নওশাবা, অমিত, খিজিরের প্রতিরুদ্ধ'

সিনেমাতে তিন মুখ্য চরিত্রের একটিতে নিজেই অভিনয় করছেন। অন্য দুই চরিত্রে রয়েছে রয়েছে নবাগত অমিত সিনহা ও ‘উধাও’ খ্যাত কাজী নওশাবা আহমেদ। নিজের দ্বিতীয় সিনেমা ‘জাগো’র ব্যর্থতার পর দেশ ছেড়েছিলেন পরিচালক খিজির হায়াৎ খান । চার বছর পর ফিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তার তৃতীয় সিনেমা ‘প্রতিরুদ্ধ’ নির্মাণের কাজে।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 May 2015, 07:28 AM
Updated : 1 May 2015, 07:28 AM

সম্প্রতি গ্লিটজের সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলেন ‘প্রতিরুদ্ধ’-এর কেন্দ্রীয় তিন চরিত্র।  

গ্লিটজ: সাক্ষাৎকার পর্বের শুরু হোক ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ খিজির হায়াৎ খানকে দিয়ে। ২০১০- এ ‘জাগো’ নির্মাণের পর হুট করে হারিয়ে গেলেন কেন?

খিজির হায়াৎ: সত্যি আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ লুকানোর কিছু নাই। ‘জাগো’ ছিল সে বছরের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি যখন আমরা প্রদর্শন করতে যাই, তখন আমরা নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হই। তখন তো ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ছিলো না। এত টাকা খরচ করে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খেলার সিনেমা বানিয়েছিলাম। ভালো-খারাপ ‍যাই হোক, দর্শককে তো সিনেমাটি দেখাতে হবে। কিন্তু হলমালিক ও প্রদর্শকদের ঘেরাটোপে আমরা তা পারিনি। নয় মাস গর্ভধারণের পর একটি বাচ্চা প্রসবের কদিন পরে মারা গেলে  যেমন অবস্থা হয়, আমার অবস্থাও ঠিক তেমনই ছিলো। চোখের সামনে আমার বাচ্চাটি মারা গেলো। আমার অবস্থা তখন কেমন হবে! আমরা সত্যিই হল পাচ্ছিলাম না।

গ্লিটজ: কাকরাইল পাড়া কি বলছিলো তখন?

খিজির হায়াৎ: এটা সবাই জানে, আমাদের দেশের সিনেমা মুক্তি পায় একটি ঘরানার মাধ্যমে। ঘরানাটির নাম সবাই জানে। আমি এমন কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার মধ্যে ছিলাম না। আমি একজন স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ‘জাগো’ নির্মাণ করেছিলাম। বুকিং এজেন্ট, হলমালিক সবার এক কথা-সিনেমাটি ঠিক ফরম্যাটেড না। ওদের ভাষায় ফরম্যাটেড সিনেমার সংজ্ঞা হলো "সিনেমাতে শাকিব খান থাকতে হবে। তাহলে তারা সিনেমা হলে লগ্নি করা টাকা উঠিয়ে আনতে পারবে।” আমরা এখনও হলমালিক ও বুকিং এজেন্টদের এই ধারণাটি বদলাতে পারিনি।

গ্লিটজ: শুধুই কি হতাশা নাকি অন্য কোনো কারণ ছিলো কানাডা চলে যাওয়ার পেছনে?

খিজির হায়াৎ : আমি কোনো চলচ্চিত্রকারের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করিনি। সিনেমা নিয়ে এত পড়াশোনাও ছিলো না আমার। ‘জাগো’ বানাতে গিয়ে মনে হয়েছিলো কোথায় যেন আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি মানুষের উপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম। নিজের এই সীমাবদ্ধতাগুলো আমি খুঁজে বের করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো আমাকে আরও বেশি তৈরি হতে হবে। আমি তখন কানাডার ভ্যাংকুভারে মাস্টার্স ইন ডিজিটাল মিডিয়া অ্যান্ড কনসেনট্রেশন ইন ফিল্ম মেকিং- কোর্সে ভর্তি হলাম। মাস্টার্স শেষ করে আমি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে ফিরে আসি।

গ্লিটজ: নতুন এ সিনেমাটির পরিকল্পনা শুরু করলেন কবে? আর ‘প্রতিরুদ্ধ’ - এই নামটির পেছনের গল্প কি?

