‘অদ্ভুত আঁধার’ রিলোডেড

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনশেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
Published : 18 April 2022, 11:22 AM
Updated : 18 April 2022, 11:22 AM

করোনাভাইরাস সংক্রমণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সময়ে যে আতংক ও উৎকণ্ঠা মানুষের মনে ছিল, তাতে অনেকেই মনে করেছিলেন যে- এবার লুটেরা, লোভী, ও অন্যায়কারীরা হয় ধ্বংস হবে, নইলে সংযত বা পরিশুদ্ধ হবে। কিন্তু নানা সংস্থার তথ্য-উপাত্ত বলছে, কোভিডের মধ্যেও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে, সম্পদশালীরা আরও সম্পদশালী হয়েছে, দরিদ্র হতদরিদ্র হয়েছে, ক্ষমতাশালীদের ক্ষমতার দেমাগ, ও দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে। জাতীয় এবং বৈশ্বিক চিত্রটি হতাশাব্যঞ্জকই নয়, রীতিমত নৈরাজ্যকর। 

কোভিড মহামারীর কারণে জাতীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ প্রান্তিক মানুষের অবস্থানের যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে করে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের সরকারের কাছে দায়িত্বশীল, ও সংযত আচরণ কাম্য ছিল। বিশেষ করে আমেরিকা, চীন, রাশিয়াসহ বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর কাছে প্রত্যাশা ছিল- তারা প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতি, সমরাস্ত্র উৎপাদন ইত্যাদি থেকে সাময়িকভাবে হলেও বিরত থাকবে এবং ভবিষ্যত মহামারী প্রতিরোধ-স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। 

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ভালো মানুষের 'আইডিয়ালিস্টিক' চিন্তাভাবনা, ও মঙ্গলকামনা দিয়ে পৃথিবী চলে না। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে স্প্যানিশ ফ্লুতে ৫ কোটি মানুষ মারা যাবার পরে শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ওই যুদ্ধেও মৃত্যু হয়েছিল ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের। নির্মম হলেও সত্য যে, মানুষের ইতিহাসের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে গণহত্যা, যুদ্ধ, মহামারী, জীঘাংসা, ও হানাহানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিষ্ঠুরতায় ক্ষতবিক্ষত কবিগুরু ১৯৩৯ সালে লিখলেন বা লিখতে বাধ্য হলেন, "নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস / শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-"। 

বিদ্যমান আভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে – সারা বিশ্বে কি কখনও নিরবচ্ছিন্ন স্থিতিশীলতা ও শান্তি বলে কিছু ছিল? রাজ্যভেদে, সাম্রাজ্যভেদে কখনো কখনো সমৃদ্ধি, শান্তি ও স্থিতিশীলতা ছিল বৈকি, কিন্তু সেটি রাজা, সম্রাট বা রাণীর প্রজাহিতৈশী, পরার্থপর ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কারণে। 

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্রের বিকাশ ও গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মিশ্রণে কল্যাণ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সর্বতোভাবে রাষ্ট্রের জনবান্ধব হয়ে ওঠার ঘটনা সাম্প্রতিক। এ ব্যাপারে ইউরোপের নরওয়ে, সুইডেন, আইসল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ অনেকগুলো রাষ্ট্র দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠান গড়বে, আর কবে কল্যাণ রাষ্ট্র হবে, সেটি চিন্তা করলে চোখে ঝাপসা দেখি। চারিদিকে ব্যবস্থাপনার যে নৈরাজ্য, যে দুর্নীতি, যে অবক্ষয়, তাতে আমার প্রায়ই মনে হয় ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল ডুরখেইমের 'এ্যনোমি' বা 'ল লেসনেস'- এর মধ্যে আছি। 

ব্যক্তি জীবনের নানা বিয়োগান্ত ঘটনা, এবং বহিরঙ্গের সাম্প্রদায়িকতা, বিশ্বযুদ্ধ, রাজনীতি ও সমাজের কুটিলতায় ক্ষতবিক্ষত কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন – "অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি/ এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়/ মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/  শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।" 

'অদ্ভুত আঁধার এক' কবিতায় জীবনানন্দ যে অন্ধকারের কথা বলেছেন, সেই অন্ধকার তো কালে কালে নতুন চেহারা, নতুন মাত্রা, নতুন ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয়েছে, হচ্ছে, এবং হবে। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে এসে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য কারাগারে যেতে হয়েছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে! 

হৃদয় মণ্ডল তো যথার্থই বলেছেন যে, ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, এবং বিজ্ঞানের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তি, এবং ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট। ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে যে সমাজ মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়, সে সমাজ কী করে এগিয়ে যাবে? ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যারা বলে সাংঘর্ষিক, তারা কী করে নিজেদের বাংলাদেশি বা বাঙালি বলে দাবি করেন?  

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে – মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরে এসে যদি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ধর্ম ও বিজ্ঞানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, বৃহৎ একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যদি পহেলা বৈশাখ ও একুশে ফেব্রুয়ারিকে ধর্মবিরোধী বলে প্রচার চালায়, তাহলে কি আমরা বলব যে, বাংলাদেশ ঠিক পথে এগোচ্ছে? 

যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মোটামুটিভাবে শিক্ষা ও গবেষণাকে ধরে রেখেছিল, যে বিশ্বদ্যিালয়গুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সব সময় অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতেন, যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করত, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংস হতে বসেছে। 

একদিকে আদর্শিক রাজনীতির পরিবর্তে দলের লেজুড় ধরে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের তরফে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে সীমাহীন অবহেলা, অন্যদিকে ধর্মান্ধ শিক্ষার্থীদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার, অসাম্প্রদায়িক ও জ্ঞান-‍বিজ্ঞান চর্চার স্পেস দখল। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভেতর থেকে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। 

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনায় আমি রীতিমত শংকিত ও উৎকণ্ঠিত। ব্যক্তি পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে রাজনৈতিক ও আদর্শিক নানা বিরোধ ও হানাহানি সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশটি ছিল উদার, অসাম্প্রদায়িক ও তর্ক-বিতর্ক বান্ধব, যেটি যেকোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার পূর্বশর্ত।  

বিশ্ববিদ্যালয় কোন ধর্ম, বর্ণ, বা মতাদর্শ অন্ধভাবে অনুসরণ বা চর্চার জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে মতাদর্শ, দর্শন ও ধর্ম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কাকে বলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়, সে বিষয়ে না জেনে মতাদর্শ-অন্ধ, বিজ্ঞান ও দর্শনবিমুখ ধর্মান্ধরা যদি বিশ্বদ্যিালয়ে চলে আসে, তাহলে চারিদিকের অন্ধকারের মধ্যে যেটুকু আলো টিম টিম করে জ্বলছিল, নিশ্চিতভাবে সেটি নিভে যাবে।  

বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবি মানুষের ইতিহাসকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করেছেন এবং তার পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তকে দশ খণ্ডে প্রকাশ করেছেন। তার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে ধর্ম মানুষের ইতিহাসের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৫৪ সালে দ্য অবজারভার– এ ছাপা এক প্রবন্ধে তিনি বলেন, "I have come back to the belief that religion holds the key to the mystery of existence". অর্থাৎ আমি এই বিশ্বাসে ফিরে এসেছি যে, মানুষের অস্তিত্বের যে রহস্য সেটি উন্মোচন বা বোঝার ক্ষেত্রে চাবি হচ্ছে ধর্ম। 

আমি ব্যক্তিগতভাবে 'বিলিভার' বা বিশ্বাসী। আমি মনে করি মনুষ্য সৃষ্টি, তার অস্তিত্ব, জীবন-মৃত্যুর রহস্য, সৃষ্টিকর্তা, বা 'সুপ্রিম ডিভাইন অথরিটি'র জ্যেতির্ময় সত্তা, মেটাফিজিক্যাল ঘটনার ব্যাখ্যা, মানুষের ন্যায়নিষ্ঠ ও আধ্যাত্মিক জীবনের জন্য ধর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, ধর্মের নামে হানাহানি যে কোন সমাজ ও রাষ্ট্রের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মোক্ষ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরপিন্থি।  

আমি সেই সমাজের প্রত্যাশা করি যেখানকার মানুষগুলো হবেন ধার্মিক, তবে অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিনিষ্ঠ, সহিষ্ণু, ও উদার; কেউ যদি ধর্মে বা 'সুপ্রিম ডিভাইন অথরিটি'র অস্তিত্বে বিশ্বাস নাও করেন, তাহলে তারা তার গলা কাটতে যাবেন না। সেই সমাজে যারা 'বিলিভার' নন, মানুষ ও নাগরিক হিসেবে তাদেরও থাকবে পূর্ণ স্বাধীনতা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, রবীন্দ্র, নজরুল ও লালনের মধ্যে গভীর আধ্যাত্মিক বোধ ছিল। অন্যদিকে তারা ছিলেন মুক্তচিন্তার মানুষ। জাত, পাত ও ধর্মের ভেদ না মানায় নজরুল ও লালন তো হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের গালি খেয়েছেন। আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কোনও গোঁড়ামি বা চরমপন্থাকে, সেটি ধর্মীয় হোক, জাতীয়তাবাদের হোক বা বর্ণের হোক, খুবই অপছন্দ করতেন। 

নারী শিক্ষার পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াও ধর্মান্ধ ও গোঁড়াপন্থিদের অক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধর্মান্ধ ও গোঁড়াপন্থিদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাদের পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আজ একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে আবার আমরা 'ধর্মীয় গোঁড়ামি' নামের দানবের মুখোমুখি। অন্ধকার নিয়ে লেখা অনেকগুলো কবিতার মধ্যে জীবনানন্দ দাশের অন্য একটি কবিতার শিরোনাম – ''এক অন্ধকার থেকে', যার প্রথম দু'টি লাইন এরকম – "এক অন্ধকার থেকে এসে/ অন্য এক আঁধারের দিকে … " বাংলাদেশে ধর্মান্ধতা, ধর্মভিত্তিক ঘৃণা, ও মুক্তচিন্তা, ও বিজ্ঞান-বৈরী ধর্মীয় গোঁড়ামি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমার বলতে হচ্ছে, এক অন্ধকার পেরিয়ে এসে, বাংলাদেশি বাঙ্গলী আজ ছুটে চলেছে আরেক কৃষ্ণগহ্বরের দিকে।