ব্লুটুথের একাল-সেকাল

বেশ কয়েকবছর আগেও ‘ব্লুটুথ’ মানুষের কাছে ছিল অদ্ভুত এক বিষয়। অনেক সময় ছিল বিরক্তির কারণও। কোনো ডিভাইসের সঙ্গে পেয়ার করে ডেটা শেয়ার করার কাজটা এখন খুব সহজ মনে হলেও একসময় সেটাকেই মনে করা হত বড় এক রহস্য। এমনকি ব্লুটুথ হেডসেট কানে লাগিয়ে কথা বলেও অনেকেই আইনি ঝামেলায় পড়েছেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক আর্টিকলে বর্ণনা করা হয়েছে ব্লুটুথের বিভিন্ন বিবর্তন সম্পর্কে।

শরীফুল হক আনন্দবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2014, 01:05 PM
Updated : 30 Oct 2014, 01:05 PM

১৯৯৯ সালে প্রথম বাজারে আসে ‘ব্লুটুথ’ নামের শর্ট রেঞ্জ ওয়্যারলেস রেডিও টেকনোলজি। তবে বিগত বছরগুলোতে প্রযুক্তিটিতে ক্রমাগত পরিবর্তন আসায় এটি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে তারবিহীন দুটি ডিভাইসকে সংযোগ দেয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম। শুধু অ্যান্ড্রয়েড কিংবা স্মার্টফোনই নয়, এখন ফিটনেস ট্র্যাকার, দরজার তালা এমনকি দাঁতের ব্রাশ ও বাল্বেও এসে গেছে ব্লুটুথের ব্যবহার। বোঝাই যাচ্ছে, ক্রমাগত পরিবর্তনের কারণে এই সময়ের উন্নত একটি প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ব্লুটুথ।

উন্নত এই ব্লুটুথের নামগুলোও এখন বেশ রকমারী। ব্লুটুথ স্মার্ট, ব্লুটুথ ফোর, ব্লুটুথ লো এনার্জির মত বেশ কয়েকটি আধুনিক ব্লুটুথ এখন পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। ব্লুটুথ লো এনার্জির বিশেষত্ব হল, এর মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব কম তথ্য অন্য একটি ডিভাইসে পাঠানো যায়। ব্লুটুথ নামকরণের ইতিহাসটাও অদ্ভুত বটে। দশম শতাব্দীর ড্যানিশ রাজ্যের রাজা হেরাল্ড ব্লুটুথের নামে রাখা হয়েছে এই প্রযুক্তিটির।

ব্লুটুথের বর্তমান হাল-হকিকত জানাতে ব্লুটুথ স্পেশাল ইন্টারেস্ট গ্রুপের প্রতিনিধি সুক জাওয়ান্ডা বলেন, “আধুনিক সময়ে এসে ব্লুটুথের ভূমিকাটাই বদলে গেছে। পুরো পৃথিবী এখন দেখছে, ব্লুটুথের বিস্তার সবখানেই। সবকিছুকে একসঙ্গে এক সুতোয় গাঁথা পৃথিবীতে নিয়ে আসা হচ্ছে। এবং এট সম্ভব হচ্ছে এই ব্লুটুথ স্মার্ট ব্যবহারের কারণে”। ব্লুটুথের নতুন ভার্সনগুলো এখন খুব অল্প সময়ে এবং স্বল্প দূরত্বের ব্যবধারে তারবিহীন দুটি ডিভাইসে দ্রুত তথ্য পাঠাতে পারে। সেটা হতে পারে কোনো ফাইল ফোল্ডার কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোড।

‘স্বল্প-চার্জখেকো’ হওয়ায় ডিভাইস ব্যাটারির উপর চাপও কমিয়ে দিয়েছে এখন ব্লুটুথ। এছাড়াও অন্য ডিভাইসের সঙ্গে পেয়ার করার ঝামেলাও অনেক কমে এসেছে। এখন যেকোনো মোবাইলের অ্যাপ সেটিং ব্যবহার করেই অন্য একটি মোবাইলের সঙ্গে পেয়ার করা সম্ভব এই নতুন ব্লুটুথের মাধ্যমে।

 ‘মোটো থ্রি সিক্সটি’ স্মার্টওয়াচটি চালু করার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের জন্য একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলবে। অ্যাপটি ডাউনলোড করার পর সেটি নিজে থেকেই ডিভাইসটির নাম এবং পেয়ারিং কোড খুঁজে নেবে এবং অন্য ডিভাইসে পেয়ার করার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে।

