রাজকাপুর-নার্গিস: যে প্রেম রইলো ছায়া হয়েই

তাদের পর্দায় দেখে মনে হতো, জন্মই হয়েছে পরস্পরের জন্য। কিন্তু বাস্তবে অনেকটা পথ একসঙ্গে হাঁটলেও, একটা সময় দুটি দিকে বেঁকে যায় তাদের জীবন।এরা হলেন রাজকাপুর ও নার্গিস।পর্দায় এবং বাস্তবজীবনে তারা ছিলেন হিন্দি সিনেমার অন্যতম সেরা রোমান্টিক জুটি।

শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Jan 2015, 08:43 AM
Updated : 28 Jan 2015, 08:43 AM

কাপুর পরিবারের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র রাজকাপুরের দ্যুতি আজও অক্ষুন্ন। আর নার্গিস নিঃসন্দেহে হিন্দি সিনেমার অন্যতম সেরা সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। ষোলটি ছবিতে তারা জুটি বেঁধে অভিনয় করেন। এর প্রায় সবগুলোই বাণিজ্যিকভাবে যেমন সফল তেমনি সামাজিক বক্তব্যসমৃদ্ধ। দীর্ঘ দশ বছর ধরে চলে তাদের প্রেম।

অভিনেতা বাবার সন্তান হিসেবে রাজ কাপুর চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন মাত্র দশ বছর বয়সে। ১৯৪৭ সালে ‘নীল কমল’ ছবিতে মধুবালার বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি।১৯৪৮ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে রাজ কাপুর প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব স্টুডিও আর কে ফিল্মস এবং তার সময়ের সবচেয়ে তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার প্রযোজিত ও পরিচালিত প্রথম ছবি ‘আগ’। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন কামিনী কৌশল, নার্গিস ও প্রেমনাথ। তখন থেকেই নার্গিসের সঙ্গে তার সখ্যের সূচনা।

১৯৪৯ সালে মুক্তি পায় দীলিপ কুমার, নার্গিস ও রাজ কাপুর অভিনীত ত্রিভূজ প্রেমের ছবি ‘আন্দাজ’। মেহেবুব খানের এ সুপার হিট ছবি অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে রাজ কাপুরকে।আর কে ফিল্মসের ব্যানারে রাজ কাপুর পরিচালিত ও অভিনীত একের পর এক ছবি মুক্তি পায়। এ সব ছবিতে রাজের বিপরীতে ছিলেন নার্গিস। ‘বারসাত’(১৯৪৯), আওয়ারা (১৯৫১), ‘শ্রী ৪২০’(১৯৫৫), ‘চোরি চোরি’(১৯৫৬)-প্রতিটি ছবিই সুপারডুপার হিট আর প্রতিটিতেই ছিলেন রাজ-নার্গিস জুটি।

৪৮-৫৬ সালের মধ্যে এই জুটির অন্য ছবিগুলোও সাফল্য পায়। ‘জান পেহচান’, ‘আশিয়ানা’, ‘বেওয়াফা’, ‘ধুন’, ‘পেয়ার’, ‘আনহোনি’, ‘আম্বার’, ‘পাপী’, ‘আহ’, ছবিতে পর্দায় তাদের রসায়ন ছিল অনন্য।

নার্গিসের সঙ্গে ছবির বাইরেও প্রেম জমে ওঠে রাজের।চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের দেখা যেত এক সঙ্গে। শুটিংয়ের ফাঁকে কিংবা অবসরে তারা ছিলেন পরস্পরের সঙ্গী। রাজের উপর দারুণভাবে নির্ভর করতেন নার্গিস।আর রাজও ছবির গল্প স্থির করতেন নার্গিসের কথা মাথায় রেখে।বিদেশে তারা হোটেলের একই কক্ষে থাকতেন স্বামী-স্ত্রীর মতো। বিদেশে মিসেস কাপুর হিসেবে পরিচিত হন নার্গিস।১৯৪৯ সালে তারা গোপনে বিয়ে করেন। অবশ্য আইনগতভাবে নয়, মন্দিরে গিয়ে। নার্গিসের গলায় মঙ্গলসূত্র পরিয়ে দেন রাজ।

দশ বছর তীব্র প্রেমের পর ভাঙনের সুর বাজে তাদের সম্পর্কে।তাদের সম্পর্ক ভাঙার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল।

নার্গিস আশা করেছিলেন তিনি হবেন রাজ কাপুরের ঘরণী। কিন্তু রাজ ছিলেন বিবাহিত। ১৯৪০ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে পারিবারিকভাবে আত্মীয়কন্যা কৃষ্ণাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন রাজ।কৃষ্ণা কাপুর ছিলেন ঘরোরা প্রকৃতির নারী, পেশোয়ারের সাধারণ মেয়ে, রাজের সন্তানের জননী। সাদামাটা কৃষ্ণাকে ‘শো ম্যান’ রাজের পাশে একেবারেই মানাতো না। কিন্তু রাজের পক্ষে অসম্ভব ছিল কৃষ্ণাকে ত্যাগ করা। কারণ যৌথ পরিবারের সন্তান রাজ পারিবারিক ঐতিহ্যের বাইরে গিয়ে, বিশেষ করে বাবার নির্দেশকে অমান্য করে কৃষ্ণা এবং সন্তানদের ত্যাগ করতে অপারগ ছিলেন।

নার্গিস বুঝতে পারছিলেন রাজের জীবনে দ্বিতীয় নারী হিসেবেই থাকতে হবে তাকে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে তারা মস্কো যান। রাজ কাপুরের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ফ্রান্স সব দেশে তার জয়জয়কার।মস্কো চলচ্চিত্রে উৎসবে বিপুল সম্মান পান রাজ কাপুর। নার্গিস লক্ষ্য করেন রাজের ছবিগুলো এবং স্বয়ং রাজের ব্যাপক জনপ্রিয়তা, সবাই তাকে নিয়ে মেতে আছে।বিশেষ করে নারী ভক্তরা রাজকে ঘিরে রয়েছে। রাজও যেন তাদের দিকেই বেশি মনোযোগী। অথচ সহশিল্পী হিসেবে তারও তো অনেকটা কৃতিত্ব রয়েছে এ ছবিগুলোর সাফল্যের পিছনে। কিন্তু তাকে তেমন কেউ চিনতেও পারছে না বা খুব একটা গুরুত্বও দিচ্ছে না। এতে আহত হন তিনি।

মস্কোতে এ নিয়ে রীতিমতো মনোমালিন্য হয় তাদের।নার্গিসের মনে হতে থাকে রাজের জীবনে তার স্থান কোথায়? রাজের ছবিগুলোতেও নায়ক চরিত্রেরই প্রাধান্য। নায়িকা সেখানে অনেকটাই শোপিস। এ নিয়ে বেশ রাগারাগি হয় তাদের।অভিমান করে মস্কো থেকে একা ফিরে আসেন তিনি। এদিকে রাজ তখন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হোটেলের ঘরে পড়ে আছেন। সে সময় অসুস্থ রাজের সেবা করে তার মন জয় করেন দক্ষিণের নৃত্যকুশলী নায়িকা পদ্মিনী।।কৃতজ্ঞ রাজ দেশে ফিরে নতুন সিনেমা বানালেন ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বেহতি হ্যায়’। তাতে নার্গিসের পরিবর্তে নায়িকা হলেন পদ্মিনী।রাজের আরেকটি সফল ছবি ‘সংগম’ এ নায়িকা হন গ্ল্যামারাস বৈজয়ন্তীমালা|। এমনকি ছবিটির সাফল্যের স্বার্থে রাজ-বৈজয়ন্তীর রোমান্সের গুজব বাণিজ্যিক কৌশল হিসেবে ছড়িয়ে দেন রাজ নিজেই।। এতে আরও ক্ষুব্ধ হন নার্গিস।

