দেশে ক্ল্যাসিফাইডের সম্ভাবনা বিশাল

দেশে ক্রমশ তৈরি হচ্ছে ক্ল্যাসিফাইড বিজ্ঞাপনের বাজার। একইসঙ্গে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের একেবারে প্রথম দিকের ক্ল্যাসিফাইড বিজ্ঞাপন পোর্টালটিও।

হাসান বিপুলও আব্দুল্লাহ জায়েদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2014, 02:01 PM
Updated : 12 August 2014, 08:18 AM

এই বিজ্ঞাপন বাজার আর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিষয়ে আমরা কথা বলি এখানেই ডটকম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আরিল্ড ক্লোক্করহৌগ-এর সঙ্গে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা জানালেন দেশে ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপন বাজার আর এখানেই নিয়ে নিজের দৃষ্টিকোণ আর পরিকল্পনার কথা।

কী দরকার ছিল নতুন নামের?

কিছুদিন আগে থেকেই নতুন নামে পরিচিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্লাসিফাইড অ্যাডের সাইট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নাম ছিল ‘সেলবাজার’। সাইটটির পরিচিতিও তৈরি হচ্ছিল ওই নামকে ঘিরেই। তাহলে কেন এই পরিবর্তন? উত্তরে পুরানো টেকনিকাল প্ল্যাটফর্ম আর প্রতিযোগিতার কথা বললেন আরিল্ড ক্লোক্করহৌগ। “২০০৬-০৭ সালে তৈরি বেশ পুরোনো একটা প্ল্যাটফর্ম ছিল সেলবাজার। অনেক বেশি ক্যাটেগরি ছিল, বাজারে প্রতিযোগিতাও বাড়ছিল। আমরা তখন নতুন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরির সিদ্ধান্ত নেই।”

প্রথম পদক্ষেপটা ছিল টেকনিকাল প্লাটফর্ম। আর ২০১৪-এর শুরুতেই বড় পরিবর্তন আসে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায়। আর পরের পদক্ষেপ ছিল নাম পরিবর্তন। ‘সেলবাজার’ নামটা শুনে মনে হতে পারে সাইটটা কেবল মোবাইল ফোন কেনা-বেচার জন্য। আর তাছাড়া বাংলা-ইংরেজি নামের মিশেলের বদলে পুরো বাংলা একটা নামই চাইছিল নতুন ব্যবস্থাপনা।

‘এখানেই’ কেন?

নতুন নামটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ইচ্ছের পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে অন্যান্য বিষয়ও। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে আছেন আরিল্ড। পরিবারে যেমন বাংলার প্রচলন আছে তেমনি নিজেও বাংলায় বেশ পারদর্শী এই নরওয়েজিয়ান নাগরিক।

বাংলা ভাষার প্রতি নিজের ভালোবাসার ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললেন এভাবে-- “আমি পারবোই, পারবো। বা আমি করবোই, করবো। এই যে জোরটা, এই শক্তির এমন প্রকাশ অন্য কোনো ভাষায় নেই। এটা এমনই সুন্দর।”

“আর এই যে বাংলা ভাষার জোর, এটাকেই আমরা ক্লাসিফাইডের বেলায় আনতে চেষ্টা করেছি। প্রচলিত শপিংয়ে আপনি দোকানে যাবেন, পণ্য খুঁজবেন। আর অনলাইন ক্লাসিফাইডে আপনি কিন্তু খোঁজ করবেন দরকারি জিনিসটি হাতের নাগালে কার কাছে পাওয়া যায়। সেই প্রশ্নের জবাবই আমরা নিয়েছি নামের বেলায়। কোথায় পাওয়া যাবে? উত্তর, এখানেই।”

কেবল নামই পাল্টালো, না-কি সেবাও?

