বৃহস্পতিবার তুরস্কের বোদরামের নিকটবর্তী মুগলা শহরের একটি মর্গ থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আব্দুল্লাহ। সাগরে নৌকাডুবির পর ভেসে এখানকার সৈকতে এসেছিল তার তিন বছরের সন্তান আয়লানের মৃতদেহ।
লাল টি-শার্ট আর নীল প্যান্ট পরা ওই শিশুর মৃতদেহের ছবি বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমে এসেছে; প্রশ্নের মুখে পড়েছে ইউরোপের শরণার্থী নীতি।
মধ্যরাতে বোদরাম উপদ্বীপের আকিয়ারলার এলাকা থেকে ২৩ জন যাত্রী নিয়ে গ্রিসের কোস দ্বীপের উদ্দেশ্যে সাগরে যাত্রা করার পর দুটি নৌকাডুবির ওই ঘটনায় নিহত ১২ জনের মধ্যে আয়লানের সঙ্গে তার পাঁচ বছরের ভাই গালিপ ও মা রেহান (৩৫) রয়েছেন।
স্ত্রী-সন্তানের মৃতদেহ নিজের শহর সিরিয়ার কোবানিতে নিতে চান জানিয়ে আব্দুল্লাহ বলেছেন, তার আর ইউরোপে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।
“আমি শুধু শেষবারের মতো আমার সন্তানদের দেখতে চাই এবং চিরদিন তাদের সঙ্গে থাকতে চাই।”
তিনি বলেন, “নিজ দেশে যুদ্ধ থেকে বাঁচতে আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেখানে আমাদের যা ঘটল তা সারা বিশ্ব দেখুক-এটা আমরা চাই।
“আমরা বিশ্বের দৃষ্টি চাই, যাতে অন্যদের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটা তারা ঠেকাতে পারেন। এটাই যেন শেষ হয়।”
পুলিশকে দেওয়া আব্দুল্লাহর জবানবন্দির বরাত দিয়ে তুরস্কের হুরিয়েত পত্রিকা জানিয়েছে, পরিবারসহ তাকে গ্রিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুইবার পাচারকারীদের টাকা দেন তিনি। কিন্তু সে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারপর তারা একটি নৌকায় যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাতে উঠে পড়েন। যাত্রা শুরুর পরপর নৌকায় পানি উঠতে শুরু করলে লোকজন আতঙ্কে উঠে দাঁড়ানোর পর সেটি ডুবে যায়।
“আমি আমার স্ত্রীর হাত ধরে ছিলাম। ছেলেরা আমার হাত থেকে ছুটে যায়। আমরা কোনোভাবে নৌকাটি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। গভীর অন্ধকারে সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল।”
সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসার পর শরণার্থী জীবনে কানাডায় অভিবাসনের চেষ্টা করেছিল আব্দুল্লাহর পরিবার। কানাডা প্রবাসী বোনের স্পন্সরে অভিবাসনের ওই আবেদন গত জুনে নাকচ করে দেয় কানাডা কর্তৃপক্ষ।
আব্দুল্লাহর বোন তিমা কুর্দিকে উদ্ধৃত করে কানাডার ন্যাশনাল পোস্ট পত্রিকা জানিয়েছে, “আমি তাদের স্পন্সরের চেষ্টা করেছিলাম। আমার বন্ধু ও প্রতিবেশীরা ব্যাংক ডিপোজিট দিয়ে আমাকে সহায়তা করেছিল। কিন্তু আমরা তাদের আনতে পারিনি এবং সে কারণে তারা ওই নৌকায় গিয়েছিল।
“তুরস্কে তাদের থাকার জন্যও আমি টাকা পাঠাচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানে তারা সিরীয়দের সঙ্গে যে আচরণ করে তা ভয়াবহ।”
২০১১ সালে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ২০ লাখের মত শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে তুরস্ক। তাদের জন্য ছয়শ কোটি ডলার ব্যয় করেছে, যেখানে বাইরে থেকে সহযোগিতা হিসেবে মাত্র ৪০ কোটি ডলার পেয়েছে তারা।
শরণার্থীদের সংখ্যা সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে জানিয়ে তুরস্ক সতর্ক করেছিল যে, ইউরোপে ঢোকার লক্ষ্যে হাজার হাজার শরণার্থী বিপজ্জনকভাবে নৌকায় করে গ্রিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে।
বছরখানেক ধরে কোবানিতে ব্যাপক লড়াই চলছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেখানে ইসলামিক স্টেটের আগ্রাসন ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কুর্দিশ আঞ্চলিক বাহিনীগুলো।
যুদ্ধ কবলিত সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসা হাজারো শরণার্থী এই গ্রীষ্মে গ্রিসের উদ্দেশ্যে তুরস্কের এজিয়েন ঊপকূল থেকে নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়েছেন।
গত কয়েক দিনে তুরস্ক ও গ্রিসের বিভিন্ন দ্বীপের মধ্যবর্তী সাগর থেকে কয়েকশ অভিবাসন প্রত্যাশীকে তাদের সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিমের সদস্যরা বাঁচিয়েছে বলে তুরস্কের সেনাবাহিনী জানিয়েছে।
আব্দুল্লাহ ও তার পরিবারের সঙ্গে নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ওমের মহসিন নামের আরেক সিরীয় বলেন, রাত ২টায় যাত্রা করার কিছুক্ষণ পর নৌকাটি ডুবে গেলে সাঁতরে তীরে আসেন তিনি। এখন নিখোঁজ ভাইকে খুঁজছেন।
“নৌকায় বড় জোর ১০ জনকে উঠানো যেত। কিন্তু তারা সেখানে ১৭ জনকে উঠিয়েছিল। আমি ও আমার ভাই প্রত্যেকে দুই হাজার ৫০ ইউরো করে দিয়েছিলাম,” তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে দোয়ান বার্তা সংস্থা।
একটি ভিডিওচিত্রে সৈকতে বালুতে আরেকটি শিশুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ওই মৃতদেহটি আয়লানের ভাইয়ের হতে পারে ধারণা করা হচ্ছ্।
সৈকতে আয়লানের মৃতদেহের ছবি তুলেছেন দোয়ান বার্তা সংস্থার আলোচিত্রী নিলুফার দেমির।
তিনি সিএনএনকে বলেছেন, “যখন দেখলাম শিশুটিকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই তখন ভাবলাম তার ছবি তোলা উচিৎ, যাতে মর্মান্তিক এই ঘটনা দেখানো যায়।
“এই ছবি যে প্রভাব ফেলেছে তা সমস্যার নিরসনে সহায়তা করবে বলে আমি আশা করছি।”
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সাগর পথে এক লাখ ৬০ হাজার শরণার্থী ও অভিবাসন প্রত্যাশী গ্রিসে পৌঁছেছে। গত জুলাইয়ে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ গ্রিসে ঢুকেছে, যাদের বেশিরভাগই সিরীয়, যেখানে ২০১৪ সাল জুড়ে গিয়েছিল সাড়ে ৪৩ হাজার সিরীয় শরণার্থী।