সে সময় নতুন ছবির শুটিং চলছে। মেহেবুব খানের ‘মাদার ইন্ডিয়া’।এতে মূল ভূমিকায় নার্গিস। তার ছেলের ভূমিকায় রয়েছেন সুনীল দত্ত ও রাজকুমার।একদিন ছবির সেটে আগুন লাগে। নিজের জীবন বাজি রেখে নার্গিসকে বাঁচান সুনীল দত্ত।সুনীল দত্তের সঙ্গে নার্গিসের রোমান্সের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এতে আহত হন রাজ। একদিন আর কে ফিল্মসের স্টুডিওতে দুজনের কথা কাটাকাটি হয়। এই স্টুডিওতে নার্গিসের জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। সেখানে অনেক ব্যক্তিগত জিনিস রাখতেন তিনি। ঝগড়ার পর তার গাড়ির ড্রাইভার এসে যখন সে সব জিনিস নিয়ে যাচ্ছিল তখন রাজ অভিমানে উদ্বেল হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন নার্গিস চলে যাচ্ছেন তার জীবন থেকে চিরতরে।

সুনীল দত্ত মানুষ হিসেবে ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের, সৎ এবং প্রতিভাবান। নার্গিসকে ভালোবাসতেন তিনি প্রচণ্ডভাবে। তার জীবনে নার্গিসই ছিলেন একমাত্র নারী।নার্গিস ভাবলেন রাজের জীবনে ছায়ামাত্র হয়ে থাকার চেয়ে সুনীল দত্তের মতো একজন মানুষের স্ত্রী হওয়া শতগুণে শ্রেয়।১৯৫৭ সালে মুক্তি পেল ‘মাদার ইন্ডিয়া’। ছবিটি নার্গিসের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজই শুধু নয়, এটি হিন্দি সিনেমার শতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ছবি। নার্গিসের জীবনে এটি বয়ে আনে প্রভূত সম্মান ও সাফল্য। পরের বছর ১৯৫৮ সালেই সুনীল দত্তকে বিয়ে করেন নার্গিস।

রাজ তার চমকপ্রদ সাফল্যের মাধ্যমে ক্রমশ বলিউডের কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। কিন্তু নার্গিসকে হারানোর বেদনা তাকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। নার্গিসের সঙ্গে প্রথম দেখার স্মৃতিও তিনি কখনও ভোলেননি। প্রথম যেদিন রাজকাপুর নার্গিসের বাসায় যান তিনি তখন বেসন দিয়ে পাকোড়া ভাজছিলেন। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে তিনি নিজেই দরজা খুলে দেন। আগুনের তাপে লালচে আভা তার মুখে, বেসন মাখা হাতটা অজান্তে নিজের চুলে বোলান, ফলে চুলে সোনালি গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ে। রাজ মুগ্ধ হন তার সৌন্দর্যে। এই দৃশ্য তার মনে আঁকা থাকে চিরদিন। অনেক বছর পর তিনি যখন ববি সিনেমা বানাচ্ছেন তখন এই দৃশ্যটি অন্তর্ভুক্ত করেন ছবিতে। ডিম্পলের সঙ্গে ছবিতে ঋষি কাপুরের প্রথম দেখা হওয়ার দৃশ্যটি প্রকৃত পক্ষে রাজ-নার্গিসের প্রথম দেখার স্মৃতিমাত্র। তার সহকর্মীরা বিভিন্ন স্মৃতিচারণে নার্গিসের বিচ্ছেদে রাজের অপরিসীম মনোবেদনার কথা উল্লেখ করেছেন।

নার্গিসের মৃত্যু হয় ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে ১৯৮১ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে। আর বলিউড কিংবদন্তি রাজকাপুর ১৯৮৮ সালে ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

জীবনে তারা একে অন্যের না হতে পারলেও রাজ-নার্গিস চিরদিনই বলিউডের অন্যতম সেরা প্রেমিক জুটি হিসেবে দর্শকহৃদয়ে আসন গেড়ে রইবেন।