তারকা যখন ভোটপ্রার্থী

সিনেমা কিংবা টিভি পর্দার নায়ক-নায়িকারা-- সাধারণ মানুষের কাছে যারা সুদূর তারকালোকের বাসিন্দা; তাদেরই কেউ যদি কখনও হঠাৎ এসে উপস্থিত হয় আপনার দোরগোড়ায়, ভোটভিক্ষার আরজি নিয়ে-- কেমন হবে ভাবুন তো! ঠিক এই ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই এখন যাচ্ছেন ভারতীয়রা।

সেঁজুতি শোণিমা নদী বিডিনিউজ টোয়ৈন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2014, 11:42 AM
Updated : 12 April 2014, 11:44 AM

রোনাল্ড রেগান থেকে শুরু করে আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার-- আমেরিকার ইতিহাসে হলিউডি তারকাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার গল্প অনেক পুরনো। ভারতের প্রেক্ষাপটেও তাই; বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির রাজনীতিবিদদের অনেকেরই রয়েছে রূপালিজগতের অভিজ্ঞতা। বিজেপির টিকেটে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শত্রুঘ্ন সিনহা, তামিল নাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা-- এদের সবাই একসময় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ভারতের মূলধারার সিনেমায়। এই তালিকায় যোগ করা যায় বিনোদ খান্না, সুনীল দত্ত, নার্গিস, রাজ বাব্বরের মতো সিনিয়র অভিনেতার নামও। রাজনীতিতে সক্রিয় এদের সবাই বিভিন্ন মেয়াদে কাজ করেছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে।

সেই ধারা বজায় রেখে, চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের তালিকায় এবার রীতিমতো বন্যা বইছে বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকাদের। মূল প্রতিদ্ব›দ্বী দুই দল-- কংগ্রেস এবং বিজেপি তো বটেই, তারকাদের মাঠে নামানোর ব্যাপারে পিছিয়ে নেই তৃণমূল কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টির মতো অপেক্ষাকৃত নতুন দলগুলোও। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ময়দানে তৃণমূলের হয়ে নামা একঝাঁক তারকা আভাস দিচ্ছেন জমজমাট লড়াইয়েরই।

এই লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও একটি মাস। ততক্ষণে, আসুন জেনে নিই প্রথমবারের মতো নির্বাচন করতে নামা বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকাদের কথা।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে টালিউডি শিল্পীরা

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীদের তালিকাই এবার সবচেয়ে বেশি ‘তারকাখচিত’। এই দলের হয়ে এবারই প্রথম বাঁকুড়া থেকে নির্বাচনে নামছেন অভিনেত্রী মুনমুন সেন। মা সুচিত্রা সেনের অসুস্থতার সময় নিয়মিত বেলভিউ হাসপাতালে তার খোঁজ নিতে যেতেন মমতা; তখন থেকেই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল মুনমুনের রাজনীতিতে আসার। শুরুটা করলেন সরাসরি নির্বাচনে নেমে; যদিও প্রচারণা চালানোর সময় চৈত্রের দাবদাহে রীতিমতো নাকাল এই অভিনেত্রী। দেখা যাক, মূল পর্ব অর্থাৎ ১৭ এপ্রিলের ভোট গ্রহণের মঞ্চে কতটা সফল হন তিনি।

মুনমুন সেন ছাড়াও সিনিয়র অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ও লড়বেন তৃণমূলের হয়ে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র মেদিনীপুর থেকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তিনি।

হাল সময়ের জনপ্রিয় টালিউডি অভিনেতা দেবও নাম লিখিয়েছেন তৃণমূলে; তিনি লড়বেন ঘাটাল থেকে। ওদিকে অভিনেতা বিশ্বজিৎ নেমেছেন দিল্লিজয়ের অভিযানে। টালিউড ছেড়ে অনেক আগেই বলিউডে পাড়ি জমানো এই সিনিয়র অভিনেতা প্রার্থী হয়েছেন নয়াদিল্লির আসনে।

মমতা যখন একঝাঁক তারকা নিয়ে নামছেন  যুদ্ধের ময়দানে, তখন অন্য দলগুলোই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপিও এই অঞ্চলের লড়াইয়ে নামছে একই কৌশল নিয়ে। এক্ষেত্রে তাদের তুরুপের তাস আশির দশকের জনপ্রিয় সুরকার ও গায়ক বাপ্পি লাহিড়ি। ৬১ বছর বয়সী লাহিড়ি লড়বেন শ্রীরামপুর থেকে; কলকতার হুগলি জেলার এই কেন্দ্রকে বেশ গুরুত্বপূর্ণই ধরা হচ্ছে এবারের নির্বাচনে।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রার্থীদের তালিকায় আরও আছেন গায়ক বাবুল সুপ্রিয়; আসানসোল থেকে নির্বাচনে নামছেন তিনি।

বিজেপির তারকাদল

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দাপট থাকলেও, ভারতব্যাপী বিভিন্ন কেন্দ্রে তারকাদের নামানোর ব্যাপারে এগিয়ে আছে মোদির দল বিজেপি। সত্তরের দশকের ড্রিম গার্ল হেমা মালিনী থেকে শুরু করে হাল আমলের আইটেম গার্ল রাখি সাওয়ান্ত; ছোট পর্দার জনপ্রিয় ‘বহু’ স্মৃতি ইরানি থেকে বড় পর্দার জাঁদরেল ‘শাশুড়ি’ কিরণ খের; ঘাগু রাজনীতিবিদ শত্রুঘ্ন সিনহা থেকে শুরু করে এবারই প্রথম নির্বাচনে নামা পরেশ রাওয়াল-- বিজেপির প্রার্থীদের তালিকায় এবার সব রাঘববোয়ালেরই সমাগম।

‘কিউকি সাঁস ভি কাভি বহু থি’ নামের ডেইলি সোপ দিয়ে ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রীতে পরিণত হওয়া স্মৃতি ইরানির এবারই প্রথম নির্বাচনী পরীক্ষা। তবে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আমেথিতে জিততে হলে ইরানিকে টপকাতে হবে রাহুল গান্ধীর বাধা। সোনিয়া গান্ধীপুত্র এবং কংগ্রেস থেকে এবারের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী। দেখা যাক, রাহুলকে হারাতে বিজেপির ইরানি অস্ত্র এবার কাজে দেয় কতখানি!

