নেত্রকোণা আ. লীগ সভাপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে নেত্রকোণা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান খানের বিচার চেয়ে ট্রাইব‌্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আবেদন করেছেন স্থানীয় একজন মুক্তিযোদ্ধা।

সুলাইমান নিলয়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2016, 04:20 AM
Updated : 1 Dec 2016, 04:33 AM

একাত্তরে ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা’ মতিউরের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সহযোগীসহ অন্তত দুজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

ট্রাইব‌্য‌ুনালের তদন্ত সংস্থা বলেছে, তারা নিয়ম অনুযায়ী তদন্ত করবে। অন‌্যদিকে মতিউর রহমান খান কোনো ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা মো. শামছুজ্জোহা গত সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব‌্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে এই অভিযোগ জমা দেন।

আবেদনের সঙ্গে তিনি একাত্তরে শান্তি কমিটির একটি সভার ‘প্রতিবেদনের অনুলিপি’ দেন, যেখানে সভায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মতিউর রহমান খানের নাম রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাইব‌্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মতিউর রহমান খান নামে নেত্রকোণার একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। আমরা সেটাকে নথিভুক্ত করেছি।”

এই মতিউরের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অভিযোগের কোনো কিছুই আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখিনি। তার পরিচয়ও জানি না। আইন অনুসারে আমরা ধারাবাহিকভাবে এটা নিয়ে কাজ করব।”

অন‌্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ অভিযোগের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত কী হবে- সেটা এখনও জানি না। আমাদের কাছে এ ধরনের প্রায় ৬০০ অভিযোগ রয়েছে। আমাদের লোকবলও সীমিত। সীমিত লোকবল নিয়ে কাজ করছি। তাই এখনই পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বলা যাচ্ছে না।”

অভিযোগ অস্বীকার করে মতিউর রহমান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন। একাত্তরে তিনি মুক্তারপাড়া এলাকায় শ্বশুরের বাসায় পাক হানাদারদের নজরবন্দি ছিলেন। তার জামিনদার ছিলেন নেত্রকোণা কলেজের অধ্যক্ষ।

এই বক্তব্যের সমর্থনে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে সে সব তিনি হাজির করবেন।

মতিউরের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থার কাছে দাখিল করা মুক্তিযোদ্ধা শামছুজ্জোহার অভিযোগ বলা হয়, “একাত্তরে দুই বার তার বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। প্রথমবার ২০ এপ্রিল রাজাকার সৈয়দ হাফিজ উদ্দিন, সৈয়দ সোনা মিয়ার নেতৃত্বে ভোলা মিয়া, আল বদর শহীদুল্লাহ পিন্টু ও আব্দুর রহিম ফরাজী আক্রমণে অংশ নেন। তারা এসে বাড়ির মালামাল ‍লুট করে নিয়ে যায়।

“দ্বিতীয়বার পিন্টু-ফরাজী-ভোলা এলেও নেতৃত্বে ছিলেন আল বদর নেতা মতিউর রহমান খান। ওই দিন রাজাকার-আল বদররা আমার বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র ভাংচুর করে আগুন দিয়ে দেয়।”

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিরে এসব ঘটনা জানতে পেরেছেন জানিয়ে শামছুজ্জোহা বলেন, “আমি বাড়ি ঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় জড়িত ওই রাজাকার-আল বদরদের বিচার চাই।”

অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ অগাস্ট নেত্রকোণা সদরের কুরপাড়ের মুকতুল হোসেনের বাড়িতে আক্রমণ করে তাকে আটক করে আনসার ব্যারাকে বসানো হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে সারা রাত পৈশাচিক নির্যাতন করা হয়।

“আল বদর মতিউর রহমান খানের নেতৃত্বে পিন্টু-ফরাজী-ভোলা ওই আক্রমণে অংশ নেয়। তারা পরে মুকতুল হোসেনকে মগড়া নদীর তীরে নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। তার লাশ আর পাওয়া যায়নি।

“বাড়ি থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় এলাকার মানুষ ওই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। আমি সোর্সের মাধ্যমে উল্লিখিত ঘটনা জানতে পারি। পরে এলাকার লোকজনের কাছে ঘটনা জানতে পারি,” অভিযোগে লিখেছেন শামছুজ্জোহা।

তিনি বলেন, একাত্তরে নেত্রকোণা কৃষি অফিসের পিয়ন মুকতুল আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। রাজাকার ও আল বদরদের তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন তিনি।

মতিউরের বিরুদ্ধে অপর অভিযোগ, দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি নোয়াপাড়ার অধ্যাপক আরজ আলীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা।

লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১৫ অগাস্ট আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে অধ্যাপক আরজ আলীকে নেত্রকোণা কলেজ থেকে ধরে নেত্রকোণা ভোকেশনাল আর্মি ক্যাম্পে নেওয়া হয়।

“আল বদর মতিউর রহমান খান, অধ্যাপক মুন্সী আব্দুল জলিল, পিন্টু ও ফরাজী এতে অংশ নেয়। পরদিন আরজ আলীকে হত্যা করে আসামিরা লাশ সোমেশ্বরী নদীতে ফেলে দেয়। ওই ঘটনা নুরুজ্জামান, খোরশেদ আলী, আব্দুল হামিদসহ অনেকে প্রত্যক্ষ করে।”

প্রত্যক্ষদর্শীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত বলে আবেদনে জানিয়েছেন শামছুজ্জোহা।

মুক্তিযোদ্ধা গোলাম এরশাদুর রহমানের লেখা ‘মুক্তিসংগ্রামে নেত্রকোণা’ বইয়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল আজিজ তালুকদার, ডাক্তার হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, নুরুল ইসলাম খান, ছাত্রলীগ নেতা মতিউর রহমান খান (নেত্রকোণা কলেজ সংসদের ১৯৬৯ সালের জিএস), দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সংবাদদাতা আল আজাদ ও নেত্রকোণা কলেজ সংসদের ১৯৭০ সালের জিএস জাহাঙ্গীর কবীর হানাদারদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামছুজ্জোহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনার (মতিউর) পিতার নাম আব্দুর রহমান খান। তাদের বাড়ি সাতপাইয়ে। তিনি বর্তমানে নেত্রকোণা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলা পরিষদের প্রশাসক।”

প্রায় তিন মাস আগে মতিউরকে সভাপতি করে নতুন কমিটি হয়। এর আগে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত হিসাবে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। নতুন কমিটির সভাপতি-সম্পাদকের নাম ঘোষণা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি এখনো হয়নি।

একাত্তর সালের আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে থাকলেও একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে মতিউর আল বদর বাহিনীতে যোগ দেন বলে শামছুজ্জোহার দাবি।

“উনার ঘটনা মুখে মুখে আমরা জানতাম। পর্যাপ্ত প্রমাণাদির অভাবে অভিযোগ করিনি। সম্প্রতি একাত্তরে শান্তি কমিটির এক সভায় অংশ নিয়েছেন বলে কাগজ পাওয়ার পর অভিযোগ দাখিলের সিদ্ধান্ত নেই।”

শামছুজ্জোহা বলেন, স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮-৬৯ সালে মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মতিউর। ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নেত্রকোণা ডিগ্রি কলেজের জিএস হয়েছিলেন।

“একাত্তরের জুলাই মাসের দিকে আত্মসমর্পণ করেন। পিস কমিটির কনভেনরের প্রধান সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। উনার শ্বশুরের পরিবারের সবাই মুসলিম লীগের। তাদের মাধ্যমেই পাক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়।”

মুক্তিযোদ্ধা শামছুজ্জোহা ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।