আরিল্ডের মতে এখানেই ডটকম হওয়ার আগে থেকেই যারা সেলবাজার ব্যবহার করে আসছেন তারা খুব বেশি গরমিল পাবেন না সাইটটিতে। টেকনিকাল প্ল্যাটফর্মে অনেক পরিবর্তন আনা হলেও কাজটি করা হয়েছে সময় নিয়ে। রাতারাতি সব কিছু পাল্টে না দিয়ে প্রতি সপ্তাহেই ছোট পরিবর্তন এনে পাল্টে দেওয়া হয়েছে সাইটটির প্লাটফর্ম। তাই ব্যবহারকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে সাইটে খুব বেশি পরিবর্তন ধরা পড়বে না কারো চোখে।

তবে মালিকানা হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক সেবা, জালিয়াতি ঠেকানোর মতো বিষয়গুলোতে বড় পরিবর্তন এসেছে বলে জানালেন আরিল্ড। দক্ষ জনশক্তি যোগ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। সব মিলিয়ে এখানেই ডটকমের সেবার মানও যে বেড়েছে গ্রাহকরা সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন বলেই জানালেন তিনি।

বুঝলাম, কিন্তু অন্য ক্লাসিফাইডের সঙ্গে আপনারা আলাদা কোথায়?

শুরুতে ছিল সেলবাজার আর ক্লিকবিডি। এরপর একে একে যোগ হয়েছে আরো বেশ কয়েকটি সাইট। এখানেই ডটকমের মতো অন্যান্য সাইটগুলোতেও বিনিয়োগ করছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা।

আরিল্ড বললেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্লাসিফাইড অ্যাড আর ই-কমার্স সাইটগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজারে এখন সক্রিয় জার্মানি, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের শীর্ষ বিনিয়োগকারীরাও। সক্রিয় আছে মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিনরও। তাই প্রতিযোগিতা যেমন বাড়ছে তেমনি নতুন গতি পাচ্ছে গ্রাহকসেবাকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।

তবে ক্লাসিফাইড সাইটগুলোর একটা বড় সমস্যা হলো জালিয়াতি। বিনামুল্যে বিজ্ঞাপনের সুযোগ নিয়ে বানোয়াট অ্যাড বা চুরি করা পণ্য বিক্রির চেষ্টা নতুন কিছু নয়। ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাইবার জগতে বাড়ছে ঠক-জালিয়াতদের সংখ্যাও। এখানেই ডটকমের ব্যবহারকারীদের এই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচাতে প্রতিষ্ঠানটি বেশ তৎপর বলেই জানালেন আরিল্ড। স্বচ্ছতার অভাব, সন্দেহজনক পণ্য ও বিক্রেতা ইত্যাদি কারণে প্রতি মাসে ৫০ হাজারেরও বেশি সন্দেহজনক বিজ্ঞাপন বাতিল করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ভুয়া পোস্ট ও জালিয়াতদের চিহ্নিত করতে এখানেই ডটকমের মডারেশন টিমকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বিদেশী বিশেষজ্ঞরাও। তারপরেও যে এমন ঘটনা ঘটছে না তা নয়, তবে সাইটটি এ ধরনের বিড়ম্বনা থেকে সাধারণ গ্রাহকদের রক্ষা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বলে জানালেন আরিল্ড।

ভালো কথা, এই সাইট থেকে গ্রাহক প্রতারিত হলে আপনারা কী করেন?

“প্রথমেই বলে নেই, আমরা সবসময়ই এ ধরনের জালিয়াতি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করি। এরপরও যদি কেউ এমন ঘটনার শিকার হন তাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি আমরা। পাশাপাশি ওই ক্রেতার অভিযোগের ভিত্তিতে ওই  প্রশ্নবিদ্ধ বিজ্ঞাপনটির বিষয়ে তদন্ত করে দেখি। বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে শুরু করে দেওয়া তথ্য, ইমেইল, সিরিয়াল নম্বর, এমনকি আইপি অ্যাড্রেস নিয়ে তদন্ত করে দেখি আমরা। ওই অভিযুক্ত ব্যক্তির যদি একাধিক বিজ্ঞাপনও পোস্ট করা থাকে তার সবগুলোই সাইট থেকে সরিয়ে দেই আমরা।’’ -- বললেন আরিল্ড। জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত করার জন্য আলাদা ‘ফ্রড ম্যানেজমেন্ট টিম’ আছে বলেও জানালেন তিনি।

এখানেই ডটকমে পণ্য বেচা-কেনার সময় সাইটটির ব্যবহারকারীদের জন্য বিশেষ কোনো পরামর্শ দেবেন কী-না সেই প্রশ্নের উত্তরে ক্যাটেগরিভিত্তিক টিপস ব্যবস্থা চালু করার সম্ভাবনা নিয়ে ব্যবস্থাপনা মহলে আলোচনা চলছে বলেই জানালেন আরিল্ড। আপাতত গ্রাহকদেরই একটু হলেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিলেন  মুচকি হেসে।

এই বাজারটা আসলে কতো বড়?

সরাসরি কোনো আর্থিক হিসেব দিলেন না আরিল্ড। প্রতিদিন গড়ে ৬/৭ হাজার নতুন বিজ্ঞাপন সাইটটিতে পোস্ট করা হচ্ছে বলে জানালন তিনি। আর বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনটিও হাতের নাগালে নেই, তাই সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বাজার কত বড় বা কত টাকার লেনদেন হচ্ছে সেটা নিয়ে পরিষ্কার কোন ধারণা দিতে অপারগতা জানালেন তিনি। তবে দেশে যে পরিমাণ ব্যবহৃত পণ্যের বেচা-কেনা চলছে তার একটা ক্ষুদ্রাংশই ক্লাসিফাইড সাইটগুলোতে আসছে বলে জানান আরিল্ড।

এখানেই-এর আয় আসে কোথা খেকে? বিষয়টা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো হচ্ছে না?

ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজনেস মডেলটা কেমন, আয়ের উৎস কী সে বিষয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীদের অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই। শুরুতেই আরিল্ড একটা বিষয় নিশ্চিত করলেন,-- “এখানেই ডটকমে বিজ্ঞাপন পোস্ট সবসময়ই ফ্রি থাকবে।” এখন এখানেই ডটকম, ওএলএক্স বা বিক্রয় ডটকমের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আর প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছেন বাজারজাতকরণ ও প্রচারণা খাতে। এর মূল কারণটা ব্যাখ্যা দিয়ে আরিল্ড বললেন, সবার লক্ষ একটাই শীর্ষস্থানে পৌঁছানো। কারণ, “ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপন বাজারে উইনার টেকস ইট অল।”

উদাহরণ দিয়ে বললেন, “হয়তো কয়েক বছর পর আপনি এখানেই ডটকমে ঢুকলেন একটা গাড়ি কিনতে। গাড়িটা কেনার সময় বিজ্ঞাপনের পেইজটিতেই গাড়ির জন্য কোনো ব্যাংকের ঋণ বা বীমার জন্য বীমা কোম্পানির বিজ্ঞাপন থাকবে। এগুলো হবে পেইড অ্যাড।” আর এই পেইড অ্যাডগুলোই হবে ক্লাসিফাইড বিজ্ঞানের সাইটের আয়ের একটি সূত্র।

বছর পাঁচেকের মধ্যেই এখানেই ডটকম ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হবে বলেই আশা প্রকাশ করলেন আরিল্ড। এর ব্যাখ্যাও দিলেন তিনি। শুধু ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে নয়। সব কিছু মিলিয়ে ব্যবহারকারীদের বিশ্বাসের স্থান গড়ে নেওয়ার কথা বললেন তিনি। আর সেটা সম্ভব হলে দৈনিন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াবে ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনের সাইটটি। উদাহরণ হিসেবে বললেন নরওয়ে-সুইডেনের কথা। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই এই ইউরোপীয় দেশগুলো থেকেই ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনভিত্তিক সাইটের উত্থান। আর এখন ওই দেশগুলোর প্রতি ১০টি পরিবারের ৯টি নিয়মিত ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনের সাইট ব্যবহার করে।

আরিল্ড ক্লোক্করহৌগের কাছে শেষ প্রশ্নটি ছিল এমন--“বিভিন্ন দেশে দেখা যায় প্রথম তিনটি ওয়েবসাইট-এর মধ্যে একটি ক্লাসিফাইড সাইট।  বাংলাদেশে এখনও কোনো ক্লাসিফাইড সাইট সেই স্থান নিতে পারেনি। কেন?”

“ইটস এ ভেরি ইয়ং ইন্টারনেট মার্কেট।”-- বললেন আরিল্ড। এখন বাজারে প্রায় একই অবস্থানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু ইউরোপের বাজারে দেখা যায় একটা বড় ক্লাসিফাইড অ্যাড সাইটের পাশাপাশি কয়েকটি ছোট ছোট সাইটও কাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারটা এখনও সেই হিসেবে ‘তরুণ’। “আর টানটান প্রতিদ্বন্দ্বীতার কারণে আমরা কৃতজ্ঞ। গত কয়েক বছরে আমাদের সাইটের যে উন্নতি ও পরিবর্তন এসেছে সেটা হতোই না যদি বাজারে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীতা না থাকতো।”