করোনাভাইরাস মহামারীতে গেল বছর প্রায় উৎসবের রঙ ফিকে হয়েছে। প্রিয়জন হারানোর মর্মন্তুদ আর্তনাদ শুনেছে আকাশ। জরা-ব্যাধি, শোক-তাপে জর্জরিত মন্দ সময়কে পেছনে ফেলে নগরবাসীর কামনা- ঋতুরাজের হাত ধরে এবার আসুক নতুন দিন।
তাই নিসর্গে ঋতুরাজের রঙিন শাসনের অভিষেকে ঢাকাবাসীর আয়োজনেও কমতি নেই। নৃত্যে, বাদ্যে, ছন্দে-গীতে বসন্ত বরণের সব আয়োজন চূড়ান্ত।
বরাবর ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত উৎসব পালিত হলেও গত বছর বাংলা একাডেমির সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বসন্ত উৎসব এখন থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে। দিনটি একইসঙ্গে আবার ভালোবাসা দিবসও। রোববারের দিনটি বঙ্গে রঙের উৎসব- এ কথা বললে ভুল হবে না খুব।
বঙ্গে বসন্ত উৎসব
পুরীতে ফাল্গুন মাসে যে দোলযাত্রা উৎসব হত, তার অনুকরণে বঙ্গেও প্রবর্তিত হয় এই উৎসব।
১৫৮৫ সালে সম্রাট আকবর বাংলা বর্ষপঞ্জি হিসেবে আকবরি সন বা ফসলি সনের প্রবর্তন করেন। তিনি প্রতি বছর ১৪টি উৎসব পালনের রীতিও প্রবর্তন করেন। এর মধ্যেই অন্যতম ছিল বসন্ত উৎসব।
১৯০৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে শান্তিনিকেতনে যাত্রা শুরু করে বসন্ত উৎসব, যা ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব' নামেই পরিচিত।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জন্য বানিয়ে রাখা রঙিন কাগজের ফুল, প্রজাপতি ও পাখির অবয়ব নিয়ে চারুকলা অনুষদের ৮৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বর্ণিল শোভাযাত্রা বের করেন।
পরে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সালে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ- এর আয়োজনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় শুরু হয় বসন্ত উৎসব।
‘এ বসন্ত অনেক মূল্যবান’
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সংযোগ; সে সংযোগেই ফি বছর বসন্ত নতুন আবেদন নিয়ে হাজির হয় এই দেশে।
বসন্ত বন্দনায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছয়টি ঋতুর মধ্যে এই বসন্ত অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, অত্যন্ত বেগবান, অত্যন্ত মূল্যবান। বসন্ত আসলেই তো আমাদের নগরে নতুন পাতা দেখা যায়, নতুন ফুল দেখা যায়। নতুন নতুন ফুলগুলো দল মেলে ফুটে উঠতে কতটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে! তখন আমাদের মনটা আপনাআপনি অন্য রকম হয়ে যায়।
“প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একনিষ্ঠ ও গভীর যোগাযোগ। তার থেকে বেরিয়ে যাওয়া তার অবহেলা করা কোনোভাবেই সম্ভব না।”
বসন্তের রূপ-রস গ্রহণে উন্মুখ বাঙালির বসন্ত বন্দনার প্রাক্কালে প্রবীন এই নিসর্গবিদ বলেন, “বসন্তের এই রূপকে অবহেলার কোনো যুক্তি নেই। সেই বসন্তকে বরণ করে নিব আমরা। চারিদিকে নানা রঙের ফুল ফুটে উঠেছে, তাই মন আনচান করে উঠেছে। ঋতু তার সব রঙ মনের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য আমরা বলি আমরা প্রকৃতির সন্তান।”
মহামারীকাল কাটেনি এখনও। তবুও সে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে নাগরিক দল আবার তাদের মতো করে প্রকৃতিতে সাজিয়ে নেবেন বলে মনে করেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া।
বসন্তেও প্রতিবাদের বার্তা
শত বছর আগে শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি বন্দনায় যে বসন্ত উৎসবের সূচনা করেছিলেন, গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এসে তার রূপ বদলে যায় বাংলাদেশে।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ও বর্তমানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে উৎসরিত প্রতিবাদের স্ফূরণ চিত্রিত হয়েছে বাঙালির বসন্ত বরণে।
বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল ৮ ফাল্গুন। অন্যদিকে একাত্তরে ২৫ মার্চের কালরাতে যে নির্মম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তাও প্রত্যক্ষ করেছে বসন্ত।
হাসান আরিফের মন্তব্য, বসন্ত তাই বাঙালি জীবনে নতুন প্রতিবাদের বার্তা বয়ে আনে।
“আমরা এক বসন্তে বুকের রক্ত দিয়ে ভাষার স্বাধীনতা পেলাম, আরেক বসন্তে লাখো মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হল। বাঙালি জীবনে বসন্তের যে তাই ভিন্ন মাত্রা। তাই বসন্ত উৎসবে গান, কবিতা ও কথনেও আমাদের প্রতিবাদের বার্তা থাকে।
“সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমাদের যে সার্বিক লড়াই তার কথাই আমরা প্রতিপাদ্য করে তুলি বসন্ত উৎসবে। এই উৎসবে আমরা বাঙালির আত্মদানের কথা মনে করি, অন্যায়ের প্রতিবাদে জ্বলে উঠার দীক্ষা নিই।”
নগরজুড়ে বসন্ত উৎসবের আয়োজন
জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ- এর বসন্ত বরণের আয়োজনটি এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।
এছাড়াও একই দিন বিকাল সাড়ে ৩টায় গেণ্ডারিয়ার সীমান্ত গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ, উত্তরার আজমপুর প্রাইমারি স্কুল মাঠেও বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষৎ।
রোববার বিকাল ৪টায় শিল্পকলা একাডেমির নন্দনমঞ্চে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করবে শিল্পকলা একাডেমি, যার উদ্বোধন করবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু।