'উনিশে এপ্রিল': সম্পর্কের বৈশাখী ঝড়

খ্যাতিমান এক নৃত্যশিল্পী উচ্চ পর্যায়ের একটি সম্মাননা পেলেন। সদ্য ডাক্তারি পাশ করে মেয়ে ফিরলো মায়ের কাছে। মা-মেয়ের সুখের আলাপন আর আনন্দ অশ্রুতে মুখর হওয়ার বদলে উস্কে উঠতে শুরু করলো দ্বন্দের আগুন। দুজনের মনের আকাশে দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা মেঘ যেন কালবৈশাখীর রূপ পেতে চাইলো। কথা হচ্ছে, ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’ সিনেমাটি নিয়ে।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2015, 10:03 AM
Updated : 19 April 2015, 04:04 PM

১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির টাইটেল ওঠার আগেই খণ্ড খণ্ড দৃশ্যে দেখা যায় হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটাকের ফলে ডা. মনীষের মৃত্যু হয় গভীর রাতে। সে সময় তার পাশে ছিল আট বছরের মেয়ে অদিতি। স্ত্রী সরোজিনী ছিলেন মাদ্রাজে।

টাইটেলের পর ছবি শুরু হতে দেখা গেল, মনীষের মৃত্যুর পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। ডাক্তারি পাশ করে দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরেছে অদিতি। ১৯ এপ্রিল তার বাবা মনীষের মৃত্যুবার্ষিকী। কিন্তু মা সরোজিনীর সে কথা মনে নেই। সেদিন ভোরেই তিনি খবর পেয়েছেন যে,  মর্যাদাময় এক সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। বাড়িতে খবরের কাগজ, টিভির সাংবাদিকদের ভিড়। সেসব সামলাচ্ছেন সরোজিনীর বন্ধু সোমনাথ। অন্যদিকে মায়ের প্রতি নিঃস্পৃহ অদিতি অপেক্ষা করছে তার প্রেমিক সুদীপের ফোনের। অদিতি ছোটবেলা থেকে তার মাকে অপছন্দ করে। কারণ ব্যস্ত মায়ের কাছে নিজেকে উপেক্ষিত মনে হয়েছে তার। মায়ের চেয়ে বরং গৃহকর্মী বেলা তার বেশি আপন।

সুদীপকে বিয়ে করে সংসারী হতে চায় অদিতি। সুদীপকে সে এতটাই ভালোবাসে যে তার জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতেও তার আপত্তি নেই। অনেক প্রতীক্ষার পর সুদীপের ফোন আসে। কিন্তু সে জানায়  অদিতির মা যে একজন নৃত্যশিল্পী তা সে আজই জানতে পেরেছে। নৃত্যশিল্পীর মেয়ের সঙ্গে বিয়েতে তার পরিবার রাজি নয়,তাই সম্পর্কটা ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হচ্ছে সে।

প্রচণ্ড কষ্টে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করে অদিতি। কিন্তু এই কষ্টের কথা সে জানতে দেয় না কাউকে। এদিকে সাফল্যে আনন্দিত সরোজিনী মাদ্রাজ রওনা হয় তার গুরুকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে থাকে বন্ধু সোমনাথ। সোমনাথ সরোজিনীর দীর্ঘ দিনের প্রেমিক ও বন্ধু।

মা চলে গেলে পর অদিতি সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যার। বেলাকে ছুটি দেয় এক দিনের জন্য। বাবার মৃত্যুর দিনটাকেই সে বেছে নেয় নিজের মৃত্যুর দিন হিসেবে। ঠিক সে সময় শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়। প্লেন ধরতে না পেরে বাড়ি ফিরে আসে সরোজিনী।

বেলাকে ছুটি দেওয়ায় অদিতির উপর বিরক্ত হয় সে। বিদ্যুৎহীন বাড়িতে দুজনের টুকরো আলাপচারিতা চলতে থাকে রান্নার ফাঁকে। অদিতির ঘরে গিয়ে  আকষ্মিকভাবে সরোজিনী আবিস্কার করে তার সুইসাইড নোট এবং ঘুমের ওষুধ।প্রবল এক আতংকে সরোজিনী উপলব্ধি করে আরেকটু হলেই কি ভয়াবহ সর্বনাশ হয়ে যেতে পারতো।

