‘মামলার কৌশলে’ বাড়ি ভেঙে জমি দখলের অভিযোগ

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় কৌশলে মামলা ও পরে আপস করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় নয় পরিবারের দীর্ঘদিনের বসতঘর ভেঙে জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ইলিয়াস আহমেদ ময়মনসিংহ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2017, 04:00 PM
Updated : 2 March 2017, 04:01 PM

এনায়েতপুর ইউনিয়নের দোলমা গ্রামের এসব পরিবার বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে দুই সপ্তাহ ধরে আশ্রয়হীন রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলেন, শত বছর ধরে তারা এ জমিতে পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসছেন। হঠাৎ তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে জমি দখল করেছে একটি পক্ষ।

ফুলবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ আদালতের নাজির আব্দুল হেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ওই গ্রামের এক খতিয়ানের একটি দাগের এক একর ১২ শতাংশ জমি নিয়ে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে।

ওই জমিতে বসবাস করছিলেন আবদুল করিমের সাত সন্তান সুরুজ মিয়া, খলিল মিয়া, আজিজুল হক, জামেলা খাতুন, চাঁন মিয়া, লাল মিয়া, ফজল মিয়াসহ নয়টি পরিবারের ৩৬ সদস্য।

নাজির হেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই জমিটিরই মালিকানা দাবি করে একই গ্রামের ফজলুল হকের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম ২০০৯ সালে মামলা দায়ের করেন নিজের দেবর নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

“মামলা শুরুর অল্প কদিন পরই বাদী-বিবাদী আদালতে আপসনামা দাখিল করেন। আপসনামার ভিত্তিতে বিবাদীকে তার বাড়িঘর ভেঙে নিতে আদেশ দেয় আদালত। আদেশ না মানলে আদালত আইন প্রয়োগকারীদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেয়।

“এরপর বিবাদী নজরুল আদেশ মানেননি জানিয়ে সুরাইয়া বেগম আদালতে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বাড়িগুলো ভাঙা হয়।”

নজরুলের বাড়ি বলে সুরাইয়ার দেখিয়ে দেওয়া বাড়িঘর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভেঙে দেয় বলে জানান হেলিম।

এদিকে, এসব বাড়ি বা জায়গা কোনোদিনই ওই মামলার বাদী বা বিবাদীর দখলে ছিল না বলে বসবাসকারীসহ স্থানীয়দের ভাষ্য।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একই গ্রামের বাসিন্দা কবির হোসেন তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমরা এখানে বসবাস করে আসছি। ওই জমি নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ ছিল না।

“এখানে আবদুল করিমের পরিবারকে আমি আমার ছেলেবেলা থেকে বসবাস করতে দেখেছি। তারপর থেকে তার ছেলেমেয়েরা উত্তরাধিকার সূত্রে বসবাস করছে। এখানে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও হয়নি। অন্য দুটি পক্ষের মধ্যে কী মামলা হলো, কী রায় হলো, আর কোন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী পরিবারগুলোর বাড়িঘর ভেঙে তাদের উচ্ছেদ করা হলো তা জানি না।”

উচ্ছেদ হওয়া সুরুজ মিয়ার অভিযোগ, “আমাদের জমি দখলের জন্য সুরাইয়া বেগম ও তার দেবর নজরুল যোগসাজশে নাটক করেছেন। নাটক হিসেবেই মামলা। নাটক বলেই আপসনামা। তার ফলে আদালত উচ্ছেদের আদেশ দিয়েছে।

“এসব বাড়িঘর বা জমিজমায় আদৌ ওই বাদী বা বিবাদীর কোনো অধিকার আছে কিনা, সেসব বিষয়ে আদালতের কোনো পর্যবেক্ষণ আমরা জানতে পারি নাই। ওই বাদী ও বিবাদীর মধ্যে মামলা চলছিল জানি, কিন্তু তা যে আমাদের উচ্ছেদের জন্য তা জানতে পারি নাই।”

সুরুজ মিয়ার ভাই খলিল মিয়া বলেন, “প্রায় শত বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এখানে বসবাস করে আসছে। হঠাৎ বাড়িঘর ভেঙে আমাদের পথে বসিয়ে দিল।”

দোলমা গ্রামের বাসিন্দা ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য আবুল কাশেম বলেন, সুরাইয়া বেগম ও নজরুল ইসলাম মামলা করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে ওই জমিটি দখল করেছেন বলে মনে হচ্ছে।

“যদি সত্যিই এমন হয় যে কৌশলে মামলা করে এটা করা হয়েছে তাহলে অপরাধের বিচার হওয়া উচিত। সর্বোপরি, কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এখানে বসবাস করা মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করা ঠিক হয়নি।”

এ বিষয়ে সুরাইয়া বেগমের ছেলে প্রকৌশলী রাসেল বলেন, “জমিটি আমাদের। আদালত সঠিক জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে।”

অন্যদিকে বিবাদী জামালপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলছেন, “অনেক দিন আগে আবদুল করিমের কাছ থেকে আমার বড় ভাই ফজলুল হক জমিটি ক্রয় করেন। পরে তাদের সেখানে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তারা জায়গা না ছাড়ায় মামলা করা হয়েছিল।”

এদিকে জমিটি বন বিভাগের বলে দাবি করছেন কর্মকর্তারা।

এনায়েতপুর বিটের বন কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই জমিটি একটি দাগের অন্তর্ভুক্ত। এই দাগে বন বিভাগের ৪৬ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক জমিই প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে।

“যাদের বাড়িঘর ভেঙে উচ্ছেদ করা হয়েছে সেটাও বন বিভাগের জমি।”

অপরদিকে গৃহহীনদের থাকার ব্যবস্থা করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিরা তরফদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গৃহহীনদের আপাতত দোলমা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের একটি রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরে তাদের জন্য স্থায়ীভাবে কিছু একটা করা হবে।

তবে ওইসব পরিবারের সদস্যরা সেখানে যেতে রাজি হননি। তারা খোলা জায়গাতেই আছেন।