এস কে সিনহায় ‘পূর্ণতা’ ধর্ম নিরপেক্ষতার

স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসে মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরে কারও বাংলাদেশের প্রথম বিচারপতি হওয়াকে রাষ্ট্রীয় মূল নীতি ধর্ম নিরপেক্ষতার ‘পূর্ণতা’ হিসেবে দেখছেন এই পদে আসীন বিচারপতি এস কে সিনহা।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2015, 01:00 PM
Updated : 17 Jan 2015, 02:09 PM

ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চারটি বিষয়কে মূল নীতি হিসেবে নিয়ে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের একবিংশতিতম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শনিবার শপথ নেন এই আদিবাসী।

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেওয়ার পর বিচারপতি এস কে সিনহা (সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) বিকালে সাভার গিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করার সময় বিচারপতি এস কে সিনহা লেখেন,  “তোমাদের আত্মত্যাগে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্বাধিকার এদেশের জনগণ পেয়েছে। আমরা এছাড়াও একটা ম্যাপ, পতাকা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। আমরা অল্প সময়ের মধ্যে একটা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে, আইনের শাসন কায়েম করতে পেরেছি।

“বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন, অর্থ্যাৎ এদেশের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে, বর্তমান সরকার এদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।”

সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে নিজের সহকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে যান বিচারপতি এস কে সিনহা। বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থানকালে সবাই অন্তরঙ্গ আলাপে মেতে ওঠার পাশাপাশি একসঙ্গে ছবিও তোলেন।

প্রধান বিচারপতিকে স্মৃতিসৌধে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন সাভারের সংসদ সদস্য এনামুর রহমানসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।  

পৌঁছনোর পর তাদের সঙ্গে সহকর্মী বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাসহ আপিল বিভাগের বিচারকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বিচারপতি এস কে সিনহা।

বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, “ইনি বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারপতি। হাই কোর্টেও প্রথম নারী বিচারপতি। আপিলেও উনি প্রথম। উনাকে বিশ্বজুড়ে মানুষ চিনেন।”

বাংলাদেশ উইমেন জাজেজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বিচারপতি নাজমুন আরা বিচারকদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনেও বেশ সক্রিয়।

আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ছিলেন সেখানে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নিজামুল হক, ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান এম ইনায়েতুর রহিম, ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসান, ট্রাইব্যুনাল সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, শাহিনুর ইসলামও প্রধান বিচারপতি পাশে ছিলেন।

হাই কোর্ট বিভাগের বিচারকদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, বিচারপতি সামলা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি জাফর আহমেদসহ আরও বেশ কয়েকজন।

সঙ্গীদের নিয়ে প্রধান বিচারপতি স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। হাসিখুশি প্রধান বিচারপতিকে এ সময় কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে দেখা যায়।

সেখান থেকে ফিরে তিনি স্মৃতিসৌধের দর্শনার্থীদের জন্য রাখা বইয়ে স্বাক্ষর করেন।

মন্তব্য ও স্বাক্ষরের পর বিচারপতি ইমান আলী মোবাইলে একটি ছবি তোলেন। ছবি তোলার সময় তিনি সবাইকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের জাদুঘরের জন্য এটি তোলা হল।

স্বাক্ষরের ছাউনি থেকে বের হলে আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়া প্রধান বিচারপতিকে বলেন, “স্যার চলেন আমরা স্মৃতিসৌধকে পেছনে রেখে একটা ছবি তুলি। এখানে তো আমাদের ওইভাবে আসা হয় না। এ রকম সুযোগ হয়ত আর পাব না।”

এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন প্রধান বিচারপতি। এই সময় আবার হাসিখুশি ভাবে ফিরে আসেন তার মধ্যে। সঙ্গীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “চলেন, আমরা ছবি তুলি।”

স্মৃতিসৌধের মূল স্তম্ভ ও পুষ্পস্তবক অর্পণের স্তম্ভকে পেছনে রেখে একটি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যান বিচারপতিরা। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, “যারা লম্বা, তারা পেছনে দাঁড়ান, অন্যরা সামনে দাঁড়ান।”

কেউ কেউ নিজের মোবাইলও সঙ্গে থাকা পরিচিতজনদের হাতে দিয়ে ছবি তুলতে বলেন। ছবি তোলার পর্বে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিয়া সামনে এসে বলেন, “এখানে আমরা সুপ্রিম কোর্টের জাজরা ছবি তুলছি। প্লিজ অনলি ফর জাজেজ। অন্য কেউ থাকলে সরে যান।”

বিচারক হিসাবে আইন অনুসারে সামাজিকভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের অভ্যস্ত এই মানুষদের প্রায় সবাইকে এদিন বেশ প্রাণ চঞ্চল মনে হচ্ছিল।

ছবি পর্ব শেষ হলে প্রধান বিচারপতি তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। এসময় সাংসদ ডা. এনামের সঙ্গে আবার গল্পে মেতে উঠেন তিনি।

এক পর্যায়ে রানা প্লাজা ধসের প্রসঙ্গও আসে। প্রধান বিচারপতি বলেন, “রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় আপনাদের ভূমিকা আমি অ্যাপ্রিসিয়েট করি। জাতি সেটা স্মরণ রাখবে।”

জবাবে ডা. এনাম বলেন, “স্যার, আমরা সারা বছরই চ্যারিটি কাজ করি। এই জন্য সঙ্কটের সময়ও সেটা সম্ভব হয়েছে।”

এর আগে সকালে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের উত্তরসূরি হিসেবে বিচারপতি এস কে সিনহাকে বঙ্গভবনে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ছাড়াও কয়েকজন সাবেক প্রধান বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন।

শপথ অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক মিনিট আগে প্রধান বিচারপতির পোশাক পরে দরবার হলে ঢোকেন এস কে সিনহা। শপথের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নতুন প্রধান বিচারপতিকে অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপতি।

শপথ নেওয়ার পর আপিল বেঞ্চ পুনর্গঠন করেন বিচারপতি এস কে সিনহা।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের তিলকপুর গ্রামে। তার জন্ম ১৯৫১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।

হাই কোর্টে তিনি বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর। আপিল বিভাগে আসেন ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ বাতিল করেছিল, এস কে সিনহা ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। এছাড়া ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দেওয়া বেঞ্চেও সদস্য হিসাবে ছিলেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এই জ্যেষ্ঠ বিচারককে গত সোমবার প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে বিচারপতি সিনহাই প্রথম অমুসলিম ও আদিবাসী, যিনি সর্বোচ্চ আদালতের নেতৃত্বে এলেন।