দীর্ঘ দিনের নিরবতা ভেঙে তখন শুরু হয় মা-মেয়ের আন্তরিক কথোপকথন। দুজনের মনের দুয়ার খুলে কাছাকাছি আসে তারা। মা খুলে বলে তার ব্যর্থ দাম্পত্যের ইতিহাস। সরোজিনীর খ্যাতি ও অর্থে কিভাবে হীনমন্যতায় ভুগতো মনীষ। স্ত্রীর উপর জেদ করেই সন্তানকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল সে। সরোজিনীও নিজের ভুলে বুঝতে পারেনি অদিতি তার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সোমনাথকে সে কখনো বিয়ে করেনি অদিতি তাকে বাবা বলে মেনে নিতে পারবে না বলে। অথচ অদিতি সারাজীবন মাকে ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক এক নারী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। অবশেষে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সে।

সিনেমাটি শেষ হয় সকালের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। তখন ঝড় থেমে গেছে। সুদীপের কাছ থেকে ফোন পায় অদিতি। ক্ষমা চায় সে। কিন্তু বোঝা যায় না, অদিতি তাকে ক্ষমা করবে কি না। এ কথাও পরিষ্কার হয় না যে মাকে পুরোপুরি ক্ষমা করতে পেরেছে কি না মেয়ে। গতানুগতিক মধুরেণ সমাপয়েৎ নয়, বরং এক দোলাচলের মধ্য দিয়েই যে এগিয়ে যায় জীবন তারই ইঙ্গিতবাহী সমাপ্তির দৃশ্য।

সরোজিনী চরিত্রে অপর্ণা সেন, অদিতি চরিত্রে দেবশ্রী রায়, সোমনাথ চরিত্রে দীপংকর দে, বেলা চরিত্রে চিত্রা সেন এবং সুদীপ চরিত্রে প্রসেনজিৎ রায় অভিনয় করেন। মনীষ চরিত্রে ছিলেন বোধিস্বত্ত্ব মজুমদার। কয়েকটি চরিত্র, একটি বাড়িতে অধিকাংশ দৃশ্যের চিত্রায়ন এবং ঘটনার ঘনঘটা না থাকা সত্ত্বেও ছবিটি কখনো একঘেঁয়ে হয়ে ওঠে না বা শ্লথ গতির বলেও মনে হয় না। বরং দর্শক উন্মুখ হয়ে উপভোগ করে মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন।

ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনায় অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতার পরিচয় দেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।টাইটেলের আগে সরোজিনীকে দেখা যায় না কিন্তু অনেক বেশি বাঙময় হয়ে ওঠে নৃত্যের ভঙ্গিমায় তার বাঁধানো ছবিগুলো। দর্শক তার ব্যক্তিত্বের আভাস পায় যেন আলোকচিত্রের মধ্য দিয়েই। ছোট ছোট সংলাপ আর অর্থপূর্ণ সম্পাদনায় মনোজগতের দ্বন্দ্ব ও সংকট পরিস্ফূট হয়ে ওঠে। সরোজিনী ও অদিতির ভূমিকায় অপর্ণা সেন ও দেবশ্রী রায় ছিলেন অনবদ্য। স্বার্থপর ও হৃদয়হীন প্রেমিকের চরিত্রে প্রসেনজিৎ ছিলেন পুরোপুরি মানানসই। দীপংকর দে এবং চিত্রা সেনের অভিনয় ছিল বাস্তবানুগ।ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন জ্যোতিষ্ক দাশগুপ্ত,চিত্রগ্রাহক সুনীষ্মল মজুমদার।

‘উনিশে এপ্রিল’ ১৯৯৫ সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আসরে সেরা ছবি হিসেবে স্বর্ণ কমল জয় করে।  সেরা অভিনেত্রী হিসেবে দেবশ্রী রায় রৌপ্য কমল জয় করেন।

অসাধারণ পরিচালনা ও অনবদ্য অভিনয়ে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র ধারায় ক্ল্যাসিক হিসেবে স্থান করে নিয়েছে‘উনিশে এপ্রিল’।