খিজির হায়াৎ: কানাডা চলে যাওয়ার পরও আমি স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। পরিকল্পনা ছিলো দেশে ফিরে আবারও চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো। ‘জাগো’ সিনেমাটি আমি দর্শকের জন্য নির্মাণ করেছিলাম। কিন্তু দর্শককে দেখাতে পারিনি। ‘প্রতিরুদ্ধ’ সিনেমাটির আগে বেশ কটি টপিক নিয়ে আমি ভেবেছি। অনেক চিন্তা করে ঠিক করলাম আমাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার গল্প নিয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করবো। ন্যায়বিচার না পেয়ে মেধাবী তরুণদের হারিয়ে যাওয়ার বাস্তব কাহিনিটি আমার মাথায় ঘুরছিলো। আমি উত্তর খুঁজছিলাম এর জন্য আসলে দায়ী কে, আমাদের সমাজব্যবস্থা-পারিপার্শ্বিকতা-নাকি সমসাময়িক নানা প্রেক্ষাপট? ন্যায়বিচার অবরুদ্ধ হওয়ার কাহিনি নিয়ে গল্পটির নাম তাই ‘প্রতিরুদ্ধ’।

গ্লিটজ: ‘জাগো’র চিত্রনাট্য আপনি নিজে লিখলেও এবার সাকিব রায়হান লিখছেন...

খিজির হায়াৎ: ‘জাগো’ বানানোর পর আমি বুঝলাম আমি আসলে ভালো চিত্রনাট্যকার নই। খুব অলস প্রকৃতির আমি। সাকিব রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অনেক আগেই। তার তিনটি উপন্যাসও বের হয়েছে। ‘প্রতিরুদ্ধ'-এর গল্পে একজন আর্মি অফিসারের চরিত্র রয়েছে।

সেনাবাহিনির বেশ কিছু অপারেশনের গল্পও থাকছে এই সিনেমাতে। সে নিজেও প্রায় পনের বছর আর্মিতে ছিলো। তাকে গল্পের প্লট বলতেই বুঝে নিলো কি লিখতে হবে।

গ্লিটজ: ‘প্রতিরুদ্ধ’ ঠিক কোন ধাঁচের সিনেমা হতে যাচ্ছে? অ্যাকশনে নাকি খুব জোর দিচ্ছেন?

খিজির হায়াৎ: অ্যাকশন-রোমান্টিক ঘরানার সিনেমা হবে ‘প্রতিরুদ্ধ’। হ্যাঁ, এটা সত্যি আমি অ্যাকশনে খুব জোর দিচ্ছি। ইসরায়েলি ক্রাব মাগা অ্যাকশন থাকছে সিনেমাটিতে। আমি আর অমিত দুজনেই ট্রেনিং নিচ্ছি।

গ্লিটজ: এবার আসি সিনেমার কলাকুশলীদের ব্যাপারে। আপনার কামব্যাক সিনেমার মুখ্য চরিত্রে নতুন মুখ। ব্যাপারটি ঝুঁকির হয়ে গেলো না?

খিজির হায়াৎ: অমিতের ব্যাপারটি বলি। আমার সিনেমার ‘হায়দার’ চরিত্রের জন্য রাফ অ্যান্ড টাফ লুকের একটি মুখ দরকার ছিলো। ঢাকাই সিনেমার নিয়মিতদের ব্যাপারে যে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু আমার সিনেমার জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার, তার জন্য প্রচুর সময় দরকার। নিয়মিত তারকাদের এত সময় কোথায়? ব্যাপারটি তাদের ক্যারিয়ারের জন্যেও সমস্যার। অমিতের সঙ্গে ‘জাগো’র পর থেকেই যোগাযোগ ছিলো। ‘প্রতিরুদ্ধ’-এর জন্য যে সময়টুকু দরকার সে কিন্তু সে সময়টুকু দিচ্ছে। প্রথম সিনেমার প্রতি ওর দরদ দেখে সত্যিই অভিভূত আমি।

‘জাগো’ নির্মাণের পর আমার সঙ্গে নওশাবারও যোগাযোগ ছিলো। তার সঙ্গে একটি বড় প্রজেক্ট করার কথা ছিলো আমার। কিন্তু সেটা করা হয়নি। গণজাগরণ মঞ্চ যখন ভেস্তে গেলো তখন আমার ‘বাংলাদেশ পিএসএ’ নামে একটি প্রজেক্ট বানিয়েছিলাম। তখন আমি নওশাবাকে সোনিতা চরিত্রের জন্য ভাবছিলাম। নওশাবাকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেলো।

আর তাহের চরিত্রটিতে আমি নিজে অভিনয় করছি কারণ এ চরিত্রের জন্য নতুন কাউকে তৈরি করা আমার জন্য সময়সাপেক্ষ ও সত্যিই ঝুঁকির ব্যাপার। বিপ্লবী চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার তা আমার মধ্যে ছিলো। ‘জাগো’ আর ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ দুটিতে আমি অভিনয় করেছি। নিজের অভিনয় নিয়ে আত্মবিশ্বাস ছিলো। 

গ্লিটজ: সিনেমাতে আপনি হায়দার চরিত্রের মাধ্যমে সেনাবাহিনির ভুমিকা ফুটিয়ে তুলছেন, সেন্সর নীতিমালার বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন….

খিজির হায়াৎ:  সিনেমাতে একটি ইন্টারোগেশন সিন ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সেন্সর নীতিমালার কথা ভেবে দৃশ্যটি বাদ দিতে হয়েছে। ব্যাপারটি সত্যি বিরক্তিকর। আর সেন্সর বোর্ডের কথা বলছেন তো, প্রায় অশালীন সিনেমাকে সেন্সর দিয়ে দিচ্ছে। তখন সমস্যা হচ্ছে না। ওদের ব্যাপারে কী বলবো বলুন তো!

