লোকজ বিনোদন

বৈশাখ এল রে। বাংলাদেশের জনজীবনে পহেলা বৈশাখ মানেই বিনোদন। এ দেশের সব সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর একান্ত আনন্দের দিন। একমাত্র এই দিনটিতেই হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পাহাড়ি, বাঙালি, এবং সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ এসে দাঁড়ায় এক সমতলে, উৎসবের কাতারে।

শান্তা মারিয়া, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2014, 11:59 AM
Updated : 13 April 2014, 11:59 AM

হালখাতা, পুণ্যাহের মতো হিসেব-নিকেস, খাজনা আদায়ের কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হলেও আবহমান কাল থেকেই নববর্ষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিনোদনের অনুষঙ্গ। মেলা, নৌকাবাইচ, ষাঁড়ের লড়াই, বলীখেলার পাশাপাশি কবিগান, পুতুলনাচ, ঝুমুরনাচ, যাত্রা, পালাগান, শিবের গাজন, বারোমাসি, পুঁথিপাঠ-- এগুলো সবই আমাদের লোকজ বিনোদনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ।

দীর্ঘদিন ধরে গণমানসে গড়ে ওঠা কাহিনি, কাব্য, গান, নাচ-- এগুলো সবই লোকজ বিনোদনের উপাদান। লোকজ বিনোদনে প্রতিফলিত হয় একটি জনপদের সাধারণ মানুষের রুচি, তার আশা-আকাক্সক্ষা, আনন্দ ও বেদনার কথা। কোনোটায় দেখা যায় লোকপ্রজ্ঞার দর্শন, কোনোটায় লোককল্পনার কাব্য। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা বয়ে চলে। কোনোটার রূপ পাল্টায়, কোনোটায় দেখা দেয় নতুন অর্থ, নতুন ব্যঞ্জনা।

বাংলার জনপদে লোকজ বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ যাত্রা। কয়েকশ’ বছর ধরেই বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে যাত্রা ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় লোকজ বিনোদন। পুরাণ কাহিনি, রূপকথা, কিংবদন্তি, ময়মনসিংহ গীতিকা এবং পুঁথির কাহিনির উপর ভিত্তি করে প্রচুর যাত্রা মঞ্চস্থ হয়েছে।

এ দেশের মানুষ রাতের পর রাত জেগে দেখেছে সোনাভান, গুনাইবিবি, রূপবান, নল দময়ন্তী, সাবিত্রী সত্যবান, ঈশা খাঁ-মানসিংহ, প্রতাপ চন্দ্র, নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাহিনি। রাম ও শ্রীকৃষ্ণের জীবন নিয়ে রামযাত্রা ও কেষ্ট যাত্রা এক সময় ছিল এ দেশের গণমানুষের বিনোদন। শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকাহিনি নিয়ে মা যশোদা ও গোপালের নিবিড় সম্পর্কনির্ভর এবং বৃন্দাবন লীলা নিয়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমনির্ভর প্রচুর যাত্রা এ দেশের মানুষকে জুগিয়েছে ভক্তিরস। রাম-সীতার পালাগান ও যাত্রা এক সময় ছিল গণমানুষের অন্যতম প্রধান বিনোদন।

আবহমান কাল ধরে চলে আসা এই শিল্প গত কয়েক দশকে ধ্বংসের মুখোমুখি হয় যাত্রার আসরে জুয়া ও অশালীন নাচের কারণে। যাত্রার আসরে সখী নৃত্য একসময় প্রচলিত ছিল যা কিছুটা অসংস্কৃত হলেও তাকে ঠিক অশালীন বলা যেত না। কিন্তু পরবর্তীতে গ্রামগঞ্জে বিদেশি পর্নোছবির অশুভ প্রভাবে প্রিন্সেসের নাচের নামে যাত্রার আসরে অশালীনতা ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রাশিল্পকে বাঁচানো দরকার আমাদের লোকজ সংস্কৃতি রক্ষার দায় থেকেই।

পুতুল নাচ আমাদের লোকসংস্কৃতির আরেকটি উপাদান। বিভিন্ন বৈশাখী মেলায় পুতুল নাচ দেখা যায়। তবে বিভিন্ন কারণে এই শিল্পটিও এখন ধ্বংসের মুখে। বাউল, ফকির, বৈষ্ণব, বৈরাগীদের গান একসময় বাংলার পথেপ্রান্তরে সুরের জাদু ছড়িয়ে দিত। কীর্তন, পালাগান, শ্যামাসংগীত, বাউলগান শোনা যেত বিভিন্ন আসরে। লালন ফকির, সর্বক্ষেপী, গগন হরকরা, রাধারমণ, হাসন রাজা থেকে শুরু করে শাহ আবদুল করিমের মতো সাধক বাউলরা লোকসংগীতে মুগ্ধ করেছেন গণমানস।

এ দেশের লোক সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান কবিগান, ঝুমুরগান ও নাচ, গাজীর গান ও শিবের গাজন, কীর্তন। উত্তর বঙ্গের গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া এবং অন্যান্য অঞ্চলে ভাটিয়ালি বিখ্যাত। বিভিন্ন আঞ্চলিক গান সেই অঞ্চলের লোকপ্রতিভার অনন্য সৃষ্টি।

আধুনিক সময়ে লোকজ গানের শিল্পী হিসেবে আব্বাস উদ্দিন, মোস্তফা জামান আব্বাসী, রথীন্দ্রনাথ রায়, আবদুল আলীম, কিরণ চন্দ্র রায়, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, দিলরুবা খান, নীনা হামিদ, ফরিদা পারভীন, মোমতাজ, চন্দনা মজুমদার, বারী সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস বয়াতী, আবদুর রহমান বয়াতী, কাঙালিনী সুফিয়া বিখ্যাত।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির বসবাস রয়েছে। সাঁওতাল, মান্দি, চাকমা, মারমা, মণিপুরী, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। এদের মধ্যে যুগযুগ ধরে প্রচলিত সংগীত, নৃত্য ও অন্যান্য বিনোদন অনুষঙ্গগুলোর সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। 

‘তোমার বাড়ির রঙের মেলায় দেখেছিলাম বায়োস্কোপ’ প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর গানটি মনে করিয়ে দেয় বৈশাখী মেলার কথা। সেই সঙ্গে আরও মনে করিয়ে দেয় কীভাবে বায়োস্কোপ এবং পরবর্তীতে সিনেমা আমাদের লোকজ বিনোদনের অংশ হয়ে পড়ে। বায়োস্কোপ শব্দটি ইংরেজি বাইস্কোপ শব্দ থেকে এসেছে। এক সময় আমাদের গ্রামগঞ্জে বায়োস্কোপ ছিল দারুণ জনপ্রিয়। বাক্সের ভেতর চোখ রেখে রঙিন ছবি দেখতে ভালোবাসত শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই।

পরবর্তীতে যখন সিনেমা এল তখনও তাকে বায়োস্কোপ নামে ডাকত প্রবীণ লোকজন।

বাংলা সিনেমা দীর্ঘকাল ধরে নির্মিত হয়েছে যাত্রার ঢঙে। এ দেশের লোককাহিনি নিয়ে সিনেমাও নির্মিত হয়েছে অনেক। লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। লক্ষণীয় যে, সে সময় বাঙালি গুরুত্বের সঙ্গে তার আপন শিকড়ের সন্ধানে প্রবৃত্ত হতে থাকে। সফদার আলী ভূঁইয়ার পরিচালনায় ১৯৬৬ সালের মার্চে মুক্তি পায় ‘রহিম বাদশাহ ও রূপবান’। ছবিটি দারুণ ব্যবসা সফল হয়। সে বছর এপ্রিলে ইবনে মিজানের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘আবার বনবাসে রূপবান’। রূপবানের ব্যবসায়িক সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সে বছর আরও মুক্তি পায় লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা সৈয়দ আউয়াল পরিচালিত ‘গুনাই বিবি’ বজলুর রহমান পরিচালিত ‘গুনাই’, আলি মনসুর পরিচারিত ‘মহুয়া’, জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ এবং ইবনে মিজান পরিচালিত ‘জরিনা সুন্দরী’।

১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাঞ্চনমালা’, ১৯৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’ ব্যবসা সফল হয়। ১৯৬৯ সাল থেকে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা হল ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’, ‘কুচবরণ কন্যা’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘রূপবানের রূপকথা’, ‘পারুলের সংসার’, ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’, ‘বেদের মেয়ে’, ‘মলুয়া’, ‘আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’ ইত্যাদি।

স্বাধীনতার পর লোককাহিনিভিত্তিক সিনেমা নির্মাণের ধারা অব্যাহত থাকে এবং ছবিগুলোর অধিকাংশই ব্যবসাসফল হয়। এসব ছবির মধ্যে ‘কমল রানীর দীঘি’, ‘নিমাই সন্ন্যাসী’, ‘লালন ফকির’, ‘গোপাল ভাঁড়’, ‘মালকাবানু’, ‘কাজল রেখা’ ইত্যাদি। এসব সিনেমার অধিকাংশই ছিল ব্যবসাসফল।

এই ধরনের সিনেমার সফল নায়ক-নায়িকা ছিলেন আজিম, সুজাতা, কবরী, আনোয়ার হোসেন, শাবানা, রাজ্জাক, নার্গিস, ফারুক, ববিতা এবং আরও অনেকে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে এবং আশির দশকে হিন্দি সিনেমার আদলে অনেক সিনেমা নির্মিত হতে থাকে এবং লোকজ কাহিনিনির্ভর সিনেমা নির্মাণের ধারা কমে আসে। সে সময় ‘ফোক ফ্যান্টাসি’ নাম দিয়ে যে উদ্ভট কিছু সিনেমা নির্মিত হয় তার কথা এখানে বলা হচ্ছে না। কারণ এগুলোর বেশির ভাগই লোককাহিনি নির্ভর নয়।

লোককাহিনির অনুকরণ করে উদ্ভট পোশাক, সংলাপ, অশালীন নাচ গানের এক জগাখিচুড়ি ছিল সেগুলো। অনেকগুলোতে আবার নাগনাগিনী ইত্যাদি কাহিনি ব্যবহৃত হয় যা লোককাহিনি নির্ভর নয়।

তবে ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাধাকৃষ্ণ’ এবং ‘রাই বিনোদিনী’ সিনেমা দুটি রাধা-কৃষ্ণের কাহিনিনির্ভর। সিনেমা দুটি ব্যবসা সফলও হয়েছিল।

১৯৮৫ সালের পর অতীতে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যবসা সফল সিনেমাগুলোর রঙিন রিমেক মুক্তি পেতে থাকে। ‘রঙ্গীন রূপবান’, ‘রঙিন গুনাইবিবি’ ‘রঙিন বেহুলা লক্ষিন্দর’ ইত্যাদি সিনেমা মুক্তি পায় তখন।

সিনেমার প্রয়োজনে লোককাহিনিকে কিছুটা পরিবর্তিত করে ১৯৮৯ সালে নির্মিত হয় ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত এবং অঞ্জুঘোষ, ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত সিনেমাটি বাংলাদেশের ব্যবসাসফল সিনেমার অন্যতম উদাহরণ হয়ে আছে এখনও।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’র সাফল্য দেখে আবার কয়েকটি সিনেমা নির্মিত হয় যেগুলো মোটেই লোককাহিনি নির্ভর নয়। বরং তার অক্ষম অনুকরণ।

পরবর্তীতে নির্মিত লোককাহিনিনির্ভর মৌসুমী অভিনীত ‘খায়রুন সুন্দরী’ সিনেমাটিও ব্যবসা সফল হয়েছে।

পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এখন নির্মিত হচ্ছে টিভি নাটক, টেলিফিল্ম, মুক্তি পাচ্ছে বিভিন্ন অডিও অ্যালবাম। এই সময় মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যালবামগুলোতে মূলত লোকজ সুর প্রাধান্য পায়। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়।

পহেলা বৈশাখ আমাদের শিকড়ের দিকে ফিরে তাকাবার দিন। লোকজ সংস্কৃতি আমাদের সম্পদ। লোকজ বিনোদন লোকজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এগুলো বয়ে চলে সুরে সুরে, ছন্দে ছন্দে। আমাদের সমৃদ্ধ লোকজ সংস্কৃতির পরিচয়বাহী এসব উপাদান যতবেশি জনপ্রিয় হবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে তত আশংকা কমবে বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের।