পৌর ভোটে ধানের শীষের ভরাডুবি

সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর আন্দোলন চালিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে ব্যর্থ বিএনপি পৌরসভা নির্বাচনে এসে ভরাডুবির মুখে পড়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Dec 2015, 06:30 PM
Updated : 30 Dec 2015, 08:52 PM

বিক্ষিপ্ত সহিংসতায় একজন নিহত এবং বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র দখলের অভিযোগের মধ্যে বুধবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে মেয়র পদে অধিকাংশটিতে জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। 

২৩৪ পৌরসভার মধ্যে রাত ২টা পর্যন্ত ২২৭টির ফল পাওয়া গেছে। এতে নৌকা প্রতীক জিতেছে ১৭৭টিতে, বিএনপির প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জয় পেয়েছেন ২২টিতে।

স্থানীয় সরকারের এই ভোটে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ বিএনপি করলেও নির্বাচন কমিশন বলছে, ‘বিচ্ছিন্ন’ কিছু ঘটনা ছাড়া নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। আওয়ামী লীগও ভোট নিয়ে সন্তোষ জানিয়েছে।

স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের পর এবারই প্রথম বাংলাদেশে দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচন হল, যাতে সংসদ নির্বাচনের মতোই মেয়র প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।   

দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় সাত বছর পর নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের লড়াই নিয়ে দেশবাসীর মধ্যেও আগ্রহ ছিল এই পৌর নির্বাচন ঘিরে।

বাংলাদেশের মোট ভোটারের মাত্র ৭ শতাংশের অংশগ্রহণ এই নির্বাচনে থাকলেও সবগুলো জেলায় ভোট হওয়ায় তা মর্যাদার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের তৎপরতায়।

বিএনপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনকারী আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে দেখেছিল সরকারের কাজের প্রতি জনগণের সমর্থন প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে।

অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসা বিএনপির কাছে এই নির্বাচন ছিল ‘আন্দোলনের অংশ’। অর্থাৎ এই ভোটে জয়ী হলে তারা বলতে পারত, তাদের দাবির প্রতি রয়েছে জনগণের সমর্থন।

ভোট গণনায় যখন পরাজয়ের আভাস মিলছিল, তখন বিএনপির  দল ও জোটের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন খালেদা জিয়া। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিক্রিয়া ও কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।

তবে ভোট শেষের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, ২০০টি পৌরসভায় কেন্দ্র দখল করে ক্ষমতাসীনরা নির্বিচারে সিল মেরেছে ব্যালটে।

“সরকারের নীলনকশা অনুযায়ী আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। আমারা যে আশঙ্কা করেছিলাম, তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।”

নরসিংদী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটচিত্র

অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বিএনপিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকার জন্য।

“বিএনপি এই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকবে কিনা এ নিয়ে জনমনে শঙ্কা বিরাজ করছিল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শেষ পর্যন্ত থাকার জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ জানাই।”

নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর এই বছরের এপ্রিলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এলেও ভোটগ্রহণের মাঝ পথে সরে দাঁড়িয়েছিল বিএনপি।

তার আগে বছরের শুরুতে তিন মাস সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেছিল তারা, যাতে ব্যাপক নাশকতা হয় এবং সেসব মামলায় বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্বসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাজার হাজার নেতাকে আসামি হতে হয়। 

তার আট মাস পর পৌর নির্বাচনে অংশ নিলেও শুরু থেকে নানা অভিযোগ জানিয়ে আসে দলটি, যার মধ্য দিয়ে সাত বছর পর কোনো নির্বাচনে ব্যালটে স্থান করে নেয় নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর দুবার জাতীয় নির্বাচনে জয়ী ধানের শীষ প্রতীক।

সব পৌরসভায় একজন করে মেয়র, সংরক্ষিত ৭৩১টি ও সাধারণ কাউন্সিলরের ২ হাজার ১৯৩টি পদের এই নির্বাচনে অংশ নেন ১২ হাজার প্রার্থী। এর মধ্যে ২২২টিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা মুখোমুখি লড়াইয়ে ছিলেন।

সাতটি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। ফলে বুধবার ২২৭টি পৌরসভায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছিল, এর মধ্যে গোলযোগের কারণে মাধবদী পৌরসভায় ভোট স্থগিত হয়ে যায়।

মাধবদীর ফজলুল করিম কিন্ডার গার্টেন কেন্দ্রে ভাংচুর হয়

নীলফামারীতে ভেঙে ফেলা ব্যালট বাক্স

এছাড়া চৌমুহনীর ১০টি, ঠাকুরগাঁওয়ের তিনটি, সৈয়দপুরে চারটি, উলিপুরের দুটি,কালকিনির দুটি,বরুড়ার একটি, চন্দনাইশের তিনটি, ভালুকার একটি, জামালপুরের তিনটি, কালিয়ার একটি, কুয়াকাটার একটি, সরিষাবাড়ীর একটি, নগরকান্দার একটি, মতলবের একটি, শরীয়তপুরের একটি, বরগুনার একটি, বেতাগীর একটি, যশোরের একটি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত হয়ে যায়।

কেন্দ্র স্থগিত হওয়ায় চৌমুহনী, ঠাকুরগাঁও, সৈয়দপুর, উলিপুর, কালকিনি, বেতাগীতে ফল আটকে আছে।  

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতারগুলোসহ ঘোষিত ২২৫টির ফলাফলে দেখা যায়,২৭টি পৌরসভায় মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী। বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছেন দুটিতে।

এছাড়া নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামায়াতে ইসলামীর দুই নেতা মো. হানিফ ও নজরুল ইসলাম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভায়।

২০টি রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, তার মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে শুধু জাতীয় পার্টির এক প্রার্থী আব্দুর রহমান মিয়া কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন।

৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ জন ভোটারের মধ্যে কতজন শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে গিয়ে তাদের মতামত দিয়েছেন, সে তথ্য জানাতে পারেনি ইসি। সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, সব কেন্দ্রের তথ্য আসার পর তা বলতে পারবেন।

সীতাকুণ্ড পৌরসভায় বিজিবির টহল

সকালে নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার একটি কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটে। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে হামলা ও বোমাবাজিও হয়। পরে বিকালে ওই পৌরসভার ভোট স্থগিতের কথা জানায় ইসি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্যের পাহারার মধ্যে আরও অন্তত ২০টি পৌরসভায় বিভিন্ন কেন্দ্রে গোলযোগ হয়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভায় ভোটে কেন্দ্রের দেড় কিলোমিটার দূরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন একজন।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল, এজেন্টদের বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিভিন্ন স্থানে বিএনপি মেয়র প্রার্থী নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।

বরগুনায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীও ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। ওই পৌরসভায় শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন, যিনি আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী।

২০১১ সালে চার ধাপে আড়াই শতাধিক পৌরসভায় নির্দলীয় ভোটে প্রার্থীরা দলের সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিজয়ী মেয়র প্রার্থী ছিলেন প্রায় সমান-সমান।

কিন্তু এবার পাল্লা আওয়ামী লীগের দিকে অনেক ঝুঁকে গেল।