স্বস্তিতে নেই জাপানের ‘যন্ত্রপল্লী’

শত বছর ধরে সারা বিশ্বে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য সরবরাহের বাতি ঘর নামে পরিচিত জাপানের ‘যন্ত্রপল্লী’ ভাল নেই। একের পর এক লোকশান, কেলেঙ্কারি আর বিশ্ব বাজারে নিজেদের নতুন রূপে খাপ খাইয়ে নিতে না পারায় ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের জায়ান্ট কোম্পানিগুলো অনেকটাই বেকায়দায় পড়েছে। পরিবর্তন হচ্ছে মালিকানা, ছাঁটাই হচ্ছে লোকবল এরপর অন্ধকার লেগেই আছে।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2016, 01:56 PM
Updated : 20 May 2016, 01:56 PM

একসময় বিশ্বে ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতিতে নেতৃত্ব দিয়ে আসা প্যানাসনিক, শার্প, এনইসি, সনি, তোশিবা, হিটাচি’র মতো কোম্পানিগুলো ক্রমেই লোকশানের মুখে পড়ছে, কমে এসেছে উৎপাদন।

সর্বশেষ মিসুবুসি (অনেকেই মিৎসুবিসি উচ্চারণ করেন), সুজুকির মতো দুই অটোমোবাইল কোম্পানি চলতি মাসে ‘জ্বালানির দক্ষতা কেলেঙ্কারিতে’ পড়েছে। সমালোচনার মুখে বুধবার মিসুবুসি প্রেসিডেন্ট তেসুরো একাওয়া তার পদ থেকে সরে দাঁড়ান। একই দিনে ক্ষমা চেয়েছেন সুজিকির প্রধান নির্বাহী ওসামু সুজিকি।

জাপান ইলেকট্রনিক্স খাতে কেন এই অস্থিরতা? এই প্রশ্নে উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব বাজারে মন্দাভাব, জাপানের অভ্যন্তরীন বাজারে অস্তিরতা আর মানিয়ে নেওয়ার অভাব জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর আত্মহত্যার সামিল।

ফলে জাপানের সামসষ্টিক অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে। আর এর মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েকটি কোম্পানি রেলওয়ে, ব্যাংক, ইনসিওরেন্স ও মোবাইল ব্যবসায় নেমেছে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত জাপানের অর্থনীতি, ব্যবসা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাসিক (মার্চ) প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইলেকট্রনিক্স যোগাযোগ খাতে ৬ দশমিক ৮ ভাগ, বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরায় ২৯ দশমিক ১ ভাগ, কম্পিউটার সামগ্রীতে ৮ দশমিক ৪ এবং অটোমোবাইল খাতে ৬ দশমিক ৩ ভাগ কমেছে।

মালিকানা পরিবর্তনের হিড়িক

তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১২ সাল থেকে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ইয়েন লোকশানের মুখে থাকা বিশ্বের প্রথম এলইডি টিভির প্রতিষ্ঠাতা শার্প সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ ৩ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে তাওয়ানের ফক্সকন কর্তৃপক্ষ কাছে মালিকনা হস্তান্তর করে।

১৯১২ সালে বাণিজ্যিক শহর ওসাকার নারাতে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি ৬৬ ভাগ মালিকানা হস্তান্তর করলেও মার্চের সর্বশেষ হিসেবে ২৫০ বিলিয়ন ইয়েন লোকশান গুনেছে।

শার্প প্রেসিডেন্ট কজু তাকাশি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি রক্ষার লড়াই করে যাচ্ছিলাম। লোকশানের মধ্যে আমরা হুনহাইকে মালিকানা হস্তান্তর করেছি যাতে করে কোম্পানিটি নতুন প্রাণ পায়।

বেশ কয়েক বছর পর এবারই তোশিবার অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়টি গণমাধ্যমে খবর হয়ে উঠে। কর্মকর্তাদের সীমাহীন দূর্নীতির খেসারত দিতে গত বছরের শেষ দিকে প্রায় ৪৫৩ কোটি ডলার লোকশান গুনতে হয়।

এর মধ্যে তোশিবা ১৪ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করে। ৫৯০ কোটি ডলার এর বিনিময়ে জাপানী প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্যানন-এর কাছে তোশিবার মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকরণের শাখাটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এমনকি মিশর ও ইন্দোনেশিয়া কোম্পানিটির উৎপাদন কারখানার মালিকানাও পরিবর্তন হয়। সর্বশেষ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে সাতোশি সুনাকাওয়াকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে চীনের ‘মিডিয়াটেক গ্রুপে’ কাছে একটি প্লান্ট বিক্রি করে।

ওসাকায় অবস্থিত প্যানাসনিক কোম্পানি ২০১১ ও ২০১২ সালে ব্যাপক ব্যবসায়িক ক্ষতিতে পড়লেও তারা এখন মোবাইল, টেলিভিশনের স্থলে অটোমোবাইল কোম্পানির দিকে ঝুকেছে। কোম্পানিটির তথ্য অনুযায়ী, গাড়ি ব্যবসায় প্যানাসনিক বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।

অটোমোবাইলে কেলেঙ্কারি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন গাড়ি সরবরাহ করে থাকা মিসুবুসি ও সুজুকি কোম্পানি কেলেঙ্কারির মুখে পড়েছে। গত মাসে স্থানীয় একটি পত্রিকায় মিসুবুসি কোম্পানির ‘জ্বালানি দক্ষতা’ কারচুপির অভিযোগ উঠার পর আলোচনায় আসে।

১৯৯১ সাল থেকে নিশান ও মিসুবুসি মডেলের প্রায় ৬ লাখ গাড়ি ত্রুটি ধরার পর প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তার সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। চলতি সপ্তাহে কমিটি কোম্পানিটির কার্যালয় ঘুরে আসার পর বুধবার দুপুরে প্রেসিডেন্ট তেসুরো একাওয়া পদত্যাগের ঘোষণা দেয়।

অপরদিকে সুজুকির চার কর্মকর্তা তাদের গাড়ির জ্বালানির কর্মদক্ষতায় জালিয়াতিতে জড়িত বলে স্বীকার করে বুধবার সংবাদ সম্মলন করেন কোম্পানি কর্ণাধার ওসামু সুজুকি।

দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বে সুনামের সঙ্গে অটোমোবাইল ব্যবসা করে আসলেও প্রতিষ্ঠানটির ২১ লাখ গাড়িতে ত্রুটি পাওয়া যায় বলে জানান ওসামু সুজুকি।

তিনি বলেন, এটা মেনে নেয়া খুব কষ্টকর। প্রতারণা না হলেও এই ধরনের অভিযোগ কোম্পানির জন্য শুভ নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি এবং দেশবাসীর কাছে ক্ষমাও চান।

সমস্যার আড়ালে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি

সাম্প্রতিক সময়ে জাপানি মুদ্রার (ইয়েন) সঙ্গে মার্কিন ডলারের মূল্য হ্রাসে কোম্পানিগুলোর পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে বলে দাবী করছেন এর কর্তা ব্যক্তিরা। আর এই প্রেক্ষিতে সরকার গত ফেব্রুয়ারি মাসে হঠাৎ করে দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। ব্যাংকে ফেলে রাখা অর্থ ‘ঋনাত্বক’ সুদ ব্যবস্থা চালু করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বিওজে)। এর প্রেক্ষিত্রে গত মাসের শেষ থেকে ইয়েনের বিপরীতে ডলার মূল্য কমেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্বে অন্যন্য কোম্পানির মতো জাপানের জায়ান্ট ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যে বহুমাত্রিক আধুনিক প্রযুক্তি যোগ না করায় ক্রেতা হারাচ্ছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানি একই পণ্যে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা মেলে ধরলেও জাপান পারছে না বলে মনে করছেন দীর্ঘদিন ধরে একটি ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রকৌশলী হিয়াশু তাকানাকি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রযুক্তি বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে কোম্পানিগুলোর উচিত আধুনিক নতুন নতুন সুবিধা বাড়ানো। ক্রেতা আকর্ষণের জন্য ইলেট্রনিক্স সামগ্রীতে ডিজিটাল ভাবনার প্রতিফলন ফেলা উচিত।

ওছাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আসুসি ওসানায় বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি, স্যামসং ইলেট্রনিক্স বাজার ধরে ফেলছে। জাপান তাদের যন্ত্রপাতির মজবুতের অজুহাতে দাম কমাতে পারেনি। এটাও অন্যতম কারণ যে, ক্রেতারা বেশি দামে যন্ত্রপাতি কিনছে না। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি বাহিরেও স্বল্প খরচে উৎপাদন কৌশল ঠিক করা উচিত।

ক্যানন ও নিকন ক্যামেরার কোম্পানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসায় নেমেছে অটোমোবাইল কোম্পানি টয়েটা। একই সঙ্গে হিটাচি রেলওয়ে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। এই পরিবর্তনও বাজারে পড়ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রে বহুমাত্রিক ব্যবহার চালুর প্রতি জোর দিতে হবে বলে ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকটিক ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের এক অধ্যাপক জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অধ্যাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখনো যদি কেউ টেলিভিশন, ডিভিডি কিংবা ক্যামেরা তৈরি করতে থাতে তাহলে তো সেগুলো বিক্রি হবে না । মানুষ এখন একটি স্মার্ট ফোনে সব পাচ্ছে তাহলে কেন ওসব কিনতে যাবে?

এইসব চাহিদা একটি ডিভাইসেই পাওয়া সম্ভব এমন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করায় মনোনিবেশ করতে হবে। আর এজন্য কোম্পানিগুলোকে বেশি বেশি গবেষণা খাতে বরাদ্ধ রাখতে হবে মনে করেন এই অধ্যাপক।