ডেভেলপাররা মনে করছেন, ডিভাইসের ব্যাটারির দীর্ঘ মেয়াদের জন্যই ব্লুটুথের ব্যবহার আরও উন্নত হয়েছে। এছাড়াও অনেকগুলো ডিভাইসকে একসঙ্গে করে ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজলভ্যতাও বেড়েছে। ‘জেয়স্টার’ নামের একটি কোম্পানি এখন ব্লুটুথ স্মার্টের মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারীর মোবাইল পেয়ার করছেন কি চেইনের সঙ্গে। কোম্পানিটির কি চেইন এবং ওয়ালেটে যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি গ্রাহককে দেবে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা। এবং ডিভাইসের সঙ্গে পেয়ারিং এর ক্ষেত্রেও থাকবে উন্নত ব্যবস্থা।

তবে, আধুনিক ব্লুটুথের নেতিবাচক কোনো ব্যাপারও যে নেই, তা কিন্তু নয়।

এখনপর্যন্ত ব্লুটুথের সবচেয়ে সমালোচিত বিষয়টি হল, স্বল্প দূরত্বে এর ডেটা ট্রান্সফারের সীমাবদ্ধতা। ঘরের তাপমাত্রা নির্ধারণের জন্য মোবাইল থার্মোস্ট্যাট চালু করা হলে সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য ওয়াই-ফাই সংযোগ চালু করতে হবে। বড় কোনো ঘরের ক্ষেত্রে শুধু ব্লুটুথ চালু করা হলে সেটি নির্ধারিত দূরত্বের বাইরে চলে গেলে সঠিক তথ্যটি আর পাওয়া সম্ভব হবে না।

একটি ব্লুটুথের সাধারণ দূরত্ব সীমা হল ৫০ থেকে ১৫০ ফুটের মত। ৩০০ ফুট দূরত্ব ব্যবধানেও ব্লুটুথ কার্যকর হবে যদি দুইটি একই ব্র্যান্ডের ডিভাইসের সরাসরি সংযোগ প্রদান করা হয়। যদিও এই সংযোগটি বিচ্ছিন্ন হতে পারে কোনো দেয়াল বা কোনো বস্তুর উপস্থিতিতে। ব্লুটুথ স্মার্টে অবশ্য এই সমস্যাটি কিছুটা হলেও কম।

নিরাপত্তার ব্যাপারেও রয়েছে এর সীমাবদ্ধতা। অনেক গবেষকই জানিয়েছেন, তারা ব্লুটুথ স্মার্টেই এনক্রিপশন বাইপাস করতে সমর্থ হয়েছেন, যদিও জাওয়ান্ডার দাবী,  নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্লুটুথ এখন বেশ শক্ত অবস্থানে। ব্লুটুথের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইতোমধ্যেই ওয়াই-ফাই ডিরেক্ট নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ওয়াই-ফাই ডিরেক্ট ব্যবহার করে এখন আরও দ্রুত ডেটা ট্রান্সফার করা সম্ভব, এবং এটি বেশ নিরাপদও বটে।

ওয়াই-ফাই ডিরেক্ট ব্যবহার করে এখন যে কোনো দুইটি ডিভাইসকে রাউটার ছাড়াই সংযোগ প্রদান করা সম্ভব। গোপ্রো হিরো ফোর এর মতো ক্যামেরার সঙ্গে এখন যে কোনো মোবাইলেই সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব ওয়াই-ফাই ডিরেক্ট ব্যবহারের মাধ্যমে। এছাড়াও সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিবর্তনের কারণে ওয়াই-ফাই ডিরেক্টের মাধ্যমে ডেটা ট্রান্সফারের মত ব্যাপার হয়ে এসেছে আরও সহজতর।

এই মূহুর্তে ডেটা ট্রান্সফার এবং দুটি তারবিহীন ডিভাইস সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে ব্লুটুথ স্মার্ট এবং ওয়াই-ফাই ডিরেক্টই। ‘নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন’ কিংবা ‘জিগবি’ এর মত কানেকশন স্ট্যান্ডার্ডগুলো এই দুইটি প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের শক্ত অবস্থানে আসার পথটাও কঠিন।

ব্লুটুথ এবং ওয়াই-ফাই ই এখন প্রায় সকল ডিভাইসে বিদ্যমান ও ব্যবহারযোগ্য। বিশেষ করে ব্লুটুথ, কেননা এটি বেশ সার্বজনীন এবং নির্ভরযোগ্যতাও বেশি। সময়ের সঙ্গে এর পরিবর্তন ঘটেছে, পরবর্তী সময়েও এর ইতিবাচক পরিবর্তনই ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাড়িতে ব্লুটুথের ব্যবহারেও আসছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। একটি চিপ থেকে অন্য চিপে তথ্য পাঠানোর মাধ্যমে এখন গাড়ির অডিও স্ট্রিমিং, চাকার চাপ এবং তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

ব্লুটুথের ব্যবহার সামনের সময়গুলোতে আরও কতটা এগিয়ে যায়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।