লকডাউনের মধ্যেও রাস্তায় বাড়ছে জনসমাগম

দিন যত গড়াচ্ছে, লকডাউনের বিধিনিষেধ ভেঙে মানুষের বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা যেন ততই বাড়ছে; অলিগলিতে দোকান খুলে ‘কৌশলে’ বেচাকেনা চালাচ্ছেন দোকানিরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2021, 08:27 AM
Updated : 11 July 2021, 08:42 AM

করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের একাদশতম দিন রোববার সকালে ঢাকার মিরপুর, রামপুরা, মালিবাগ, বনশ্রী, শান্তিনগর, সবুজবাগ, বাড্ডা, আজিমপুর, লালবাগ, কেল্লারমোড়, বকশিবাজার ও পলাশীর অলিগলিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

রাজধানীর ছোট-বড় শপিংমল, মার্কেট, সিনেমা হল বন্ধই আছে। কিন্তু বিভিন্ন সড়কে যানবাহন বাড়ার পাশাপাশি ঘরের বাইরে কর্মব্যস্ত মানুষদের আনাগোনা গত কয়েক দিনের চেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে।

প্রধান সড়কের দুইপাশে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিন ওইসব দোকানপাট বন্ধই ছিল।

জুবায়ের নামের এক রিকশা চালক বললেন, “স্যার, সকাল থেইকা ক্ষ্যাপ মারতাছি। রাস্তায় মানুষজন দেইখা মনে হয় না কড়াকড়ি আর আছে। যেমুন কড়াকড়ি ছিল, হেইডা এখন ওইভাবে নাই।”

শান্তিনগরে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্য কেনার জন্য ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়কেন্দ্রে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। সকাল ৯টা থেকে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। সেখানে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্রেতারা।

লাইনে দাড়াঁনো গুলবাগের বাসিন্দা রহিমা বেগম বললেন, “তেল, চিনি, ডাল কিনতে এসেছি। মাস্ক তো পরেছি, কিন্তু দেখেন লাইনে মানুষ যেভাবে দাঁড়িয়েছে, তাতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তো থেকে যায়। কী করবেন? কেউ কথা শুনছে না। এভাবে ঝুঁকি নিয়ে আমরা মধ্যবিত্তরা বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছি।”

গত ১ জুলাই শুরু হওয়া এই লকডাউনের বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনা সদস্যরাও মাঠে রয়েছেন। কাকরাইলে নাইটিঙ্গেল রেস্তোরাঁর কাছে এক পুলিশ কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতার কথা বললেন।

“সকাল থেকে প্রাইভেট কার থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। বেশিরভাগ বলেন, মতিঝিলে বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ আছে। অথচ লকডাউনে তো সব কোম্পানিই বন্ধ থাকার কথা। তাহলে কী করব? কিছুক্ষণ থামিয়ে রেখে ছেড়ে দেওয়া অথবা জরিমান করা ছাড়া তো কিছু করার নেই।”

সকালে ডিআইটি রোডের রামপুরা এলাকায় রাজীব ক্রোকারিজ, শাহিন ইলেক্ট্রনিক, মেসার্স মক্কা ইলেক্ট্রনিক স্টোর, হক লাইট হাউজসহ আশপাশের বেশ কিছু দোকানপাটের শাটারের একটি অংশ খুলে বিক্রয় কর্মীদের দোকানের বাইরে বসে থাকতে দেখা গেল। অথচ বিধিনিষেধের মধ্যে এসব দোকান খোলার কথা নয়।

তারা জানালেন, লকডাউনের প্রথম কয়েক দিন দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছিল। লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়ায় এবং ক্রেতার চাহিদা থাকায় বিধিনিষেধের মধ্যেও দোকান খোলা হয়েছে। পুলিশ দেখলে শাটার বন্ধ করে তারা সরে যান।

একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী সাইফুল ইসলাম বললেন, “লডকাউনের কারণে এমনিতে কাস্টমার কম, তবে পরিচিত যারা আছেন প্রয়োজন পড়লে ফোন দিয়ে কিছু নিতে আসেন। আবার এমনিতে যারা আসেন, তাদের কাছেও কিছু বিক্রি করার চেষ্টা করি।”

তিনি বলেন, “একটু পরপর পুলিশের গাড়ি আসে, তখন দোকান বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকি। বাইরে আমাদের কেউ না কেউ থাকে, পুলিশ চলে গেলে আবার খুলি।”

নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সেলুন, বই-খাতার দোকান, কাপড়ের দোকান একই কৌশলে খোলা থাকতে দেখা যায়। আবার কিছু দোকানের সামনে দেখা যায় ‘জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ’ করতে মোবাইল ফোন নম্বর লিখে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে রাখা।

