আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অঙ্গীকার রক্ষা না করার অভিযোগ তুলে সংকট উত্তরণে সরকার ও সব পক্ষের সামনে সাত দফা প্রস্তাব দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
Published : 31 Dec 2014, 05:32 PM
তার এই প্রস্তাবের মূল বক্তব্য হল ‘নির্দলীয়’ সরকারের অধীনে অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচন করা, যে সরকার হবে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের’ সম্মতির ভিত্তিতে।
এই সাত দফা দাবিতে ‘জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার’ অঙ্গীকার ঘোষণা করে তাতে যোগ দিতে সব গণতান্ত্রিক দল, শক্তি ও ব্যক্তিকে শরিক হওয়ারও আহ্বানও জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
“আমি বিশ্বাস করি, আগামী বছর হবে জনগণের বিজয়ের বছর,” বছরের শেষ দিন বুধবার আকস্মিকভাবে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন তিনি।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিনটি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
তার প্রস্তাবগুলো হলো-
১. জাতীয় নির্বাচন ‘অবশ্যই’ নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে।
২. নির্বাচন ঘোষণার আগেই প্রতিদ্বন্দ্বী সব পক্ষের সম্মতিতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে বর্তমান আরপিও সংশোধন করা যায়।
৩. নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হবে এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর সম্মতিতে গঠিত’ নির্দলীয় সরকার দায়িত্ব নেবে।
৪. ভোটের তারিখ ঘোষণার পর সারা দেশে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
৫. সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানোর পাশাপাশি ‘চিহ্নিত ও বিতর্কিত’ ব্যক্তিদের প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করতে হবে।
৬. সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে এবং রাজনৈতিক নেতাদের নামে থাকা ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৭. এ সরকারের সময়ে ‘বন্ধ করে দেওয়া’ সব সংবাদপত্রে ও টেলিভিশন খুলে দিতে হবে এবং আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ আটক সব সাংবাদিককে মুক্তি দিতে হবে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আওয়ামী লীগের প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই নির্বাচন সংক্রান্ত এই সাত দফা উত্থাপন করে খালেদা বলেন, “আমরা এই প্রস্তাবনা মেনে নিয়ে জাতীয় সংকট নিরসনের আহ্বান জানাচ্ছি। এ বিষয়ে আমরা জনমত গঠনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণা করছি।”
সব পক্ষকে ‘এক প্ল্যাটফর্মে এসে’ অথবা ‘নিজ নিজ অবস্থানে থেকে’ এ আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আপনারা অগ্রাধিকার কোনটিকে দিচ্ছেন আলোচনা না আন্দোলন- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে খালেদা বলেন, “আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। এটা নিয়ে কথা বলতে হবে। সরকার চাইলে আলোচনা হতে পারে। আমরা কোনো সময়সীমা দিচ্ছি না। আমরা চাই অতিদ্রুত নির্বাচন।”
এই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই সরকার অবৈধ। তারপরও আলোচনা তো ওদের সঙ্গে করতে হবে।”
বর্তমান সংবিধানের অধীনে সরকার নির্বাচন দিলে সেক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী হবে- জানতে চাইলে খালেদা বলেন, “আমরা তো বলেছি, আগামী নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনেই।”
“সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতেই হবে। তারা (সরকার) জোর করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে আছে। আমরা মনে করি, আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছি, তা যুক্তিযুক্ত।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ছাড়াও ২০ দলীয় জোটের শীর্ষনেতারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মাহবুবুর রহমান, আসম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, জমিরউদ্দিন সরকার, সারোয়ারি রহমান, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, শওকত মাহমুদ, মারুফ কামাল খান।