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র চণ্ডিগড়ে এবার মুখোমুখি অবস্থানে দুই বলিউডি অভিনেত্রী কিরণ খের এবং গুল পানাগ। সিনিয়র অভিনেত্রী কিরণ নামছেন বিজেপির টিকিটে; ওদিকে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির হয়ে এই আসনে লড়বেন সাবেক মিস ইন্ডিয়া গুল।

বলিউডের ড্রিম গার্ল হেমা মালিনির রাজনীতির ইতিহাস অনেক পুরনো। বিজেপির সদস্য হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন এক দশক আগে। ২০১০ সালের মার্চে দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। তবে এই দীর্ঘ সময়ে কখনও সরাসরি নির্বাচনে নামেননি তিনি। সেই ধারায় বদল এনে মথুরা আসন থেকে এবারই প্রথম সরাসরি নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছেন হেমা।

দুই বছর আগেও বলিউডে আইটেম গার্ল হিসেবে রাখি সাওয়ান্তের চাহিদা ছিল দারুণ। খোলামেলা পোশাক, চটুল নাচ আর ঠোঁটকাটা মন্তব্যের জন্য বরাবরই পরিচিত রাখি এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মুম্বাই থেকে। শুরুতে তিনি ডাক পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি আসনে নির্বাচনের জন্য। কিন্তু বাঙালি না হওয়ায় ওই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হননি তিনি।

গুজরাটে বিজেপির অন্যতম শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আহমেদাবাদে এবার প্রার্থী হয়েছেন অভিনেতা পরেশ রাওয়াল। নব্বইয়ের দশকের খল অভিনেতা আর বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় চরিত্রাভিনেতা পরেশেরও এটাই প্রথম নির্বাচনী অভিজ্ঞতা।

কংগ্রেসের তারকারা

ভারতের সবচেয়ে পুরনো দল কংগ্রেস অবশ্য নির্বাচনী কৌশলে তারকাদের খুব একটা ব্যাবহার করেনি কখনও। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। এবার তাদের প্রার্থীদের তালিকায় আছেন-- নাগমা এবং রবি কিষেণ শুকলার মতো দক্ষিণী তারকারা। আর গাজিয়াবাদ আসনে তাদের দীর্ঘদিনের আস্থা সিনিয়র অভিনেতা রাজ বাব্বর তো আছেনই।

এর আগে কংগ্রেস থেকে রাজ্যসভার সংরক্ষিত আসনে সদস্য হওয়ার জন্য মনোনীত অভিনেত্রী নাগমা এবার সরাসরি নির্বাচনে নামছেন মিরাটে। সালমান খানের বিপরীতে ‘বাঘি: আ রেবেল ফর লাভ’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখা এই অভিনেত্রী পরবর্তীতে তার ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন দক্ষিণী সিনেমায়। ২০০৩ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি, তখন থেকেই রাজনীতিতে তার উপস্থিতি সরবভাবেই জানান দিচ্ছেন ৩৯ বছর বয়সী এই তারকা।

ভোজপুরি সিনেমার প্রেক্ষাপটে রবি কিষেণ শুক্লাকে তুলনা করা হয় অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে। সিনেমার পাশাপাশি গত কয়েক বছরে ছোটপর্দার রিয়েলিটি শোগুলোতেও নিজের জায়গা করে নিয়েছেন এই অভিনেতা। সম্প্রতি তিনি যোগদান করেন কংগ্রেসে। উত্তর প্রদেশের জৌনপুর আসন থেকে এবার নির্বাচনে নামছেন তিনি।

তৃণমূল, বিজেপি আর কংগ্রেস ছাড়াও অন্য যেসব দলকে অঞ্চলভিত্তিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে, তাদের মধ্যে রয়েছে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়াম সিং যাদবের দল সমাজবাদী পার্টি। কট্টরপন্থি হিসেবে পরিচিত এই দল থেকে ২০০৯ সালে প্রথম নির্বাচন করেছিলেন ভোজপুরি গায়ক মনোজ তিওয়ারি। এবারে দলবদল করে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছেন তিনি। উত্তর-পূর্ব দিল্লি অঞ্চলে দলটির হয়ে প্রার্থিতা পেয়েছেন তিওয়ারি।

তারকাদের ঝাঁ-চকচকে ভাবমূর্তির উপর ভর করে ভোটযুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশল রাজনীতি নতুন কিছু নয়। তবে, রূপালি দুনিয়ার বাসিন্দাদের হুট করে এভাবে রাজনীতিতে ঢুকে পড়া তাদের নিজেদের জন্যই কতখানি কার্যকর-- সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, গোবিন্দ-- বলিউডের জনপ্রিয় অনেক তারকাই রাজনীতির ময়দানে তাদের ভাগ্য পরীক্ষা করে বিফল হয়েছেন। পরবর্তীতে তারা ফিরে গেছেন তাদের চেনা জগতে। আর তাই এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া এইসব নতুন মুখের মধ্যে কতজন হবেন সফল, আর কতজন বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যাবেন আগের জায়গাতে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।