মালিবাগের ম্যাগনেট হেয়ার ফ্যাশন, শুভ হেয়ার ফ্যাশনসহ আরও বেশ কিছু সেলুনেও ঝাঁপের একটি অংশ খোলা রেখে ভেতরে কাজ করতে দেখা গেছে কর্মীদের।

রতন বিশ্বাস নামে এক সেলুনকর্মী বললেন, “কেউ ফোন দিয়ে আসে, তখন টুকটাক কাজ করি। কাজ না করে তো উপায় নেই ভাই, ঘর ভাড়া, সংসার খরচ এগুলো তো আর কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারতেছি না। কী করব, পুলিশের যন্ত্রণার মধ্যেও কাজ করছি।”

মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকে লেডিস মার্কেট এলাকায় দেখা যায়, প্রায় সব কাপড়ের দোকানই খোলা। সকাল সোয়া ১০টার দিকে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শুনে দোকান বন্ধ করে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন বিক্রেতারা। কিছু সময় পর আবার দোকানগুলো খুলতে দেখা যায়।

লুকোচুরি করে দোকান খোলা রাখার বিষয়ে প্রশ্ন করলে শিশুদের পোশাক বিক্রেতা মানিক হোসেন বলেন, “দোকান খোলা থাকলে টুকটাক বিক্রি হয়। বিক্রি ছাড়া চলব ক্যামনে? ১৪ দিন যদি দোকান বন্ধ রাখি, তাহলে দোকান ভাড়া আসবে কোথা থেকে?”

ওই এলাকার গলির বাজারগুলোতে মাস্ক ছাড়াই কেনাকাটা করতে দেখা যায় বেশ কয়েকজনকে। সবজি কিনতে আসা মরিয়ম নূর বলেন, “বাসা উপরে। মাত্র নামছি। চলে যাব এখনই। মাস্ক পড়তে ভুলে গেছি।”

মিরপুর সেকশন ১১, ১২ ও কালশীর প্রধান সড়ক এবং গলিতে রিকশা, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের চলাচল তুলনামূলক বেশি ছিল।

মিরপুরের ষাট ফুট সড়কে সকালে বিভিন্ন যানবাহনের লম্বা লাইন দেখা যায়। এ এলাকায় অন্যদিনের তুলনায় রাস্তায় কর্মব্যস্ত মানুষের উপস্থিতি বেশি ছিল রোববার।

সকাল ৯টায় ষাট ফুট সড়কে পুলিশের তল্লাশি চৌকির দুই পাশে রিকশা, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, মিনিবাস এবং অন্যান্য যাত্রী ও মালবাহী গাড়ির দীর্ঘ জট সৃষ্টি হয়।

মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, মিরপুর-২ নম্বর, চিড়িয়াখানা রোড, স্টেডিয়াম এলাকায় মানুষের চলাচল অন্যদিনের তুলনায় বেশি ছিল। অলিগলিতে মুদি দোকান, চা দোকান ও অন্যান্য স্টেশনারি পণ্যের দোকানও খুলেছে।

এসব এলাকায় মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তল্লাশি ছিল অন্যদিনের তুলনায় কিছুটা শিথিল।

পুরান ঢাকার আজিমপুর, লালবাগ, কেল্লারমোড়, বকশিবাজার ও পলাশীর অলিগলি ও প্রধান সড়কে মানুষের চলাচল ও যানবাহন আগের দিনগুলো থেকে বেশি ছিল।

অলিগলিতে ভ্যানগাড়িতে ফল আর সবজির পসরা আছে আগের মতোই। সবজির দোকান, মুদি দোকানগুলোতে ক্রেতাও অনেক, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না কেউ।

লালবাগ চৌরাস্তা, ঢাকেশ্বরী মন্দির, পলাশীর মোড় ও বকশিবাজারে অলিগলিতে মানুষেরও উপস্থিতিও বেশি।

নিউ মার্কেট ও গ্রিন রোড এলাকার রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতির মধ্যেই অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি রিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলতে দেখা গেছে।

মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরেরপুল, বিজয়নগর এলাকার রাস্তাঘাটে প্রাইভেট কার, পন্যবাহী যান, রিকশার চলাচল আগের দিনগুলোর তুলনায় বেড়েছে।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১ জুলাই থেকে সারাদেশে সাত দিনের কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। পরে জাতীয় কমিটির সুপারিশে এই লকডাউনের মেয়াদ আরও সাত দিন বাড়ানো হয়।