২০ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে ছিলেন অলি আহমদ, আবদুল লতিফ নেজামী, রিদওয়ান উল্লাহ শাহিদী, মোস্তফা জামাল হায়দার, সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, শফিউল আলম প্রধান, আহমেদ আবদুল কাদের, আবদুল মোবিন, ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, জেবেল রহমান গানি, এএইচএম কামরুজ্জামান খান, গরীবে নেওয়াজ, আজহারুল ইসলাম, সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, সাঈদ আহমেদ, মহিউদ্দিন ইকরাম, মঞ্জুর হোসেন ঈসা।
‘অঙ্গীকার রাখেনি’ আওয়ামী লীগ
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সংবিধান রক্ষার কথা বলে পরে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা না রাখায় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন খালেদা।
“তারা বলেছিল, সাংবিধানিক প্রয়োজনে না কি ৫ জানুযারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করতে হয়েছে এবং খুব শিগগিরই আলাপ-আলোচনার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তারপর একটি বছর পেরিয়ে গেছে। নিজেদের দেওয়া অঙ্গীকারও এখন আর আওয়ামী লীগ মানছে না।”
এক বছরেও প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হওয়ায় এখন আন্দোলন ছাড়া বিএনপির বিকল্প নেই বলে দাবি করেন খালেদা।
“জনগণ নির্বাচনের জন্য সরকারকে এক বছর সময় দিয়েছে। তাই বিএনপিও এতদিন কিছু বলেনি। দেশ আজ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে, এ অবস্থার অবসান ঘটানো না গেলে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক এই সংকট উত্তরণে অবিলম্বে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগনের সম্মতির ভিত্তিতে সরকার গঠনের কোনো বিকল্প নেই।”
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় আলোচনায় দ্রুততম সময়ে আরেকটি নির্বাচনের বিষয়ে মতৈক্য দুই দলের মধ্যে হয়েছে কি না- জানতে চাইলে খালেদা বলেন, “না, কোনো অঙ্গীকার হয়নি।
“তবে তারা (আওয়ামী লীগ) প্রকাশ্যেই বলেছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য নির্বাচন করছে। জাতিসংঘের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল তারাংকোর মধ্যস্থতায় সংলাপে তারাংকো বলেছিলেন, সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি ইনক্লুসিভ ইলেকশন করতে হবে।”
লিখিত বক্তব্যে খালেদা সরকারের ‘অপশাসন, দলীয়করণ, দমন-পীড়নের’ চিত্র তুলে ধরেন।
“দেশে আজ গণতন্ত্র নেই, সবখানে অস্বাভাবিক অবস্থা। সকলেই আজ জীবন, সম্পদ, সম্মান ও নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। কাজেই এবারের সংগ্রাম কেবল বিএনপিসহ ২০ দলের নয়, দেশের দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানুষের।”
বিএনপি ‘সুসংগঠিত’
বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের প্রশ্ন তোলার জবাবে খালেদা বলেন, তার দল ‘সুসংগঠিত’।
“বিএনপি একটি বিশাল দল। সাংগঠনিকভাবেও আমাদের দল আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। গত ৫ জানুয়ারির আন্দোলনে আমরা তা প্রমাণ করেছি। বিএনপি একটি সুসংগঠিত দল, আন্দোলনেরও দল।”
বিভিন্ন কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের না থাকায় তৃণমূলে হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, “যারা বলছেন, বিএনপিতে তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা ও আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিকভাবে প্রস্তত নয়, এটা ঠিক নয়। আন্দোলনের কর্মসূচিতে নেতারা মাঠে থাকেন না, এটা ঠিক নয়। সরকারের এজেন্টরা এটা অপপ্রচার করে থাকে।”
এবার আন্দোলনে রাজপথে থাকবেন জানিয়ে খালেদা বলেন, “আমি সব সময় জনগণের কাতারে আছি। রাজপথে সময়মতো আমাকে পাবেন।”
উত্থাপিত প্রস্তাবে রাজবন্দির মুক্তির ভেতরে যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিষয়টি রয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা রাজবন্দির কথা বলেছি। যারা অপরাধ করে শাস্তি পেয়েছে, তারা তো আলাদা।”
তবে যুদ্ধাপরধের বিচারের প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “আমরা সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিক মানের বিচারের কথা বলেছি। অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।”
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জামায়াতের সঙ্গে তারা (আওয়ামী লীগ) ও আন্দোলন করেছে। ১৯৮৬ সালে তারা একসঙ্গে নির্বাচনও করেছিল।
“তখন তো আপনারা (গণমাধ্যম) কোনো প্রশ্ন করেননি। আমাদের ২০ দলের জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও আরও অনেক দল আছে।”