখে চিনে ফেলেন। পরে জানা গেল, আমার সাথে নাকি ওই পরিবারের এ তরুণের কানাডার ইমিগ্রেশন সম্ভাবনা নিয়ে একবার ভিডিও কন্সালটেনশন হয়েছিল; সাথে তার মা-বাবাও ছিলেন। সে বছর খানেক আগের কথা। সেই তরুণের চেহারা আমারও মনে পড়লো। [যারা জানেন না, আমি পেশায় একজন কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, আরসিআইসি।]

সঙ্গত কারণেই ওই তরুণের খবর জানতে চাইলাম। প্রশ্ন শুনেই তরুণের মা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আমাকে জানালেন, সেও কয়েকমাস আগে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। ঘটনা শুনে আমি পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলাম ক্ষণিকের জন্য। হিসেব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম, একই ভবনের একই তলায় পাশাপাশি দুইটি ফ্ল্যাটে এমন ঘটনা ঘটে কী করে? তবে কি প্রথম জনের আত্মহনন দ্বিতীয়জনকে কোনওভাবে প্রভাবিত করেছিল? আত্মহত্যা কি তবে সংক্রামক মানসিক ব্যাধি?

কানাডায় ফিরে আমার ঘনিষ্ঠ এক সাইকিয়াট্রিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে জানতে চাইলাম, মানুষ আত্মহননের মতো বিপদজনক ঘটনা ঘটাতে যায় কেন?

আমার প্রশ্ন শুনেই এই চিকিৎসক বললেন, এটা হলো এক ধরণের 'কোপিং স্ট্র্যাটেজি (coping strategy)' বা, মানসিক চাপ মোকাবেলার কৌশল যা 'বর্ডারলাইন পার্সোন্যালিটি ডিজঅর্ডার' সমস্যা আছে এমন মানুষেরা করে থাকেন। ‘বর্ডারলাইন পার্সোন্যালিটি ডিজঅর্ডার’ হলো এক ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি। যাদের এ সমস্যা আছে তারা অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ, বা সংবেদনশীল হন। ছোটখাট বিষয়েও তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। কোনও কারণে একবার তাদের মন খারাপ হলে তা বেশ দীর্ঘায়িত হয়। তীব্র মানসিক অস্থিরতা এবং নিজেকে শান্ত করতে অপারগতা অনেক সময় বেপরোয়া আচরণের দিকে তাদের ঠেলে দেয়, যা ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহননের মতো ঘটনা ঘটাতেও তাদের উদ্বুদ্ধ  করে। ভেতরে ভেতরে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেন তারা, এবং যে কোনও মূল্যেই উদ্ভূত মানসিক সমস্যা হতে বেরিয়ে আসতে চান।  এটাই হলো ‘কোপিং স্ট্র্যাটেজি’। সময়মতো চিকিৎসা, যথাযথ কাউন্সেলিং বা পরামর্শের মাধ্যমে এ ধরনের মানসিক রোগীদের সারিয়ে তোলা খুবই সম্ভব বলে জানালেন কানাডীয় এই সাইকিয়াট্রিস্ট।

নাইজেরিয়ান তেল কোম্পানির মালিক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ফেমি ওতেদোলার জীবনকাহিনী এখানে প্রাসঙ্গিক। একটা সময়ে নাইজেরিয়া ও আফ্রিকার তিরানব্বই শতাংশ ডিজেলের সরবরাহকারী ছিলেন ফেমি। আফ্রিকা ও এশিয়ায় সবচেয়ে বড় জাহাজটিও ছিল তার মালিকানাধীন। এমন সফল মানুষটিও জীবনে এক পর্যায়ে ‘আত্মহত্যা’-র খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছেন।

নাইজেরিয়ান এ বিলিয়নেয়ারের জীবনে হঠাৎই এক ঝড় আসে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন: 'আমার আঙুলের ডগায় প্রায় ৯৩ শতাংশ ডিজেল বাজার ছিল এক সময়। তারপর একদিন হঠাৎ করেই দেখি তেলের বাজার দুম করে অস্বাভাবিক রকম পড়ে গিয়েছে। সমুদ্রে ভাসমান আমার এক জাহাজে তখন এক মিলিয়ন টনেরও বেশি ডিজেল ছিল। আমি ঠিক সেই সময়ে জানতে পারি ডিজেলের দাম ১৪৬ ডলার থেকে নেমে কেবল ৩৪ ডলার হয়েছে।"

তেলের মূল্য হ্রাসের কারণে তার আর্থিক ক্ষতি হলো প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন ডলার। শুধু কি তাই? এই একই সময়ে নাইজেরিয়ার মুদ্রা নায়রা-র ও উল্লেখযোগ্য দরপতন ঘটে। এ কারণে তিনি হারান আরো ২৫৮ মিলিয়ন ডলার। বিপদ তো আর একা আসে না। ব্যাংকে তার সুদ জমে গিয়েছিল ৩২০ মিলিয়ন ডলার। তার উপর আবার ১৬০ মিলিয়ন ডলার হারালেন শেয়ার বাজারে ধস নামার কারণে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই ঘটে গেলো এতগুলো বিপর্যয়। একজন মানুষ যত ধনীই হোন না কেন, তারও তো হারাবার একটা সীমা থাকে। কিন্তু, ফেমি ওতেদোলার ক্ষয়ক্ষতি অপরিমেয়।