গ্লিটজ: এ সিনেমাতে তো আপনি নিজেই প্রযোজক…

খিজির হায়াৎ: আমি আসলে যেভাবে সিনেমা বানাতে চাই, সেটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আগেই বলেছি সিনেমাটি আমি আমার নিজের জন্য বানাতে চাই। প্রযোজক থাকা মানেই তো টাকা ফেরতের টেনশন। এত টেনশন নিয়ে কি সিনেমা বানানো যায়!

গ্লিটজ: আসছি অমিতের কাছে। অমিত এটা আপনার প্রথম চলচ্চিত্র। খিজির হায়াৎ খান আপনার স্কুলবেলার বন্ধু। তো বন্ধুকে পরিচালক হিসেবে কেমন দেখছেন?

অমিত: শুরুতে বলি, চলচ্চিত্রে অভিনয় করবো এমন কোনো ভাবনা ছিলো না আমার।  ২০১৩ তে খিজির দেশে ফেরার পর আমার সঙ্গে দেখা করে।  আমি তখন র‌্যাম্পে কাজ করছি। একটি নাটকেও কাজ করেছিলাম। খিজির আমাকে একদিন হায়দার চরিত্রের কথা বললো। আমি এক বাক্যেই রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু শুটিং করতে গিয়ে বুঝেছি আমি কোথায় এসেছি। সিনেমা চাট্টিখানি কথা নয়। এখানে অ্যাকশন আর মাসল দেখানোই সবকিছু নয়। অভিনয়ও জানতে হয়। খিজির সে কাজটি করছে। আমার ট্রেনিংয়ের বন্দোবস্ত করেছে। অভিনয়টা বের করে নিতে পারে সে।

গ্লিটজ : পেশাগত জীবনে আপনি একজন চিকিৎসক। এত ব্যস্ততার পরও কিভাবে আপনি চলচ্চিত্রে সময় দিচ্ছেন?

অমিত: চিকিৎসা আমার পেশা। আর মিডিয়া আমার প্যাশন। মিডিয়ার প্রতি আমার অন্যরকম একটি টান আছে। এই প্যাশনের জন্য পেশাগত ক্ষেত্রে কিছু তো ছাড় দিতেই হয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার আমি কাজ শেষে কুমিল্লা থেকে বাসে চড়ে ঢাকায় আসছি। আবার রোববার ভোরে আমার কর্মস্থল কুমিল্লায় যাচ্ছি। 

গ্লিটজ : অভিনয় নিয়ে সত্যি সিরিয়াস হবেন?

অমিত: ‘প্রতিরুদ্ধ’ শেষ হোক। তারপর বলতে পারবো।

গ্লিটজ: নওশাবা, এটিই সেভাবে দেখলে আপনার প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র। সোনিতা চরিত্রটি নিয়ে কিছু বলুন।

নওশাবা: সোনিতা চরিত্রটি আমার স্বপ্নের চরিত্র। পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বলতে যা বোঝায় এখানে ঠিক সেভাবেই চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘উধাও’ সিনেমার নন গ্ল্যামারাস নওশাবা এখানে ভীষণ গ্ল্যামারাস একটি চরিত্রে অভিনয় করছে। সোনিতা চরিত্রটি ভীষণ সাদাসিধে, তার কোনো উচ্চাভিলাস নেই। সে চায় স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করতে। কিন্তু কোনো এক ঘটনায় তার স্বামী তাহের হয়ে ওঠে বিপ্লবী। বিপ্লবী তাহের ঘরছাড়া হলে সোনিতার সঙ্গে সখ্যতা হয় মেজর হায়দারের। দুই নায়কের বিপরীতে অভিনয় ব্যাপারটি কিন্তু বেশ উপভোগ্য।

গ্লিটজ: শোনা যাচ্ছে, এই সিনেমার আরেক নারী চরিত্র শিলা সেনগুপ্তর জন্যও আপনাকে অডিশন দিতে হয়েছিলো…

নওশাবা: সে আর বলতে! অডিশনের দিন খিজির হঠাৎ বলে বসলো- ‘তুমি একটু শিলার ক্যারাক্টার করে দেখাও তো!’ কী আর করা। আমাকে কস্টিউম পাল্টে শিলার চরিত্রটিও করে দেখাতে হলো।

গ্লিটজ: প্রশ্ন খিজির হায়াতের কাছে। সিনেমার শুটিং কতদূর?

খিজির: ২৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন। খুব শিগগিরই আবার কাজ শুরু করবো। আমরা এমন একটি দেশ খুঁজছি যেখানে কখনও সিনেমার শুটিং হয়নি। তবে সেটা এশিয়ার মধ্যে। এখন সিনেমার গানগুলোর কাজ চলছে।
 

ছবি:  জয়ন্ত সাহা, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম