সেরা দশ হিন্দি সিনেমা

তিন খানের দাপট, বড় বাজেটের মারদাঙ্গা অ্যাকশন সিনেমার দৌরাত্ম আর এর মাঝেই নারীকেন্দ্রিক, বক্তব্যনির্ভর সিনেমার মাথা তুলে দাঁড়ানো - বলিউডের জন্য গতানুগতিকের মাঝে বৈচিত্রের ঝলকপূর্ণ এক বছর ছিল ২০১৪। 

সেঁজুতি শোণিমা নদীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Jan 2015, 07:06 AM
Updated : 1 Jan 2015, 07:06 AM

অভিনয়, চিত্রনাট্য আর চলচ্চিত্রিক কাঠামোর দিক থেকে বছরের সেরা দশ হিন্দি সিনেমার কথা জেনে নেওয়া যাক এবার। 

১০. দেড় ইশকিয়া

ছয় বছর পর মাধুরি দিক্ষিতের ফিরে আসার সিনেমা হিসেবে ‘দেড় ইশকিয়া’ ছিল চলতি বছরের অন্যতম প্রতীক্ষিত সিনেমা। সেই সঙ্গে ২০১০ সালের প্রশংসিত সিনেমা ‘ইশকিয়া’র সিকুয়াল হিসেবেও সিনেমাটির আবেদন ছিল অন্যরকম।

বক্স-অফিসে তেমন সাড়া জাগাতে না পারলেও সমালোচকদের মন কেড়েছে মাধুরি দিক্ষিত, নাসিরুদ্দিন শাহ, আরশাদ ওয়ার্সি এবং হুমা কুরেশির অনবদ্য অভিনয়। আর সেই সঙ্গে গল্পকথনের অভিনবত্ব আর গাঁথুনির জোর তো ছিলই। সে কারণেই বছরের অন্যতম ভাল সিনেমার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে অভিষেক চৌবের এই ব্ল্যাক কমেডি থ্রিলার।

৯. মেরি কম

ভারতের অলিম্পিক পদকজয়ী মুষ্টিযোদ্ধা মেরি কমের জীবনভিত্তিক সিনেমা 'মেরি কম'- এ প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে অন্য রকম অবতারে দেখার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। সঞ্জয় লিলা বানসালির প্রযোজনায় আর উমাঙ্গ কুমারের পরিচালনায় ১৫ কোটি রুপি বাজেটের সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী দারুণ ব্যবসা করেছে। ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সব মিলিয়ে সিনেমাটি আয় করে ১০৪ কোটি রুপি।

সিনেমায় উত্তর ভারতীয় প্রিয়াঙ্কাকে মণিপুরি এক নারীর চরিত্রে নেওয়ার ব্যপারে শুরুতে প্রশ্ন উঠলেও সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর তার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে সব মহলে। অনেকে তার অভিনয়কে তুলনা করেছেন ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’র জন্য অস্কার পাওয়া হিলারি সোয়াঙ্কের অভিনয়ের সঙ্গে। সেইসঙ্গে দারুণ চিত্রগ্রহণ এবং চিত্রনাট্যের জন্যও প্রশংসিত হয়েছে সিনেমাটি।

৮. হাম্পটি শর্মা কি দুলহানিয়া

চলতি বছরের অন্যতম ব্লকবাস্টার হিট এই সিনেমাটিকে বলা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’। ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’-এর পর এই সিনেমায় ভারুণ ধাওয়ান-আলিয়া ভাট জুটির রসায়ন মন কেড়েছে সবার। সেই সঙ্গে কুশলী নির্মাণশৈলী, দারুণ সব গান আর সহজ-সরল গল্প ‘হাম্পটি শর্মা কি দুলহানয়া’কে পরিণত করেছে বছরের অন্যতম উপভোগ্য সিনেমায়।

৭. সিটি লাইটস

গত বছর 'শাহিদ' সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত জুটি হান্সাল মেহতা ও রাজকুমার রাওয়ের নতুন এই চলচ্চিত্রটি প্রতীক্ষিত ছিল। অনবদ্য অভিনয়ে সিনেমার হৃদয়স্পর্শী গল্প জয় করেছে দর্শকদের মনও। ২০১৩ সালের ব্রিটিশ সিনেমা ‘মেট্রো ম্যানিলা’র এই হিন্দি রিমেইকে তুলে ধরা হয়েছে রাজস্থান থেকে জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই আসা এক কৃষক পরিবারের গল্প।

