‘জাতীয় দলকে ঢেলে সাজাতে হবে’

সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের ভরাডুবির রেশ কাটতে না কাটতে বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপেও ব্যর্থ বাংলাদেশ। বাজে পারফরম্যান্স, ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আর শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্তদের শাস্তির সুপারিশ- এসব নিয়ে এখন সরগরম ফুটবল অঙ্গন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ফুটবলে সব কিছু নতুন করে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2016, 05:39 AM
Updated : 9 Feb 2016, 05:40 AM

প্রশ্ন: সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়; এর পর বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপেও প্রত্যাশিত সাফল্য মেলেনি। দুটি আসরের ব্যর্থতায় ফুটবলারদের নিয়েও উঠেছে নানা অভিযোগ। জাতীয় দল নিয়ে এ মুহূর্তে আপনার ভাবনাটা কি?

সালাউদ্দিন: এখন আসলে আমাদেরকে নতুন করে সব কিছু ভাবতে হবে; নতুনদের নিয়ে ভাবতে হবে। সব কিছু নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। নতুন করে বলতে আমি বলতে চাইছি, যারা এখন আছে, তাদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বয়সভিত্তিক দলগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে কাজ শুরু করা। ক্লাবগুলোকেই এ জন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।

আমি কিছু খেলোয়াড়ের ওপর করা প্রতিবেদন দেখলাম। এটা খেলোয়াড়দের মান হতে পারে না। আরও কিছু সমস্যা আছে যেটা আগে বুঝিনি, এখন বুঝছি। একজন খেলোয়াড় ক্লাবের কাছে থাকে ১০ মাস; জাতীয় দলে দুই মাস। তাদের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় ক্লাব থেকে। আমার কোচ তো তাদের ১-২ মাস ট্রেনিং করায়। এখন ওদের মদ্যপান, গভীর রাতে ফেরা-এসব তো আমি নিয়ন্ত্রণ করি না। ওরা ক্লাবে থাকে। এখন চোখে পড়ছে এসব। আমরা এখন ক্লাবগুলাকে অনুরোধ করব এসব দেখতে।

ফুটবলারদের এরকম বিশৃঙ্খল হয়ে যাওয়ার কারণ কি?

সালাউদ্দিন:
ওদের বেশিরভাগই শিক্ষিত পরিবার থেকে আসেনি। ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো নয়। ওদের জন্য টাকার পরিমানটা বেশি হয়ে গেছে। যেটার জন্য তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। (বাইরের দেশের তুলনায়) আসলে এটা কোনো টাকাই না। কিন্তু ওদের জন্য অনেক। যে প্রতিবেদন আমি দেখলাম, এতটা বিশৃঙ্খল তো হতে পারে না।

শুধু আর্থিক দিক নয়, বর্তমান সময়ের ফুটবলাররা তো আপনাদের সময়ের তুলনায় সুযোগ-সুবিধাও বেশি পায়…

সালাউদ্দিন: দেখুন, একবার আমরা মালয়েশিয়া খেলতে গিয়েছিলাম; কিন্তু সেসময় আমাদেরকে আর কিছু তো দূরের কথা জুতা কিনে দেওয়া হয়নি। আমরা গিয়েই খেলতে নেমে পড়লাম; একটু বিশ্রামের সময়ও পেলাম না। অথচ এই দল অস্ট্রেলিয়া গেল (বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব খেলতে) মালয়েশিয়া ঘুরে, প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে; এরপর অস্ট্রেলিয়াতেও ম্যাচের অনেক আগে গেছে।

এরপর তাজিকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের কথাই ধরুন। সেখানে খুব ঠাণ্ডা; দলও গেল সপ্তাহখানেক আগে। তাদের আমি নামকরা হোটেলে রেখেছি। কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করেছি এই ফুটবলারদের পেছনে; কিন্তু ফলটা দেখুন ৫-০ গোলের হার!

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথটা কি জানা আছে আপনার?

সালাউদ্দিন: ক্লাবভিত্তিক একাডেমিগুলো যথাযথভাবে পরিচালিত হওয়ার দরকার। সব দলেরই দ্বিতীয় দলও থাকতে হবে। বড় দলগুলিই ধরুন, শেখ জামাল বা অন্য দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কিন্তু তারা নতুন কোনো ফুটবলারকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে খেলায়নি। সব বাইরে থেকে নেওয়া। সব বড় ক্লাব যদি (তাদের তৈরি করা) দুই-তিনটা ফুটবলার দেয়, তাহলেই তো জাতীয় দল হয়ে যায়।

ঢেলে সাজানোর আগে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই সাত ফুটবলার কি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে?

সালাউদ্দিন: অবশ্যই। তাদের অভিযোগ খণ্ডানোর সুযোগ না দিয়ে তো আর শাস্তি দেওয়া যাবে না। ন্যাশনাল টিমস কমিটি আছে; তারাই সুযোগটা দেবে।

ঘরোয়া লিগটাকে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে করার প্রচেষ্টা গতবার সফল হয়নি। এবার সে রকম উদ্যোগ নেওয়ার ভাবনা নিশ্চয় আছে?

সালাউদ্দিন:
আসলে এ ক্ষেত্রে ক্লাবগুলোকেও পুরোপুরি দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা দলের পেছনে টাকা খরচ করে। বাইরে খেলতে গেলে তাদের খরচ বাড়ে। এটা আবার আমরা পুরোপুরি দিতে পারি না। পরিকল্পনা আছে (হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে) কিন্তু আগেই তো বললাম, এর জন্য সমর্থনটাও (টাকা) দরকার।

টাকার সংস্থান তাহলে কিভাবে হবে?

সালাউদ্দিন: সরকার। আমি এরই মধ্যে ক্রীড়া মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। অবশ্যই জাতীয় বাজেটে (ফুটবলের জন্য) বরাদ্দ থাকতে হবে। আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা, এখানে-ওখানে খরচ হয়। ফুটবলও এই দেশের অংশ। ৫০ কোটি ১০০ কোটি টাকা বছরে যদি বাজেট থেকে ফুটবলকে দেয়, সেটাই ফুটবলের টিকে থাকার একমাত্র পথ।

যে লক্ষ্য নিয়ে আপনি সভাপতি হয়েছিলেন, এতদিনে তার কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয়? আর বাফুফের একাডেমির বর্তমান অবস্থা…

সালাউদ্দিন: দেখুন, এখানে পরিস্থিতিটা কঠিন, সহজ নয়। এটা নিয়ে বছরের পর বছর কাজ করতে হবে। চীনের দিকে দেখুন, সম্প্রতি প্রায় ৪৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ওদের চ্যাম্পিয়ন ক্লাব প্লেয়ার কিনেছে। তারপরও ওদের নাম শুনেছেন? প্রতিযোগিতা এখানে অনেক বেশি। চীন তো এশিয়াতেই সুবিধা করতে পারছে না।

একাডেমি নিয়ে সরকার, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উচিত আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। আমি তাদের বললাম, একাডেমিটা ঠিকঠাক না করলে অন্য খেলার উন্নতি হবে, ফুটবলের হবে না। কেননা, এটা বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক খেলা। আমরা চীনকে জানি, তারা অলিম্পিকে গোল্ড পায়; এশিয়ান গেমসে, জিমন্যাস্টিকসে তারা সেরা। কিন্তু ছয় মাস আগে তাদের প্রেসিডেন্ট ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে বসেছেন। বলেছেন, আমরা অনেক খেলা খেলি, অনেক ফেডারেশন কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের এখনও কেউ স্পোর্টিং নেশন হিসেবে চেনে না। কারণ ফুটবলে আমরা জিতি না। এটাই হলো খেলাটার গুরুত্ব।

বাংলাদেশে ‘পরিস্থিতিটা’ এত কঠিন মনে হওয়ার কারণ?

সালাউদ্দিন:
সাফল্য পাওয়ার আগের সমর্থনটা জরুরি। সাফল্য পেলে তো আর সমর্থন লাগবে না! গেটমানিই যথেষ্ট, যেটা আমাদের সময় ছিল। তাই সমর্থন দিতে হবে সাফল্য আনার জন্য এবং এটা বেসরকারি পর্যায় থেকে হবে না। ইউরোপে প্রচারস্বত্ব থেকেই বেশিরভাগ টাকা আসে। আমাদের এখানে খেলা-ই দেখায় না; এটা না দেখলে কারা বিজ্ঞাপন দেবে?

আমি টকশোতে অনেক কিছুই দেখি। অনেকে অনেক কথা বলে। অধিকাংশই বলেন আমাদের সাবেক ফুটবলাররা। চটুল কথাবার্তা; ফুটবলের উন্নতি করতে হলে ফুটবলারদের খাওয়াতে হবে, পড়াতে হবে, বড় করতে হবে, রাখতে হবে। আপনি যদি টক শোতে এই কথা বলতে পারেন, আমি ৪০ বছর ধরে পেশাদার ফুটবলে আছি, আমি জানি না? জানি তো! কিন্তু এটা করতে গেলে আমার যে জিনিসটা দরকার, সেটা কিন্তু কোনো সমালোচক বলে না। কেউ বলে না-আপনি ওখানে যান, গেলে এই টাকাটা পাবেন, পেলে ওই স্কুলকে দেন।

তারা সবাই কিন্তু এক সময় ক্ষমতায় ছিল, সবাই ব্যর্থ হয়েছে। আমি চেষ্টা করছি, লড়াই করছি। তাদের উচিত এসে আমার সহায়তা করা, আলোচনা করা। লোকের মাঝে হতাশা ছড়িয়ে দেওয়ার এই ব্যবসা বন্ধ করা উচিত। কিছু করতে পারলে আসেন। আমরা আপনাদের সুযোগ দেব।