অবসরের পর রায় লেখা অসাংবিধানিক নয়: আইনমন্ত্রী

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বক্তব্যে ভিন্নমত জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, অবসরে যাওয়ার পর কোনো বিচারকের রায় লেখা অসাংবিধানিক হতে পারে না।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2016, 01:43 PM
Updated : 27 Jan 2016, 02:20 PM

সহকর্মীদের নিয়ে বিচারপতি সিনহার এক বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার মধ্যে মঙ্গলবার সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় একথা বলেন আইনমন্ত্রী।

একদিন আগে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করার পর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এদিন সংসদে এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য দাবি করেছিলেন।

এরপর আনিসুল হক বলেন, “আমাদের যে সংবিধান, তার কোনো আর্টিকেলে এ কথা লেখা নাই যে বিচারপতি তার অবসর গ্রহণের পর রায় লিখতে পারবেন না। তা যদি হয়, তাহলে এটা আর যাই হোক অসাংবিধানিক হতে পারে না।”

প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিজের দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্তিতে গত ১৭ জানুয়ারি এক বাণীতে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, অবসরে যাওয়ার পর বিচারকদের রায় লেখা ‘সংবিধান পরিপন্থি’

তার ওই বক্তব্য আসার পর থেকে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা চলছে। তার ভিত্তিতে বিএনপি বলছে, অবসরের পরে লেখা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায়ও তাহলে অবৈধ

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা

প্রধান বিচারপতির যুক্তি, বিচারপতিরা অবসরে যাওয়ার পর তাদের শপথের কার্যকারিতা থাকে না বলে তারা রায় লেখার অধিকারও হারান।

আইনমন্ত্রী বলেন, “হাই কোর্ট ডিভিশনের স্টাবলিশ রুলস এ যেটা আছে, রায় যতদূর সম্ভব এজলাসে বসেই দেওয়ার কথা। কিন্তু যদি এমন হয় যে তারা রায়টা এজলাসে দিতে পারছেন না মামলার চাপের জন্য। তাহলে অর্ডারিং পোর্শন বলার পরে এজলাসের বাইরে রায় লেখার অধিকার রাখেন।

“অ্যাপিলেট ডিভিশন রুলস আছে। সেখানে কিন্তু একথা নাই যে এজলাসে দিতে হবে। পরিষ্কার লেখা আছে, রায় দিতে হবে- ওপেন কের্টে অর্ডারিং পোর্শন পর্যন্ত। রায় পরে লেখা হবে। অবসরে যাওয়ার পর আর লেখা যাবে না সেটা লেখা নাই।”

“কোনো রুলস বা আইন দ্বারা বারিত নয় বলে অবসরে যাওয়ার পরে রায় লেখা বেআইনি নয়,” বলেন আইনমন্ত্রী।

বিচারাঙ্গনের কাজ গতিশীল করার উদ্দেশ্য থেকে দেওয়া প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্য নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ‘ঘোলা করার’ চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন আনিসুল হক।  

তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধান বিচারপতি এটা বলেছেন, এটার একটা কারণ তো আছে। এমন যদি হয় যে, আজকে কোনো কোনো বিচারপতি রায় যদি দেরি করে লেখেন, তাহলে লিটিগেন্ট পাবলিকের অনেক অসুবিধা হয়।

“রায় হাতে পেলে তারা অ্যাপিলেট ডিভিশনে যেতে পারে। অ্যাপিলেট ডিভিশনের রায় হাতে পেলে কার্যকর করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের রায় প্রয়োজন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি যেটা দেখেছেন, আমরাও সেটা দেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে রায় অবসর নেওয়ার পর লেখা হচ্ছে।”

এ বিষয়ে প্রধান বিচারপতি ‘প্র্যাকটিস ডাইরেকশন’ দিতে পারেন মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী বলেন, “সেখানে তিনি উল্লেখ করে দিতে পারেন, রায় অবসরে যাওয়ার তিন-চার মাস আগে বা একটা টাইম ফ্রেম দিয়ে বলতে পারেন যে এর মধ্যে লিখতে হবে।”

তত্ত্বাবধায়কের রায় ‘বাতিল হয়েছে’ বলে বিএনপির দাবির পাল্টায় তিনি বলেন, “মাননীয় প্রধান বিচারপতি কিন্তু এটা বলেছেন, কোনো রায় বাতিল হবে না। তিনি পরিষ্কার করেছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক

“এটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা... এটা হচ্ছে ওই ষড়যন্ত্র করে পরিষ্কার পানি ঘোলা করার চেষ্টা।”

প্রধান বিচারপতি যে ‘দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছেন, তার পশ্চাতের কথা বলা হলে সংসদ তা গ্রহণ করবে, বলেন আনিসুল হক।

প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের অন্তঃকোন্দল প্রকাশ্য হয়েছে বলে মনে করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

তিনি এক দিন আগে এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, “আপনারা দুই বিচারপতির মধ্যে গোলমাল, আক্রোশ-বিক্রোশ, এটা বাইরে আসবে কেন? আমি এবং তুমি- এটা জনগণ জানবে কেন? আপনাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে, আর আপনি সেটা নিয়ে পাবলিকলি কথা বলে অনেককে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন। নিজস্ব কোন্দলের জন্য জাতীয়ভাবে এত বড় একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করবেন, এটা আমরা আশা করি না।”

এর মধ্য দিয়ে স্পষ্টতই সম্প্রতি অবসরে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগের দিকে ইঙ্গিত করেছেন সুরঞ্জিত।

আপিল বিভাগ থেকে কয়েক মাস আগে অবসরে যাওয়া বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন, রায় লেখা শেষ না করায় তার পেনশন আটকে দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি।

সুরঞ্জিতের বক্তব্যের পর সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে কথা বলার সূত্রপাত করেন স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী। এরপর আলোচনার জন্য দাঁড়ান সুরঞ্জিত।

তিনি বলেন, “তিনি একটি পাবলিক স্পিচে বলে বসলেন এক্সিকিউটিভ জুডিশিয়ারির ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে।  এই কথা বলা শপথের পরিপন্থি। আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এর পরেই দেখলাম তিনি বলে বসলেন, জাজমেন্ট ডিক্লেয়ার করার পর অবসরের পর রায় লিখলে অসাংবিধানিক।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

“এটা যদি অসাংবিধানিক-অগণতান্ত্রিক হয় তাহলে রাষ্ট্রের ভিত্তিগুলো অসাংবিধানিক হয়ে যায়। ইনক্লুডিং চিফ জাস্টিস হিমসেলফ। এ ধরনের কোনো কথা জুডিশিয়ারির কাছ থেকে আসার পরে দেশটা কেঁপে উঠল। সাথে সাথেই আমাদের বিরোধী দল বলে বসল এই সরকার অবৈধ।”

“রাজনীতি যখন স্থিতিশীল হয়ে আছে তখন তার এই কথা উসকানি। আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্টের মতো একটি প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে যদি এটি রেমপেন্ট (নির্বিচার) মন্তব্য চলে আসে...”

সুরঞ্জিত বলেন, “যদি প্রধান বিচারপতি মনে করেন তিনি পশ্চাতে যেতে পারবেন না। যে জাজমেন্ট হয়ে গেছে সেটা হয়ে গেছে। তিনি হাই কোর্ট বা অ্যাপিলেট ডিভিশন রুলস সংশোধন করতে পারেন। এ সম্পর্কে কারও কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার নাই।

“তখনই মানুষ মনে করবে, আপনার কোনো এজেন্ডা আছে। মানুষ মনে করে... আমরা ঘর পোড়া গরু। নিশ্চয়ই কোনো অসাংবিধানিক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে সাংবিধানিক শক্তি এ কথা বলছে।”

সংসদে আলোচনার মধ্য দিয়ে এই বিষয়টির ইতি ঘটবে বলে প্রত্যাশা করেন প্রবীণ রাজনীতিক সুরঞ্জিত।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, “এভাবে কথা বলা তার (প্রধান বিচারপতি) ঠিক হয়নি। একই কথা তিনি বার বার বলে যাচ্ছেন। তিনি যা ইচ্ছা তা বলতে পারেন না।

“তবে তার বক্তব্য ভবিষ্যতের জন্য দিক-নির্দেশনা হতে পারে। কারণ রায় লেখার ক্ষেত্রে একজন বিচারপতি দু-তিন মাস সময় নিতে পারেন। দেড় বছর, দুই বছর, ১৩ বছর লাগাতে পারেন না।”