স্বল্প বাজেটে তৈরী এই সিনেমা মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া ফেলে বক্স-অফিসে।

৬. ফাইন্ডিং ফ্যানি

নাসিরউদ্দিন শাহ, ডিম্পল কাপাডিয়া, পঙ্কজ কাপুর - আর তাদের সঙ্গে দিপিকা পাড়ুকোন এবং অর্জুন কাপুর- ইংরেজি ভাষায় নির্মিত এই বিদ্রুপাত্মক কমেডি মুক্তির আগেই সাড়া ফেলেছিল অতীত ও বর্তমানের উজ্জ্বল এই তারকাদের জন্যই। সেই সঙ্গে ষাটোধ্বর্ এক বৃদ্ধের ৪৫ বছর আগে হারিয়ে ফেলা ভালবাসার মানুষটির খোঁজে বেরিয়ে পড়ার গল্পও সমানভাবে আকর্ষণ করে দর্শকদের।

‘ককটেইল’ খ্যাত নির্মাতা হোমি আদাজানিয়া নিঃসন্দেহেই ফ্যানিকে খোঁজার গল্প দিয়ে মনোরঞ্জন করতে পেরেছেন দর্শকদের। সেইসঙ্গে ‘ফ্যানি রে’ এবং ‘শেইক ইওর বুটিয়া'র মতো মজাদার গান ছিল সিনেমাটির বাড়তি পাওনা।

৫. আগলি

‘গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর’ খ্যাত নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যাপ এবার হাজির হলেন ‘আগলি’ নিয়ে। সাসপেন্স থ্রিলারের পরতে পরতে মানবিক অবক্ষয় আর ভঙ্গুর মানবসম্পর্কের করুণ গল্প তুলে ধরে সিনেমাটি।

২০১৩ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হলেও, ভারতে সিনেমাটি হল প্রদর্শিত হচ্ছে চলতি মাস থেকেই। মুক্তির পরপরই ভারত এবং আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলেছে সিনেমাটি। বড় তারকার জৌলুস, আইটেম গানের চাকচিক্য না থাকা সত্বেও কেবল এর শক্তিশালী বক্তব্য, চমৎকার পরিচালনা আর কলাকুশলীদের অভিনয়ের কারণে একবার হলেও দেখার দাবী করতেই পারে ‘আগলি’।

৪. হায়দার

ভিশাল ভারাদওয়াজের শেক্সপিয়র ট্রিলজির শেষ পর্বটি ছিল এই সিনেমা। ‘হ্যামলেট’ থেকে অনুপ্রাণিত ‘হায়দার’-এর প্রেক্ষাপট হিসেবে গুনী এই নির্মাতা বেছে নিয়েছেন কাশ্মিরকে। আর তাই এই যাত্রায় সঙ্গী হিসেবে নিয়েছেন পঙ্কজ কাপুর, টাবু, কে কে মেনন, শাহিদ কাপুর, শ্রদ্ধা কাপুরকে।

নির্মাণকুশলতা, অভিনয়শৈলী আর চমৎকার প্রেক্ষাপট- সবমিলিয়েই ‘হায়দার’ তাই হয়ে উঠেছে ভারাদওয়াজের ক্যারিয়ার সেরা সৃষ্টির একটি। সমালোচকদের প্রশংসার পাশাপাশি দর্শকদেরও মন জোগাতে সক্ষম হয়েছে সিনেমাটি। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এর মতো ব্লকবাস্টার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকা সত্বেও বক্স-অফিস থেকে ভালো সংগ্রহ দাঁড় করাতে পারাটাই তার প্রমাণ।

৩. কুইন

কাঙ্গানা রানাওয়াত যে হিন্দি সিনেমার এই প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাবান শিল্পীদের একজন, সেটা তিনি প্রমাণ করেছিলেন ২০০৮ সালের ‘ফ্যাশন’ সিনেমাটি দিয়েই। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারজয়ী এই অভিনেত্রী এবার ‘কুইন’ দিয়ে প্রমাণ করলেন, ভাল গল্প পেলে পুরো সিনেমাকে টেনে নিতে তিনি একাই যথেষ্ঠ।

