ভোটের হার ৭৮%, কুর্দিস্তানের পক্ষে জনরায়ের আশা

বাগদাদের চাপ, তুরস্ক ও ইরানের হুমকি এবং আন্তর্জাতিক সতর্কতা উপেক্ষা করেই উত্তর ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে অংশ নিয়েছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2017, 06:24 AM
Updated : 26 Sept 2017, 10:41 AM

মোট ৫২ লাখ ভোটারের মধ্যে সোমবারের গণভোটে ৭৮ শতাংশই তাদের রায় জানিয়েছেন বলে খবর কুর্দিশ রুদাউ টেলিভিশনের।

ভোট গণনা শুরুর কথা জানিয়েছে রয়টার্স। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফল ঘোষণার আশা করা হচ্ছে।

গণভোটে ‘হ্যাঁ’ সহজেই জয়যুক্ত হবে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষে গণরায় এলেই কুর্দিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করবে এমন নয়। রায় কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের (কেআরজি) নেতা মাসুদ বারজানিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে বাগদাদ ও প্রতিবেশী অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবারের সুযোগ দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্যালট পেপারে কুর্দি, তুর্কি, আরবি ও অ্যাসিরীয় ভাষায় ভোটারদের একটি মাত্র প্রশ্ন করা হয়েছে; যাতে বলা হয়েছে, “কুর্দিস্তান ও এর বাইরের অন্যান্য (কুর্দিস্তানি) এলাকাগুলো নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ হোক তা কি চান আপনি?”

এই গণভোটের কারণে কুর্দিস্তানের সঙ্গে বাগদাদ ও ইরাকের প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্র ইরান ও তুরস্কের বিবাদ শুরু হতে পারে আশঙ্কায় নির্বাচন বাতিল করার জন্য বারজানির ওপর প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ছিল।

গণভোটের কারণে রোববার থেকেই ইরান কুর্দিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়।

ইরাক সব বিদেশি পক্ষকে কুর্দিস্তানের সঙ্গে সরাসরি জ্বালানি তেল বাণিজ্য না করার অনুরোধ জানিয়েছে;  কেআরজির হাতে থাকা সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়ার সঙ্গে থাকা সব সীমান্ত চৌকির নিয়ন্ত্রণ বাগদাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর শতাব্দীকাল ধরে ‘রাষ্ট্রবিহীন’ অবস্থায় পড়ে থাকা কুর্দিরা এই গণভোটকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন।

“খারাপ পরিস্থিতি দেখেছি আমরা, অবিচার দেখেছি, হত্যাকাণ্ড ও অবরোধও দেখেছি। আল্লাহর ইচ্ছায়, আমরা বিশ্বের অন্যান্য লোকজনের মতো হতে চাই। আমরা স্বাধীনতা চাই এবং একটি রাষ্ট্র চাই,” সোমবার ইরবিলের এক ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে এমনটাই বলেন তালাত নামের এক কুর্দি।

রয়টার্স বলছে, উত্তর ইরাকের রাজধানী ইরবিলের ভোটের লাইনগুলোতে দেখা গেছে উৎসবমুখর পরিবেশ। রঙিন পোশাক পরিহিত নারীরা ভোট কেন্দ্র থেকে বের হয়ে হাসিমুখে তাদের আঙ্গুলের কালি দেখাচ্ছিলেন।

যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি শেখ আমির গ্রামে কুর্দি পেশমেরগা যোদ্ধাদের বিশাল ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ভোট শেষে তারাও ছিলেন হাসিমুখে, দেখাচ্ছিলেন আঙ্গুলে থাকা ভোটের চিহ্ন।

কিরকুকে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দাদের নেচে গেয়ে ভোট কেন্দ্রের দিকে যেতে দেখা গেছে।

তেল সমৃদ্ধ শহরটির আরব ও তুর্কি অধিবাসীর অনেকেই গণভোটের বিরোধিতা করেছেন।

“ইরাক কুর্দিদের বিপক্ষে; তুর্কিরা, ইরানিরা, আরবরা এমনকি ইউরোপীয়রাও এর বিরুদ্ধে। তাদেরকে (কুর্দি) তো খাঁচার মধ্যে থাকতে হবে,” বলেন মোহাম্মদ মাহদি আল-বায়াতি। দক্ষিণ কিরকুকের ইরান সমর্থিত আধাসামরিক বদর বাহিনী তুজ খুরমাতোর স্থানীয় এ নেতা শিয়া তুর্কি।

বারজানির প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক কেন্দ্র সুলাইমানিয়া অঞ্চলের ভোটকেন্দ্রগুলোতেও খুব বেশি লোক দেখা যায়নি; এখানে গণভোটের সমর্থনে বিলবোর্ডের সংখ্যাও কম।

“আমি ভোট দেব না; গণভোট ভালো নয়। এর কারণে তুরস্ক এবং ইরানের হুমকি আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে,” বলেন সুলাইমানিয়ার এক দোকান মালিক আলি আহমেদ।

আরব ও তুর্কিদের এই বিরোধিতার মধ্যেই মিশ্র এলাকাগুলোতে ভোট হচ্ছে না বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ পরে রাতে ওইসব এলাকায় কারফিউ জারি করে।

পূর্ব ইরাকের এক শহরের আরব বাসিন্দাদের গণভোটে ‘হ্যাঁ’-র পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে এমন অনিশ্চিত খবরের সূত্র ধরে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি কুর্দি এলাকার ‘হুমকি পাওয়া ও নিগৃহীত’ নাগরিকদের রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। কুর্দি কর্তৃপক্ষ পরে এই ধরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানায়।

কুর্দিরা বলছে, ইরাক ছাড়াও ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৩ কোটি কুর্দি জনগণকে নিয়ে তারা নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ২০১৪ সালের পর ইরাকের এক তৃতীয়াংশ দখলে থাকা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বীকৃতিও এই ভোট।

অন্যদিকে আঙ্কারা ও তেহরানের আশঙ্কা, উত্তর ইরাকের এই ভোট তাদের ভূখণ্ডে থাকা কুর্দিদেরও ‘বিচ্ছিন্নতার’ পথে ধাবিত করতে পারে। তুরস্কের বাহিনীকে দেশের ভেতরে কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তেও হচ্ছে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান গণভোটের পর উত্তর ইরাক থেকে বাইরের বিশ্বে পাঠানো তেলের পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

“এরপর দেখা যাবে উত্তর ইরাকের আঞ্চলিক সরকার কোন পথ দিয়ে তেল পাঠায়, আর কোথায় বিক্রি করে,” বলেন তিনি।

তুরস্ক থেকে কুর্দি সীমান্ত অভিমুখে যান চললেও উল্টো পথে চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা তুর্কি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সীমান্তে যৌথভাবে কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে।

তুরস্কের এক সম্প্রচার কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, গণভোটের পরপরই আঙ্কারা রুদাও টেলিভিশনের স্যাটেলাইট চ্যানেল তার্কস্যাট বন্ধ করে দিয়েছে।

ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্রও সতর্ক করে বলেছিল, বিবাদমান অঞ্চলে হওয়া গণভোট অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে পারে।

সোমবার পেন্টাগনের মুখপাত্র কর্নেল রবার্ট ম্যানিং সাংবাদিকদের বলেন, উত্তর ইরাকের গণভোট আইএসবিরোধী যুদ্ধের মনোযোগ সরিয়ে নেবে না বলে আশা করছেন তারা।

ইরাককেই কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলের সমস্যার সমাধান করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।