ওই সাক্ষাৎকারে ফেমি আরো বলেন: “তখন আমার কাছে কেবল দুটি বিকল্প ছিল, হয় আত্মহত্যা করা, না হয় তীব্র ঝড়ের মোকাবেলা করা। আমি ঝড় মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেই। আমি জানতাম এটা জীবনের একটা পর্যায় যা দিয়ে আমাকে যেতেই হবে। ... অভিজ্ঞতা হলো সেরা শিক্ষক, তাই আমাকে আমার পাঠ শিখতে হয়েছিল কঠিন অভিজ্ঞতা থেকেই।' ফেমি বলেন, 'আমার বাবা আমার জীবনের আদর্শ, এবং তার সুনাম রক্ষা করার বিষয়টি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর প্রথমেই আমার মনে পরে। সততা ছিল তার নীতি; তার সেই নাম এবং সততা রক্ষা করতে আমি আমার ক্ষয়ক্ষতি ভুলে নতুন সংকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়ি।“

বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য হারানোর পরও শক্ত মনোবল ও পিতার আদর্শকে পুঁজি করে আবারও জীবন সংগ্রামে নেমে পড়েন ফেমি, ঢেলে সাজান তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, এবং ধীরে ধীরে আবারো সেই হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পান। ফেমি ওতেদোলা ফোর্বসের ধনী তালিকায় তার হারানো স্থান পুনরুদ্ধার করেন। ২০১৪ সালে ফোর্বসের হিসাবে তার সম্পদের মোট মূল্য দাঁড়ায় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। ঝড় মোকাবেলায় সাহসিকতার সাথে এগিয়ে না এসে তিনি যদি মানসিক চাপে ‘কোপিং স্ট্রাটেজি’ হিসেবে আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতেন তবে কি পৃথিবী একজন পথে বসে যাওয়া বিলিয়নারের এমন সাহসী প্রত্যাবর্তন দেখতে পেতো?

শরীর থাকলে যেমন শরীরে রোগবালাই থাকে, তেমনি মনেরও রোগবালাই থাকতে পারে। এ অস্বাভাবিক কিছু নয়। শারীরিক সমস্যার মতো মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দিলে তা নিরাময়ের পথ খুঁজতে হবে। আর, এ পদক্ষেপটি নিতে হবে দ্রুত। তেমন সমস্যা আঁচ করতে পারলে আপনার উচিত হবে আপনার বিশ্বস্ত স্বজনদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা এবং প্রশিক্ষিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া। ক্যান্সার আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায় হতে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ শুরু করলে যেমন দুরারোগ্য ক্যান্সার হতেও মুক্তি পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়ে যায়, ঠিক তেমনি মানসিক ব্যাধির শুরুর দিকে তা চিহ্নিত করে যথাযথ চিকিৎসা নিলে তা থেকেও নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব।

বিশেষ কারণে বাচ্চাদের মন খারাপ হওয়া, বিরক্তিকর আচরণ করা বা খারাপ মেজাজে থাকা বিচিত্র কিছু নয়। তবে, যখন দেখা গেল তার এই দুঃখিত মন বা খারাপ মেজাজ কয়েক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে বজায় থাকছে, এবং ফলে, তার আচার-আচরণে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তখন তা ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা কিনা তা আপনাকে ভেবে দেখতে হবে। সে অবস্থায় তার পাশে থেকে তাকে মানসিক শক্তি জোগান বা সহায়তা দেওয়া অভিভাবক হিসেবে আপনার কর্তব্য। তাতেও কাজ না হলে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন অবশ্যই।

মানুষের চেহারা বা শরীরের গড়ন যেমন ভিন্ন, তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য মনটিও তেমনই আলাদা। মানসিক দিক থেকে শক্ত কারো সাথে যে ধরনের আচার-আচরণ করবেন সেই একই ফর্মুলা যেন অতি আবেগপ্রবণ বা সংবেদনশীল কারো উপর প্রয়োগ না করেন। কারণ, তিনি হয়তো মানসিক ধকল বা চাপটি সেভাবে মেনে নিতে পারবেন না; বা এমনও হতে পারে, লোকটি 'বর্ডারলাইন পার্সোন্যালিটি ডিজঅর্ডার' এর শিকার।

পৃথিবীর কোন ধর্মও আত্মহত্যায় সমর্থন দেয় না। বরং, বিভিন্ন ধর্মে আত্মহননের বিষয়টিকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আত্মহত্যার সাজা নিয়ে হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে: ‘যে যেভাবে আত্মহত্যা করবে, তার শাস্তি অনন্তকাল সেভাবেই চলতে থাকবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)। আত্মহত্যাকারীদের প্রতি ইঙ্গিত করে মহাভারত বলে, 'যারা আত্মহননের পথ বেছে নেয় তারা মৃত্যুর পর কখনই আশীর্বাদপ্রাপ্ত অঞ্চলে (স্বর্গে) পৌঁছুতে পারে না।' চলুন, যে যার অবস্থা হতে মানসিক ব্যাধির চূড়ান্তরূপ আত্মহত্যাকে 'না' বলতে শিখি। চরম মানসিক বিপর্যয়েও এ লেখার ফেমি-র মতো বেঁচে থাকার একটি শক্ত কারণ খুঁজে বের করি।