ভিকাস বেহেলের ‘কুইন’ দিল্লির রক্ষণশীল পরিবারের অতিসাধারণ এক মেয়ের গল্প বলে যে ঘরের বাইরে একা কখনো পা রাখেনি। রানি নামের সেই মেয়েটিই একা একা প্যারিস ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে তার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর। আর সেই যাত্রাতেই রানি আবিষ্কার করে নারী হিসেবে তার স্বাধীন সত্বাকে।

বছরের সেরা হিন্দি সিনেমার তালিকায় এই সিনেমাটি থাকার আরেকটি কারণ, এটিই এই বছরের সবচেয়ে ‘ফিল-গুড’ ছবি। সিনেমাশেষে রানির আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে যায় দর্শকদের মাঝেও; রানির হাসিও সঙ্গী হয় সবার।

২. পিকে

মুক্তির ছয় মাস আগ থেকেই শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিল সিনেমাটি। আমির খানের নগ্ন পোস্টার দিয়ে যে সমালোচনার শুরু, সিনেমা মুক্তির পর তার পালেই হাওয়া লাগল ‘ধর্মানুভূতি’তে আঘাত হানার অভিযোগে। এতকিছুর পরও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের রায়ে সর্বকালের সেরা সিনেমার একটি 'পিকে'। রাজকুমার হিরানি আর আমির খান জুটির নতুন এই সিনেমা বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে চলেছে সর্বকালের সেরা বাণিজ্যিকভাবে সফল হিন্দি সিনেমা হওয়ার দিকেও।

এতো সমালোচনা সত্বেও এমন সাফল্যের রহস্য লুকিয়ে আছে সিনেমার অনন্য এক গল্প, সাহসী বক্তব্য এবং আমির খানের অভিনয়ে। ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে প্রতিনিয়ত ঠকতে থাকা মানুষ এবং তাদের কপটতার কথাই তুলে ধরে বিদ্রুপাত্মক কমেডি ‘পিকে’। বছরের অন্যতম সেরা সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর নয়, জয়গান গায় মানুষেরই, যারা সত্যিকারের মানবতায় বিশ্বাস করে। 

১. হাইওয়ে

‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার’-এ সেই সদ্য কৈশোর পেরুনো মেয়েটির কথা মনে আছে, সাজগোজেই যার বেলা বয়ে যেতো! সেই আলিয়া ভাট তার দ্বিতীয় সিনেমায় জাত চিনিয়ে দিলেন। ‘হাইওয়ে’ সিনেমায় ভিরা ত্রিপাঠির ভূমিকায় তার অভিনয় তাকে হিন্দি সিনেমার শীর্ষ অভিনয়শিল্পীদের কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

সেই কৃতিত্বের দাবীদার অবশ্য পরিচালক ইমতিয়াজ আলিও। ‘রকস্টার’- এ তিনি তুলে এনেছিলেন অন্য এক রানবির কাপুরকে, ‘যাব উই মেট’- এ পৃথিবী দেখেছিল কারিনা কাপুরের ক্যারিয়ার সেরা নৈপুণ্য । কিন্তু 'হাইওয়ে'তে তিনি নিজেকেও ছাড়িয়ে গেছেন।

এক তরুণীর অপহরণ ও নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের যাত্রা দর্শককেও নতুন করে চিনতে শেখায় সমাজের নানা অসঙ্গতিকে, আভিজাত্যের লেবাস আর শ্রেণী বিভেদের তলায় যেগুলো আমরা চাপা দিয়ে রাখি।  গুন্ডা মহাভির ভাট্টির ভূমিকায় রানদিপ হুডার অভিনয়ও তার সেরা কাজের একটি। সেই সঙ্গে এ আর রেহমান সংগীতায়োজন সিনেমাটিকে এক আধ্যাত্মিক পযর্ায়ে উন্নীত করে । সবমিলিয়ে ‘হাইওয়ে’-এই বছরের সেরা সিনেমা- একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়।